২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চাকরিচ্যুত বিজেএমসির ক্রীড়াবিদদের মানবেতর জীবন

অ্যাথলেট আল আমিন এখন ঘেরের মাটি কাটার শ্রমিক; কাঠ মিস্ত্রির কাজ করছেন সাইক্লিস্ট নুরুল ইসলাম; অন্যের জমির আইল ঠিক করছেন সাইক্লিস্ট মাসুদ রানা -

২০২০ সালের জানয়ারী মাস। হঠাৎই এক ঘোষণায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল বিজেএমসির বদলি শ্রমিক কোটায় চাকরি করা ক্রীড়াবিদদের। মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা, আর কোনো বদলি শ্রমিককে চাকরিতে রাখবে না বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন বা (বিজেএমসি)। এই কাতারে পড়েন ক্রীড়াঙ্গনে প্রতিষ্ঠানটির মুখ উজ্জ্বল করা ৩৪৬ জন ক্রীড়াবিদ। তাদেরও চাকরি চলে যায়। আর এখন পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরি চলে গেছে স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে চাকরি করা ১৯ খেলোয়াড়েরও। স্থায়ীদের চাকরি চলে যাওয়ার ঘটনা সাম্প্রতিক। বদলি শ্রমিকরা জানুয়ারি থেকে চাকরিচ্যুত থাকায় সাত মাস ধরে বেকার এই খেলোয়াড়রা। তারা এখন মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। দু’বেলা খাবার জোগাতে এই খেলোয়াড়দের কেউ মাছের ঘেরে মাটি কাটছেন। কেউ চালাচ্ছেন অটোরিকশা। অন্যের জমিতে কামলা হিসেবে কাজ করছেন কেউ কেউ। গাছ কাটার শ্রমিক, কাঠমিস্ত্রির কাজও করেছেন কয়েকজন খেলোয়াড়। দুই মহিলা খেলোয়াড়কে পাওয়া গেল যারা ডিম বিক্রি করে আর জামাকাপড় সেলাই করে দিন কাটাচ্ছেন। এই খেলোয়াড়রা অপেক্ষায় আছেন এরিয়ারের টাকা জন্য। তিন-চার লাখ টাকা যা পাওয়া যাবে তা দিয়ে ফের জীবন বদলানোর স্বপ্ন।
বিজেএমসির বদলি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে সপ্তাহে এক হাজার ৮০০ টাকা হিসাবে মাসে সাত হাজার টাকা করে বেতন পেতেন এই ক্রীড়াবিদরা। আর এখন অন্যের জমিতে বা বাড়িতে কাজ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। ডেমরার করিম জুট মিলে চাকরি করতেন তিন হাজার, পাঁচ হাজার ও ১০ হাজার মিটারের দৌড়বিদ আল আমিন। ২০১৭ সালের জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে ১০ হাজার মিটারে চতুর্থ হওয়া যশোরের অভয়নগরের এই ছেলের এখন জীবন চালাতে হচ্ছে মাছের ঘেরে মাটি কাটার শ্রমিক হিসেবে। তিন বছর আগে বিজেএমসিতে চাকরি নেয়া ২২ বছর বয়সী আল আমিন জানান, ‘যে দিন কাজ থাকে সেদিন মাটি কাটার মজুরি হিসাবে পাই ৩০০-৪০০ টাকা। ধান কাটা এবং ধান মাড়াইয়ের কাজও করেছি।’ এইচএসসি পাস এই অ্যাথলেট তথ্য দেন আমার চাকরির অফার ছিল সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ জেল দলে। কিন্তু থেকে গিয়েছিলাম বিজেএমসিতেই। হঠাৎ চাকরি হারানোর খবরে খুব অসহায় হয়ে পড়ি। কাজের অভাবে দু-এক দিন না খেলেও থাকতে হয়।
লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে চাকরি করতেন বুলবুলি খাতুন। ৮০০, ১৫০০ ও ৩০০০ মিটার ইভেন্টের এই দৌড়বিদ চাকরি হারানোর পর বাগেরহাটে অসুস্থ এক বয়স্ক আত্মীয়কে ব্যায়াম করিয়ে মাসে এক হাজার পেতেন। করোনায় তার সেই কাজও বন্ধ। করোনার কারণে রাস্তা ঘাটে উঠা নিষিদ্ধ থাকায় অটোরিকশা চালানোও বন্ধ ছিল তার স্বামী বিজেএমসির সাবেক অ্যাথলেট মেহেদী হাসান রাজার। এখন অবশ্য রাজা একটি হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। জানান বুলবুলি।
জাতীয় সাইক্লিংয়ে পাঁচ স্বর্ণ জয়ী ইয়াসিন হোসেন। বাংলাদেশের হয়ে অংশ নিয়েছেন ২০১৬ সালের শিলং-গৌহাটি এস এ গেমস এবং ২০১৪ সালের গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসে। এখন তিনি বেকার নরসিংদীর ইউএনসি জুট মিলের চাকরি হারিয়ে। জীবন চালাতে অন্যের জমিতে কামলার কাজ করেছেন তিনি। যশোরের বাঘারপাড়ার ছেলে এই সাইক্লিস্টের দেয়া তথ্য, আমি অন্যের জমিতে কাজ করে দিনে ৩০০ টাকার মতো পাই। এই দিয়েই চলছে জীবন।
আরেক সাইক্লিস্ট যশোরের অভয়নগরের নুরুল ইসলাম এখন কাঠমিস্ত্রি। নরসিংদীর ইউএনসি জুট মিলে কাজ করা এই খেলোয়াড়ের ভাণ্ডারে আছে ৮টি স্বর্ণসহ ১৫টি পদক। জানান, ‘চাকরি চলে যাওয়ার পর আমি এখন ফার্নিচার বানানোর কাজ করি। এ ছাড়া অন্য কাজও করছি পেটের দায়ে।’ দিনাজপুরের মাসুদ রানা সাইক্লিস্ট হিসেবে চাকরি করতেন রাজশাহী জুট মিলে। জাতীয় সাইক্লিংয়ে একটি করে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জ জেতা মাসুদ রানাকে এখন কখনো কাঠুরে, কখনো কৃষি জমির শ্রমিক হিসেবে পাওয়া যায়। মাসুদ রানার দেয়া তথ্য, গাছ কাটার কাজ করলে একটু বেশি মানে ৫০০ টাকা পাওয়া যায়। আর জমিতে সার ছিঁটোনা, আইল ঠিক করা এবং আগাছা পরিষ্কার করলে জোটে ৩০০-৩৫০ টাকা।
বিজেএমসির মহিলা ভলিবল দলের খেলোয়াড় রাজশাহীর আশা খাতুনের চাকরি ছিল হাফিজ জুট মিলে। ২০১৯ কাঠমান্ডু-পোখরা এসএ গেমসে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করা আশার দিন কাটছে এখন সেলাই মেশিন চালান। জানালেন, ‘আমার চাকরির টাকায় চলত মা, ছোট বোন ও ছোট ভাইয়ের সংসার। চাকরি চলে যাওয়ার পর এখন জামা-কাপড় সেলাই করে জীবন চালাচ্ছি। বাসা ভাড়ার টাকা জোগাতে ছোট ভাইটি একটি গাড়ির গ্যারেজে কাজ করছে।’ আরেক ভলিবল খেলোয়াড় খুলনার রুবিনা সুলতানা রানুর কর্মস্থল ছিল খুলনারই ইস্টার্ন জুট মিল। চাকরি হারিয়ে রানু পরে দুই হাজার টাকা পুঁজি খাটিয়ে ডিম আর দুধের ব্যবসায় শুরু করেছেন। এ দিয়ে দিনে এক-দেড়শত টাকা লাভ হয় তা দিয়েই চলছে আমাদের সংসার। বললেন রানু।
এই ক্রীড়াবিদরা এখন এরিয়ার বিলের অপেক্ষায়। ২০১৫ সালে ঘোষিত নতুন পে-স্কেল অনুযায়ী তাদের বেতন ডাবল হয়েছে। এই টাকা সব বদলি শ্রমিক হিসেবে চাকরি করা ক্রীড়াবিদদের সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেয়া হবে। এ জন্য তাদের কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়েছে। জানান বিজেএমসির স্পোর্টস অফিসার আবদুল কুদ্দুস।

 


আরো সংবাদ



premium cement