০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কলকাতার রাস্তায় চাকরি হারানো শিক্ষকরা

তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যেই চাকরি হারানো শিক্ষকরা সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন জানানোর জন্য লাইন দিয়েছেন কলকাতায় - ছবি : বিবিসি

কলকাতার শহীদ মিনার, বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল। বেলা বাজে সাড়ে ১২টা। চারদিকে ছোট বড় জটলা, বহু মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন লাইনে। কেউ এসেছেন নদীয়া থেকে, কেউ হাওড়া, কেউ বা আবার পূর্ব বর্ধমান থেকে।

তারা সবাই স্কুলে চাকরি করতেন। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে এরকমই প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা আর শিক্ষা-কর্মীর চাকরি চলে গেছে।

আদালত মনে করেছে ২০১৬ সালের যে নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে এরা স্কুলের চাকরি পেয়েছিলেন, সেই পরীক্ষায় এতটাই দুর্নীতি হয়েছে, যে সবারই নিয়োগ বাতিল।

চাকরি হারানো এরকমই কয়েক হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা কলকাতার শহীদ মিনারের সামনে জড়ো হচ্ছেন গত কয়েকদিন ধরে।

এক তরুণী এসে জানতে চাইলেন, ‘দাদা, নাইন-টেনের লাইনটা কোথায়?’ এক স্বেচ্ছাসেবক দেখিয়ে দিলেন ‘নাইন-টেনের লাইন।‘

আরেকজন স্বেচ্ছাসেবক লাইনে দাঁড়ানো নারী-পুরুষদের বলছেন, ‘টেন্টের ধার দিয়ে লাইনটা করুন। রোদটা কম লাগবে.. সরে যান এদিকে।’

বেলা তখন দেড়টা, কলকাতার তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিছুক্ষণ পরে সেটা বেড়ে হল ৪২ ডিগ্রি।

কলকাতায়
এই তীব্র তাপপ্রবাহে যখন আবহাওয়া দফতর বলছে বেলা ১১টা থেকে বিকেল চারটের মধ্যে বাইরে না বেরতে, সেই সময়েই এদের কেউ একটু ছায়ার খোঁজে গাছের তলায়। আর বেশিরভাগই রাস্তার ধারে, যে যেখানে পেরেছেন বসে পড়েছেন।

পথেই বসেছেন শিক্ষকরা
তারা আক্ষরিক অর্থেই পথে বসেছেন।এখন এই চাকরি হারানো শিক্ষক-শিক্ষিকা আর শিক্ষা কর্মীরা কলকাতায় জড়ো হয়েছেন – প্রতিবাদ জানানোর সাথে সঙ্গেই সুপ্রিম কোর্টে পিটিশনও দাখিল করছেন।

এদের হয়ে নথিসহ পিটিশন সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে একটি সংগঠন।

সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ নামের ওই সংগঠনের রাজ্য আহ্বায়ক ভাস্কর ঘোষ জানাচ্ছেন বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত তাদের সংগঠনের মাধ্যমে হাজার দেড়েক পিটিশন জমা পড়েছে।

শুক্রবার আরো হাজার দুয়েক সম্ভবত জমা পড়বে। সেগুলো একত্র করে তারা দিল্লিতে রওনা হচ্ছেন।

‘ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছি?’
পূর্ব বর্ধমানের কালনা অঞ্চলের একটি স্কুলে গ্রুপ-ডি পিওনের কাজ করেন প্রদীপ গাঙ্গুলি। তারও চাকরি চলে গেছে আদালতের নির্দেশে।

যে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে তিনি চাকরি পেয়েছিলেন, সেটার সাথে এসএসসির ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা ওএমআর শিট আর তার প্রাপ্ত নম্বরের তালিকা দেখিয়ে গাঙ্গুলি প্রশ্ন করছিলেন, ‘দেখুন সব ডকুমেন্টগুলো... মনে হচ্ছে আমি ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছিলাম? এই যে ডকুমেন্ট এসব তো সরকারি ওয়েবসাইট থেকে পেয়েছি – কত নম্বর পেয়েছি, কত র‍্যাঙ্ক ছিল, সবই তো আছে!

‘তা সত্ত্বেও আজ আমার চাকরিটা চলে গেল? আর আমাকে তো ডেকে একবারও আদালত নথি দেখতে চাইল না?’ প্রশ্ন গাঙ্গুলির।

তিনি বলছিলেন, বাড়িতে অসুস্থ বাবা, গোটা পরিবারের দায়িত্ব তার ওপরে। এই পরিস্থিতিতে কী করবেন দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না তার মতো হাজার হাজার মানুষ।

‘স্কুলে গিয়ে কোন মুখে দাঁড়াব'
সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের যে শিবিরটি করা হয়েছে, তার ভেতরে কয়েকশ মানুষ। কীভাবে কোন নথি জমা দিতে হবে, কার কোনো নথির প্রিন্ট আউট লাগবে, সবই যথাসাধ্য করে দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকরা।

তাঁবুর ভেতরে অনেকগুলি লাইন। কোনোটা ‘ক্লাস নাইন-টেন’-এর, কোনওটা ‘ইলেভেন-টুয়েলভ’ আর কোনোটা গ্রুপ-ডি, গ্রুপ সির।

এই ভাগাভাগির অর্থ হল কোন লাইনে দাঁড়াবেন নবম দশম শ্রেণির শিক্ষকরা, কোথাও দাঁড়াবেন একাদশ দ্বাদশ শ্রেণিতে যারা পড়ান, সেই সব শিক্ষকরা আর কোথায় দাঁড়াতে হবে শিক্ষাকর্মীদের।

স্কুলে যেভাবে এই শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের লাইন দিয়ে দাঁড় করান, আজ সেভাবে তাদের নিজেদেরই লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে।

ওই লাইনেই দাঁড়িয়েছিলেন অঙ্ক নিয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করা শিক্ষিকা শিবাণী মালিক।

তিনি নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ান।

মালিক বলেন, ‘এখন স্কুলে গিয়ে ওদের সামনে কোন মুখে দাঁড়াব! ওরা তো প্রশ্ন করবে যে ম্যাডাম আপনার চাকরিই তো আর নেই।’

শুধু যে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে দাঁড়াতে লজ্জা করছে এই হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার তা নয়।

মালিক বলছিলেন, ‘সমাজেই বা কী করে মুখ দেখাব! লোকে তো হাসাহাসি করবে! কেন চাকরি গেছে, সেসব বিচার তো আর কেউ করবে না!”

‘শূন্য পেয়েও নিয়োগ হয়েছে’
স্কুল শিক্ষায় নিয়োগের দাবিতে এই শহীদ মিনারের কাছেই গান্ধী মূর্তির সামনে প্রায় চার বছর ধরে ধর্না আন্দোলন চালিয়ে আসছেন আরেক দল মানুষ।

মূলত: তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগেই শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যে বিরাট মাপের দুর্নীতি হয়েছে, তা সামনে আসে।

তখন থেকেই জানা যাচ্ছিল যে বহু স্কুলে এমন শিক্ষক- শিক্ষিকা নিযুক্ত হয়েছেন, যারা হয় ফাঁকা খাতা জমা দিয়েছেন বা শূন্য পেয়েছেন।

অন্যদিকে পরীক্ষায় যোগ্যতা অর্জন করেও চাকরি পাননি বহু মানুষ।

একজন চাকরি-হারা জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক সুমন বিশ্বাস বলছিলেন, ‘হাইকোর্ট এই স্বয়ংশাসিত সংস্থা এসএসসির কাছে বারবার চেয়েছে যে আপনি ও এম আর শিট দিন। কিছু ও এম আর শিট দিয়েছে... দেখা গেছে শূন্য পেয়েছে। সে চাকরি পেয়েছে, দুই পেয়েছে, সে চাকরি পেয়েছে। ফেল করেছে, কিচ্ছু লেখেনি, সেও চাকরি পেয়েছে।’

শুধু যে কম নম্বর পাওয়া ব্যক্তিরা নিয়োগ পেয়েছেন, তা নয়। নির্বাচিতদের যে প্যানেল তৈরি হয়েছিল, তার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেক নিয়োগ হয়েছে।

আর এই শ্রেণিভুক্ত যারা, আদালত নির্দেশ দিয়েছে যে তারা অনিয়ম করে পাওয়া চাকরি করে যত বেতন পেয়েছেন, তার সবটা বার্ষিক ১২ ভাগ হারে সুদসহ একমাসের মধ্যে ফেরত দিতে হবে।

মমতা ব্যানার্জী যা বলছেন
স্কুল নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে আদালতের নির্দেশে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআই তদন্তে নেমেছে। কিন্তু তার অনেক আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ মন্ত্রকের তদন্ত বিভাগ এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি এই দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছিল।

আর ওই নিয়োগের সময়ে যিনি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন, সেই পার্থ চ্যাটার্জী তার এক বান্ধবীসহ গোটা স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার প্রায় সব শীর্ষ কর্মকর্তারাই এখন জেলে।

চ্যাটার্জী যে শুধু শিক্ষা মন্ত্রী ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস দলের মহাসচিব।

তার বান্ধবী, অভিনেত্রী অর্পিতা মুখার্জীর দুটি ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়ে প্রায় ৫০ কোটি ভারতীয় টাকা নগদ আর প্রায় পাঁচ কোটি ভারতীয় টাকা মূল্যের গয়না উদ্ধার করা হয়েছিল।

এরপর থেকে গ্রেফতার হতে থাকেন একের পর এক শিক্ষা কর্মকর্তা আর তৃণমূল কংগ্রেসের কিছু নেতা।

স্বাভাবিকভাবেই বড় মাপের এই দুর্নীতির জন্য আঙ্গুল উঠছে রাজ্য সরকারের দিকে।

চাকরি হারানো শিক্ষক সুমন বিশ্বাস যেমন সরাসরিই বলছিলেন, ‘এই দুর্নীতির দায় তো রাজ্য সরকারের।’

শহীদ মিনারের আশপাশে জড়ো হওয়া আরো অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা আর সরকারের দিকেই আঙ্গুল তুলছেন।

তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ওই রায় ঘোষণার পর থেকে বারেবারেই বলছেন যে তিনি এবং তার সরকার চাকরি-হারদের পাশে থাকবেন, সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করবেন এদের হয়ে।

ইতোমধ্যেই স্কুল সার্ভিস কমিশন সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে।

মিজ ব্যানার্জী শুক্রবারও বলেছেন, ‘এই ২৬ হাজার চাকরি চলে গেলে স্কুলগুলিতে পড়াবে কে? তা ছাড়া এরা তো শ্রম দিয়েছেন, এদের টাকা ফেরত চাওয়া হচ্ছে কিসের জন্য?’

কলকাতা হাইকোর্টের রায় নিয়ে মিজ ব্যানার্জী যেসব ভাষণ দিচ্ছেন, তাতে তিনি বারেবারে হাইকোর্টের দিকেও আঙ্গুল তুলছেন।

তার সেসব বক্তব্য যে আদালত অবমাননার সামিল, সে অভিযোগও জমা পড়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। যদিও এখনো তা আমলে নেয়নি আদালত।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement