৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সুনামগঞ্জে ধানের দরপতনে কৃষিতে অনাগ্রহ জমির বর্গা হচ্ছে না, পতিত থাকার আশঙ্কা

-

সুনামগঞ্জের হাওরের বোরো জমি বর্গা বা পত্তন দেয়া যাচ্ছে না। বাজারে ধানের দরপতনে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কৃষিতে অনাগ্রহ তৈরি হওয়ার পাশাপাশি জেলার বহু জমি পতিত রয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, হাওরের কৃষকদের জমি প্রতি বছরই ভাদ্র-আশি^ন মাসে বর্গা দেয়া হয়। কিন্তু বাজারে ধানের দাম কম থাকায় এবার বড় কৃষকদের কেউই জমি বর্গা দিতে পারছেন না। বর্গাচাষিরাও জমি বর্গা নিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। গৃহস্থ-কৃষকদের আশঙ্কা এবার বহু জমি পতিত থাকতে পারে। সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, তাহিরপুর, দিরাই, শাল্লাসহ ১১ উপজেলায় বছরে একটিমাত্র বোরো ফসলের ওপর জীবন-জীবিকা নির্ভর করছে সাড়ে ৩ লাখ কৃষকের (২০১৪ সালের হিসাব)। গত বোরো মওসুমে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ১৭ হাজার ৪৩৫ হেক্টর জমিতে। সে জায়গায় আবাদ হয়েছিল ২ লাখ ২৪ হাজার ৪০ হেক্টর। ধান উৎপাদন হয়েছিল ১৩ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টন। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও দরপতনের কারণে উৎপাদনের খরচের চেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন কৃষকরা।
জামালগঞ্জের সর্ববৃহৎ ফসলি এলাকা পাকনা হাওরের ফেনারবাঁক গ্রামের কৃষক নবাব মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা মনে হয় বাংলাদেশের বাইরের মানুষ। বহু কষ্ট কইরা ধান ফলাই। এই ধান সরকারি গুদামে দিতে পারি নাই। বাড়িতে ৫০০ সাড়ে ৫০০ টাকা দরে ধান বিক্রি করন লাগে। এই বছর জমিই রোয়াইতে পারব না। আগে যে জমি রংজমা বা বর্গা দিছি, এইবার কোনো মানুষ জমি নিতে চায় না। পাকনা হাওরে এবার মনে হয় বহু জমি পতিত থাকবো। আমার নিজের জমিতে এবার কিভাবে চাষাবাদ করাবো? এই চিন্তায় শেষ। অন্যরাও জমি বর্গা নিতে চাচ্ছে না।’
একই গ্রামের কৃষক বজলুর রহমান চৌধুরী জানালেন, ‘কৃষি কাজের সময় দিন-রাইত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে ধান ফলাইয়া কোনো লাভ নাই। কত আর লোকসান দিমু। ধানের দাম নাই, সরকারি গুদামেও ধান দিতে পারি নাই। এই কারণে অর্ধেক লছ দিয়া ধান বিক্রি করছি। সরকার যে দামে গুদামে ধান নিছে সব কৃষকের ধান যদি নিত তা হইলে মোটামুটিভাবে আমরা চলতে পারতাম। যাদের ধান নিছে, ওদের কয় শতক জমি আছে? আমরা যারা মধ্যবিত্ত ও বড় গৃহস্থ (কৃষক) তারা কেউই সরকারি গুদামে ধান দিতে পারি নাই। জমি করে সব লোকসান। আর জমি না করারই ইচ্ছা। যদি মানুষ পাই রংজমা দিমু, না পাইলে কী করবো বুঝতে পারছি না। তিনি বড় আক্ষেপ করে জানান, অনেক চেষ্টা করেও কোনো ধান তিনি সরকারি খাদ্যগুদামে দিতে পারেননি।
তাহিরপুরের কৃষক শামীম মিয়া বলেন, ‘খেত পাতানি (বর্গা) যাইতেছে না। গত বছর অনেক ঋণ কইরা বীজ বোনা, সার কেনাসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে কিছু জমি করছিলাম। এবার কয়েকজনের সাথে বললাম, জমি নিতে। তারা কয় আমরা খেত করতাম নায়।’ ক্ষেত কইরা লাভ নাই, লস। সরকারি গুদামে ধান দিতে পারি নাই। নেতারারে যারা ফিট করতে পারছে, হেরার ধানই গুদামে নিছে।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জের সংবাদকর্মী নাঈম তালুকদার বলেন, ধানের বীজ বপন থেকে শুরু করে বীজের টাকা, আগাছা পরিষ্কার করা, কাটা, মাড়াই ও বাড়ি পর্যন্ত ধান আনতে প্রতি একরে যে টাকা খরচ হয় সে টাকায় কেউই ধান বিক্রি করতে পারেনি। তাহলে কিভাবে জমি করবে?
বিশ^ম্ভরপুরের কৃষক আলমগীর কবীর বলেন, আমরা বড় গৃহস্থরা ধান ক্ষেত করে কোনো লাভ নাই। লিল্লাহ্, সদকা, সাহায্য, ধান বিক্রির সুযোগ সব তো গরিবদের। আমরাতো পুতুল। বড় আর মধ্যবিত্ত কৃষকরা ঠেকছে। তারা না পারে লাইনে দাঁড়াইতে, না নেয় লিল্লাহ্, না পারছে সরকারি গুদামে ধান দিতে। যে ধান পাইছিলাম বৈশাখেই ঋণ-বিন দিয়ে অর্ধেক ছিল। পরে পারিবারিক কাজে ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা দরে ধান বেচন লাগছে। গুদামে আমরার ধান নেয় না। আমরা না-কি নীতিমালায় পড়ি না! আমরা কৃষি কইরা কী দোষ করছি, অর্ধেক দামে ধান বেছন লাগে গ্রামের দালালদের কাছে। এবার আমি রংজমার টাকা না দেয়ার শর্তেও কাউকে জমি দিতে পারছি না। অনেকজনকে বলছি, বৈশাখে যা পারো দিও, এ কথা বলার পরেও কেউই জমি নিতে চাইছে না। কারণ ধান কইরা লাভ কী? উৎপাদন খরচই তো উঠে না।
জেলা খাদ্য কর্মকর্তা জাকারিয়া মোস্তফার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুনামগঞ্জে ধান গুদামজাত করার ক্ষমতা বাড়াতে হবে। সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রাও বাড়লে এমন সমস্যা কমে আসত। কর্তৃপক্ষ আমাদের যে নীতিমালায় ধান ক্রয় করতে বলেছে, আমরা তো এর বাইরে যেতে পারি না। তবে সবাই ধান দিতে পারলে ভালো হতো।


আরো সংবাদ



premium cement