০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


উৎসের উচ্চারণ

স্পিনোজার ঈশ্বর প্রসঙ্গে

বারুখ স্পিনোজা। - ছবি : সংগৃহীত

মহাবিশ্বের সব কিছুতেই আছে ঐক্য। বারুখ স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭) সেই ঐক্যের ব্যাখ্যা করলেন এবং ঈশ্বর ও প্রকৃতির অভিন্নতার ভাষ্যকার হয়ে উঠলেন। বললেন, যে জিনিসের আছে অস্তিত্ব, সে আছে ঈশ্বরের মধ্যেই। দৃশ্যমান জগত থেকে অতিজগতের দিকে সফর করার দরকার নেই ঈশ্বরের খোঁজে। যে বর্তমানে আমরা আছি, তার সীমিত অভিজ্ঞতায় ঈশ্বরের অভিজ্ঞান লাভ সম্ভব। ঈশ্বরের ধারণা ছাড়া অন্য কোনো ধারণাকেই গ্রহণ করা সম্ভব নয় এবং গ্রহণ করা হবেও না। কেননা প্রকৃতিতেই বাঁচেন ঈশ্বর, এখানেই হন আন্দোলিত। স্পিনোজা প্রকৃতিকে দেখেছিলেন ঈশ্বরের সাথে এক করে। তার মতে ঈশ্বরই সব, সবই ঈশ্বর। ঈশ্বর জগতটাকে সৃষ্টি করেছেন সেটার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য নয়।

স্পিনোজার মতে, substance বা সারবস্তু আছে শুধু একটি। যেসব জিনিসের অস্তিত্ব রয়েছে, তাকে যে মৌলিক, একক বাস্তবতায় নিয়ে আসা যায়, সেটাই হচ্ছে সারবস্তু। এই বিশ্বজগতের সাবস্ট্যান্স বা সারবস্তু কী? স্পিনোজার ভাষায়, তা হলো সেই অস্তিত্ব, যা নিজেতেই ব্যাপ্ত এবং যার ধারণা স্বয়ংসম্পূর্ণ। অন্যভাবে বললে, যা থেকে অন্য কোনো ধারণার সাহায্য ছাড়াই একটি ধারণার জন্ম হতে পারে। একে কখনো তিনি বলেছেন প্রকৃতি, কখনো ঈশ্বর। গোটা নিখিল আর তার সবকিছুকে তিনি দেখেন ও দেখান একটি একক বাস্তবতায়। বস্তুগত সবকিছু, আধ্যাত্মিক সবকিছুও।

ডেকার্তের সারবস্তু ছিল দুই ধরনের। প্রতিটি বস্তুকে তিনি দেখেছেন দুই সম্ভাব্যতায়। হয় সেটি চিন্তা, নয় ব্যাপ্তি। বাস্তবতার উপলব্ধি ও ব্যাখ্যায় ডেকার্তে যেখানে দ্বৈতবাদী, স্পিনোজা সেখানে অদ্বৈতবাদী। ফলে ডেকার্তের কাছে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল কেবলমাত্র ঈশ্বর। ডেকার্তের উল্লিখিত চিন্তা ও ব্যাপ্তিকে স্পিনোজা দেখিয়েছেন ঈশ্বরের লক্ষণ হিসেবে। এর মানে এই নয় যে, ঈশ্বরের লক্ষণ আর নেই। অগণিত লক্ষণ আছে তার। কিন্তু মানুষ জানে এই দু’টিকেই।

প্রকৃতির সব কিছুই তাই হয় চিন্তা, নয় ব্যাপ্তি। বাস্তব জীবনে আমরা যা কিছুর মোকাবেলা করি, তার মধ্যে এর প্রতিফলন স্পষ্ট। যেমন খেয়াপারের তরণী। একটি নৌকা। আবার খেয়াপারের তরণী কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতা। দুটোরই অস্তিত্ব আছে। কিন্তু একটি ব্যাপ্তি, আরেকটি চিন্তা। খেয়াপারের নৌকাটি ব্যাপ্তির লক্ষণের এক ধরন। আর খেয়াপারের নৌকা নিয়ে রচিত কবিতাটি হলো চিন্তার লক্ষণের একটি ধরন। কিন্তু উভয়ের সারবস্তু কী? স্পিনোজার মতে, উভয়ের সারবস্তু আসলে ঈশ্বর বা প্রকৃতি, প্রকৃতি বা ঈশ্বর। স্পিনোজার বিচারে মানুষ ও মানুষের ধারণার মধ্যে পার্থক্য আছে। মানুষ হচ্ছে বস্তুগত, এর বাস্তব অস্তিত্ব আছে। কিন্তু মানুষের ধারণা সম্পূর্ণই চিন্তার ব্যাপার। এই যে ধারণা, তাকে বলে ঈশ্বর আর এই যে অস্তিত্ব, তা হচ্ছে মহাবিশ্ব। জগত কোনো আবদ্ধ বিষয় নয়। সীমানার পাঁচিলে সীমায়িত নয়। মানুষ যেহেতু পাঁচিলে আবদ্ধ থাকে, ফলে জগতের ওপর আবদ্ধতার ধারণা আরোপ করে।

প্রকৃত অস্তিত্ব হচ্ছেন ঈশ্বর। অন্য অস্তিত্বগুলো স্বাধীন অস্তিত্ব নয়। ধরা যাক এক পাথরের কথা আর পাথর ভাঙতে সক্ষম মানুষের কথা। পাথরটি আছে। মানুষও আছে। কিন্তু উভয়ের অস্তিত্বকে বয়ানের জন্য এটা যথেষ্ট নয় যে, তারা আছে। কারণ পাথরটির অস্তিত্ব তাকে ভাঙতে সক্ষম মানুষটির ইচ্ছার সাথে সম্পর্কিত। মানুষটি তাকে ভেঙে ফেললে সে আর এই পাথর থাকছে না। ফলে পাথরটি আছে, বলার মধ্যে তার থাকার গোটা পরিস্থিতি উঠে আসছে না। পাথরটি যে আছে, তা আছে মানুষটির কারণে। ফলে মানুষটি হয়ে আছে পাথরটির সাবস্ট্যান্স ও কার্যকারণ। আবার মানুষটির অস্তিত্বও স্বাধীন অস্তিত্ব নয়। পাথরটি যদি মানুষটির উপরে পড়ে যায়, মানুষটির অস্তিত্ব শেষ হয়ে যেতে পারে। তাহলে পাথরটি হয়ে যাচ্ছে মানুষটির অস্তিত্বের কারণ। এই যে মানুষটি পাথরটির কারণ, আর পাথরটি মানুষটির কারণ, এগুলো আসলে আপাত কারণ। প্রকৃত কারণ নয়। কেননা যদি ধরা হয় পাথরটির অস্তিত্ব মানুষটির ওপর নির্ভরশীল, তাহলে মানুষটির অস্তিত্ব কিসের ওপর নির্ভরশীল? যদি ঘূর্ণিঝড় হতো, তাহলে মানুষটি উড়ে যেত। তাহলে মানুষটি যে এখন আছে, ধরা যাক তার অস্তিত্ব ঘূর্ণিঝড়ের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় নির্ভরশীল হাওয়ার ওপর, তার নির্ভরতা আহ্নিক গতির ওপর, আহ্নিক গতির নির্ভরতা মহাকর্ষের ওপর। এর মানে হলো অনেক সারবস্তু বা সাবস্ট্যান্স রয়েছে একটি অস্তিত্বের টিকে থাকার। এত সাবস্ট্যান্সের মধ্যে সব কিছুর প্রাণকেন্দ্র ও সারবস্তু একটি একক সাবস্ট্যান্স কি থাকা জরুরি নয়? স্পিনোজা দেখান সেটা জরুরি এবং তা হচ্ছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব।

স্পিনোজার ঈশ্বর মানুষের প্রার্থনা চান না। তিনি বলেন, যাও, জীবনকে উপভোগ করো। গাও, মৌজ করো, তোমার জন্য আনন্দের যা কিছু সাজিয়েছি, তাকে চেখে নাও। বন্ধ করো উপাসনালয়ের দ্বার। যেয়ো না সেখানে। কারণ একে তৈরি করেছ তোমরা, নিজেরাই। উপাসনালয় অন্ধকারাচ্ছন্ন, প্রাণহীন, শীতল। কিন্তু তোমরা বলছ এগুলো আমার ঠিকানা। আমার প্রকৃত ঠিকানা হলো প্রাণময় পাহাড়ে, সবুজে হিল্লোলিত বনে, জলকল্লোলিত নদীতে, উচ্ছ¡সিত ঝরনায়, মনোগ্রাহী সৈকতে। সেখানে আমি আছি, থাকি। সেখানে প্রকাশিত হয় আমার সুন্দর মুখ, মুখের অপরূপা। সেখানে হাসছে আমার ভালোবাসা।

বিপদাপন্ন যে জীবন তোমার, এর জন্য দোষারোপ করো না নিজেকে। তুমি পাপ করেছ, তা আমি বলিনি। তোমার ভুল শাস্তিযোগ্য, তা আমি বলিনি। তোমার যৌনতা খারাপ ছিল, তা আমি বলিনি। কাম তো এক উপহার; আমি তোমাকে দিয়েছি। এ দিয়ে তুমি প্রকাশ করবে আপন ভালোবাসা, আপন পরমানন্দ, আপন খুশির শিহরণ। ফলে অন্যরা যেসব বিশ্বাস তোমাকে দেয়, সেসবের জন্য আমাকে নিন্দা করো না।

ত্যাগ করো কথিত পবিত্র গ্রন্থ পাঠ। এর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। যদি কোনো সূর্যোদয়ে, বৃক্ষশোভায়, বন্ধুর সাজে, তোমার সন্তানের চোখে আমাকে উপলব্ধি করতে না পারো... তবে তুমি আমাকে খুঁজে পাবে না কোনো বইয়ে! আমাকে প্রশ্ন করো না আর- কী করতে হবে? আমাকে এত ভয় পাওয়া বাদ দাও। আমি তোমাকে বিচার করি না, তোমার সমালোচনা করি না, তোমার ওপর রাগ করি না, বিরক্ত হই না। আমি এক বিশুদ্ধ ভালোবাসা।

ক্ষমা চাওয়া বন্ধ করো, এখানে ক্ষমা করার কিছু নেই। যদি আমি তোমাকে সৃষ্টি করে থাকি... তবে আমি তোমাকে আবেগ, সীমাবদ্ধতা, আনন্দ, অনুভূতি, চাহিদা, অসঙ্গতি দিয়েই পূর্ণ করেছি... আর মুক্ত করেছি তোমার ইচ্ছা। আমি তোমার মধ্যে যা দিয়ে রেখেছি তাতে তুমি সাড়া দিলে আমি তোমাকে দোষ দেব কী করে? আমি যদি তোমাকে সৃষ্টি করেই থাকি তাহলে আমি তোমাকে তোমার ভুলের জন্য শাস্তিইবা দেবো কী করে? তোমার কি মনে হয় যারা চিরকাল ধরে খারাপ আচরণও যদি করে আমি আমার সেইসব সন্তানকে পুড়িয়ে ফেলার জন্য নরক তৈরি করতে পারি? এ ধরনের কাজ কি কোনো ঈশ্বর করতে পারে? তোমার সহ-সঙ্গীদের সম্মান করো এবং তুমি নিজের জন্য যা কখনো চাও না, তা করো না। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি যে তুমি তোমার জীবনের প্রতি মনোযোগ দাও, সচেতন হও, সচেতনতাই তোমার পথপ্রদর্শক।

হে আমার প্রিয়, এ জীবন কোনো পরীক্ষা নয়, নির্দিষ্ট কোনো পথের পদক্ষেপ নয়, কোন মহড়া নয়, নয় কোনো স্বর্গের পূর্ববর্তী ধাপ। এখানে এবং এখনই এই জীবনই একমাত্র বিষয়, যা তোমার প্রয়োজন। তুমি মুক্ত, কোনো পুরস্কার বা শাস্তি নয়, কোনো পাপ বা পুণ্য নয়, এখানে কেউ হিসাবের-খাতা বহন করে না, কেউ কোনো হিসাব রাখে না। সত্যিই তোমার জীবনকে তৈরি করার জন্য তুমি মুক্ত। স্বর্গ হোক বা নরক।

এমনভাবে বাঁচো ... এটাই তোমার একমাত্র সুযোগ উপভোগ করার, ভালোবাসার, অস্তিত্বকে অনুভব করার। সুতরাং, পরে যদি কিছু নাই থাকে, তাহলে আমি তোমাকে যে সুযোগ দিয়েছি তা তুমি অবশ্যই উপভোগ করবে। আর যদি থাকেও, সত্যই নিশ্চিত থাক যে আমি জিজ্ঞাসা করব না, তুমি কি ঠিক করেছ নাকি কোনো ভুল। আমি জিজ্ঞাসা করব- তুমি কি এটা পছন্দ করেছ কিনা? তুমি কি মজা করেছ কি না? তুমি সবচেয়ে বেশি কোনটিকে উপভোগ করেছ? এবং তুমি এখানে কী শিখলে?...আমাকে বিশ্বাস করা বন্ধ করো; বিশ্বাস করা হলো অনুমান করা, ধারণা করা, কল্পনা করা। আমি চাই না তুমি আমাকে বিশ্বাস করো, আমিই তোমাকে বিশ্বাস করতে চাই। আমি চাই তুমি আমাকে অনুভব করো; যখন তুমি তোমার প্রিয়তমাকে চুমু খাও, যখন তুমি তোমার ছোট্ট মেয়েকে চুমু খাও, যখন তুমি তোমার কুকুরকে আদর করো, যখন তুমি সমুদ্রে স্নান করো।

আমার প্রশংসা করা বন্ধ করো। প্রশংসা আমাকে বিরক্ত করছে। ধন্যবাদ পেতে পেতে আমি ক্লান্ত। আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করছ? নিজের স্বাস্থ্য, সম্পর্ক ও পৃথিবীর যত্ন নিয়ে তা প্রমাণ করো। তোমার আনন্দকে প্রকাশ করো! এটাই আমাকে প্রশংসিত করার উপায়।
স্পিনোজা ঈশ্বরের নামেই কথাগুলো বললেন, যা তার নিজের কথা। যা মূলত ধর্মের ঈশ্বরের প্রতি অনাস্থা, বিদ্রোহ।

ইহজাগতিকতাবাদ এবং ভোগবাদের তীব্র কাতরানি। তিনি যখন ঈশ্বরের মুখ দিয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে রণধ্বনি উচ্চারণ করছেন, তখন কি ঈশ্বরের ওপর মিথ্যা আরোপ করছেন না? যে মিথ্যার জন্য তিনি দায়ী করেন পোপ-পাদ্রীদের! চিরায়ত পাপের বোধকে তিনি চ্যালেঞ্জ করলেন এবং ধর্মে যা পাপ, তাকে ঈশ্বরের নামে দিলেন অনুমোদন। কিছু সুকৃতির কথাও বললেন। কিন্তু সেগুলোর কথা তো আছে ধর্মেও। তিনি ধর্ম থেকে এগুলোকে করতে চাইলেন বিযুক্ত। ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্মের গতানুগতিকতার প্রতি তার অপরিমেয় অনাস্থা জন্মেছিল। ইউরোপের অন্ধকার যুগে দুই ধর্মের পুরোহিততন্ত্রের স্বেচ্ছাচার, পাপ, লালসা ও জীবন বৈরী ভূমিকার প্রতি তীব্র বিবমিষা ও ক্ষোভ ছিল তার চেতনালোকে। তিনি ধর্মের ঈশ্বর ধারণাটাকেই বদলে দিলেন একদম। তিনি ধর্মীয় জীবনধারাকেই আখ্যা দিলেন মানুষের ডগমা; যা বহুযুগের ধারাবাহিকতায় চলে আসা মতান্ধতাবাদ, অধিবিদ্যাগতভাবে যা একপেশে, ছকে-বাঁধা ও পাথর অনড় চিন্তা, যা কাজ করে অন্ধ হয়ে, অন্ধ মতামত নিয়ে। এ অন্ধত্বের ভিত্তি হলো, কোনো কর্তৃত্ব-ক্ষমতায় বিচারহীন বিশ্বাস এবং অচল-সেকেলে প্রতিজ্ঞাগুলোকে সমর্থন, যা সাধারণত ধর্মীয় চিন্তায় চিহ্নিত।

স্পিনোজার এ বিদ্রোহ ইহুদী ও খ্রিষ্টান মনকে প্রচণ্ডভাবে কাঁপিয়ে দেয়। তিনি উভয় ধর্মের পরিপ্রেক্ষিতের সাথে যুক্ত ছিলেন। এক ইহুদি পরিবারে জন্ম হয় তার। তার জন্মের কয়েক শতাব্দী আগে স্পেনে তার পূর্বপুরুষদের খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হয়। ধর্মের নামে অত্যাচার থেকে তবুও বাঁচা যায়নি। গির্জার পরিচালিত হিংস্র ইনকুইজিশন থেকে বাঁচার জন্য তার মা বাবা নেদারল্যান্ডসে পালিয়ে আসেন। এ সময় তারা ইহুদি ধর্মে ফিরে আসেন। এর ফলাফলও ভালো ছিল না। উভয় সমাজ তাদের দেখতে থাকে সন্দেহের চোখে, ঘৃণার নজরে। এ সবের চাপ গভীরভাবে স্পিনোজার জীবনকে পিষ্ট করে, যার প্রভাব তার দর্শনে পড়ে প্রচণ্ডভাবে। পিতা ছিলেন ব্যবসায়ী। বেড়ে ওঠার পথে সব সম্ভাবনাই খোলা ছিল। ১৬৩৯ সালে আমস্টারডামে ইহুদিদের স্কুলে ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। পরে পরিচিত হন ইহুদি দার্শনিক ও কাব্বালা নামের মরমিবাদের সঙ্গে। তার পরিবারে চর্চিত হতো স্প্যানিশ ভাষা। তিনি এর সাথে শিখে নেন লাতিন, পর্তুগিজ, ইতালীয়, ওলন্দাজ ও ফরাসি ভাষা।

প্রকৃতিবিজ্ঞান রপ্ত করেন চিকিৎসক ও পণ্ডিত ফান ডেন এন্ডেনের কাছে। জিওর্দানো ব্রানো ও রেনে ডেকার্তের লেখার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ঘটে। তাদের সাথে ধর্মের নামে পোপতন্ত্রের অন্যায়গুলো তাকে করে রক্তাক্ত। তার প্রতিভার আলো ছড়িয়ে পড়লে ইহুদিসমাজ শুরুতে তাকে করে সহযোগিতা। তাদের বড় দার্শনিক হবেন স্পিনোজা! স্পিনোজা প্রথম দিকে রেনে ডেকার্তের প্রিন্সিপিয়া ফিলোসফিয়া’র দ্বিতীয় খণ্ডের ওপর একটি সার সংক্ষেপ করে আলোচিত হন তার স্বজাতি ও দার্শনিক মহলে। দার্শনিক লাইবনিজ বিশেষভাবে আগ্রহী হন তার প্রতি।

কিন্তু ঈশ্বরের নিজস্ব ব্যাখ্যা ও ধর্মকে যথেচ্ছ আক্রমণের ফলে অচিরেই নিজের সম্প্রদায় কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হন স্পিনোজা। আপন পরিবার তাকে ত্যাগ করে। উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার আয়োজন হয়। সবচেয়ে নিকৃষ্ট শয়তান হিসেবে ঘোষণা করা হয় তাকে, প্রচার করা হয় তিনি অভিশপ্ত একজন।

১৬৫৬ সালে বন্ধ হয়ে যায় সিনাগগ থেকে তার সাহায্যপ্রাপ্তি। আমস্টারডামে তিনি যাপন করতে থাকেন নিঃসঙ্গ জীবন। এ সময় তার পেশা ছিল চশমার কাঁচ পরিষ্কার করা। চার বছর এই পেশা নিয়েই আমস্টারডামে বসবাস করেন। এরপর হেগ শহরে চলে আসেন। কয়েকটি বিখ্যাত বই প্রকাশের কারণে ১৬৬০ এর দশকের প্রথম দিকে স্পিনোজার নাম চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৬৭০ সালে প্রকাশিত ট্র্যাকটাটাস থিওলোজিকো-পলিটিকাস বইয়ের জনপ্রিয়তা এবং গুরুত্ব লক্ষ করে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে চায় দর্শনের অধ্যাপক বানাতে। কিন্তু শর্ত ছিল প্রতিষ্ঠিত ধর্মের বিরোধিতা করা যাবে না। তিনি রাজি হননি।

তার ট্র্যাকটাটাস থিওলোজিকো নেদারল্যান্ডসে প্রকাশিত হয়। যুক্তিবাদের পক্ষে এবং খ্রিষ্ট ও ইহুদি বিশ্বাসের বিপরীতে বইটি প্রচণ্ড আক্রমণে ছিল অগ্নিময়। নিজ নামে তিনি বইটি প্রকাশ করতে পারেননি, ছদ্ম নামেই ছাপা হয়। সরকার একে নিষিদ্ধ করে। ইহুদি ও ক্যাথলিক মহলে প্রবল রোষের সম্মুখীন হয় এ বই।

১৬৭৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হেগে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মৃত্যুকালে চাকর ছাড়া তার পাশে কেউ ছিল না। যে ঈশ্বরকে তিনি সবকিছুর মধ্যে দেখাতে চাইতেন কিংবা যে সবকিছুকেই তিনি ঈশ্বর মনে করতেন, সেই ঈশ্বর কি ছিলেন স্পিনোজার মরণে, পাশে? স্পিনোজা বলবেন মরণের মধ্যেই নিহিত আছেন ঈশ্বর। এর মানে যে মরণ তাকে মেরেছিল, এর সারবস্তু হলেন ঈশ্বর। তথা ঈশ্বর তাকে মেরে ফেললেন। কিন্তু ঈশ্বরের মারার স্বরূপ কী ছিল? এ প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য স্পিনোজা বেঁচে নেই। বেঁচে আছে তার জটিল, সূক্ষ্ণ ও বিস্তৃত দর্শন। যা নানা সীমাবদ্ধতা নিয়েও যুক্তিবাদের প্রখর বয়ানে আজো প্রভাবশালী বিশ্বময়! বাইবেলীয় বিশ্বদৃষ্টি প্রত্যাখ্যান করে জগতব্যাখ্যার নতুন দরোজা খুলে তিনি আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শনকে উদগতি দিয়েছেন। স্পিনোজার পর তার ঈশ্বর একেবারে একা হয়ে পড়েননি। কিছু মানুষ তার অনুরাগী ছিলেন প্রতি যুগেই। কিন্তু সে ঈশ্বর নির্বিকার। ভালোও বাসে না, ঘৃণাও করে না। সে ঈশ্বর মানুষের অনেক ঊর্ধ্বে; মানুষের আশা আকাক্সক্ষার প্রতি উদাসীন। সে ঈশ্বর স্পিনোজার তত্ত্বে শুধু ঈশ্বর। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তার কোনো বাস্তবতা নেই!

লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement