১৮ মে ২০২৪, ০৪ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫
`


ভারত-চীন-মার্কিন, কোন জেরে বাংলাদেশ

ভারত-চীন-মার্কিন, কোন জেরে বাংলাদেশ - নয়া দিগন্ত

দৈব কিছু না ঘটলে চলতি লোকসভা নির্বাচনের মাধ্যমে একটি টার্নিং পয়েন্টের দিকে যাচ্ছে ভারতের রাজনীতি। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে কেন লোকসভা নির্বাচন আগে গ্রেফতার করা হলো, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেটের নিকট কারণ জানতে চেয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ভারতের এই কেন্দ্রীয় সংস্থা মামলায় বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়াই ফৌজদারি কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে কিনা, তা স্পষ্ট করার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। নিপীড়নের শিকার হয়ে কেজরিওয়াল ভারতের রাজনীতিতে আরো বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছেন। আবার হাল ছাড়ার পাত্র নন মোদিও। ভারতকে নিয়ে চীনেরও একাধিক চিকন হিসাব। তা সুদূরের যুক্তরাষ্ট্র নিয়েও। নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে পর্যন্ত সমীকরণ মেলাচ্ছে চীন। চেষ্টা করছে প্রভাব বিস্তার ও হস্তক্ষেপেরও। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এ নিয়ে অভিযোগ করতেও ছাড়েননি।

চীন সফরে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ব্লিঙ্কেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে চীনের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা নিয়ে ওয়াশিংটনের হাতে প্রমাণ আছে। তাই নির্বাচনে চীনের যেকোনো হস্তক্ষেপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সতর্কতার সঙ্গে নজর রাখছে। চীনের এই কর্মকাণ্ড একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। এদিকে চীন বরাবর বলে আসছে, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে তারা হস্তক্ষেপ করে না। অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার নীতি বেইজিংয়ের নেই। বাস্তবে এমন দাবির বিপরীতে যাবতীয় কাজেই ব্যস্ত চীন। গত বছর কয়েক ধরে তা করছে একেবারে গায়ে পড়ে। গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের মধ্যে বৈঠকেও ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চীন যাতে হস্তক্ষেপ এবং প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা না চালায়- এমন বার্তা দিয়েছিলেন জো বাইডেন। সে সময় জিন পিং তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন চীনের পক্ষ থেকে এমন কোনো কাজ করা হবে না। চীনও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা রাখে কিনা তা আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। স্নায়ুযুদ্ধের সময় এসব প্রশ্ন ও ধারণার মূল্য থাকে না। যার যার স্বার্থ এবং অস্তিত্ব এখানে মুখ্য বিষয়।

বড়দের শীতলযুদ্ধে বাংলাদেশের মতো ছোট দেশও কম যায় না। স্বার্থ বিবেচনায় যেখানে যতটুকু লাভ পায় তা লুফে নেয়। ‘কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’- স্লোগানে পা ফেলে সব দিকে, সব নৌকায়। বিপরীতে বড়রাও ব্যবহার করে। সেই সমীকরণে শিগগিরই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে যৌথ সামরিক মহড়া করতে যাচ্ছে চীন। দুই সামরিক বাহিনীর মধ্যে সমঝোতা অনুযায়ী, পিপলস লিবারেশন আর্মি-পিএলএ এই মহড়া দেবে। মহড়াটির নাম দেয়া হয়েছে ‘চীন-বাংলাদেশ গোল্ডেন ফ্রেন্ডশিপ ২০২৪’। এই পিএলএ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে শক্তিধর ভারতের এই প্রতিবেশীর সাথে তার সম্পর্ক উন্নত করেছে। এখন দুই সামরিক বাহিনী হাইজ্যাকিং, সন্ত্রাস নির্মূল ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে মিশ্র গ্রুপে যৌথ প্রশিক্ষণ পরিচালনা করবে। এটি প্রথমবারের মতো চীনা ও বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর যৌথ প্রশিক্ষণ পরিচালনা। এতে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও বন্ধুত্ব বাড়বে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বকে বলে রক্তের বন্ধুত্ব। আর চীনকে বলে অর্থনীতির বন্ধু। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সম্ভাব্য যৌথ সামরিক মহড়ার দিকে ভারতের নজর থাকাই স্বাভাবিক। এই নজরদারির জের না থেকে পারে না।

বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে চীন। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে পাকিস্তানের পরে সর্বোচ্চ, ঢাকার সাথে যুদ্ধের ট্যাংক, নৌ ফ্রিগেট, মিসাইল বোট, ফাইটার বোট ছাড়াও প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে চীন বাংলাদেশের সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্কও স্থিরভাবে উন্নত করেছে যা নিয়ে ভারত চিন্তিত। চীন এর আগেও বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে দুটি সাবমেরিন দিয়েছে। গত বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারে চীনের নির্মিত ১.২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাবমেরিন ঘাঁটি উদ্বোধন করেন, যা সাবমেরিন এবং যুদ্ধজাহাজকে নিরাপদ জেটি সুবিধা দেবে। ঘাঁটিতে একসঙ্গে ছয়টি সাবমেরিন এবং আটটি যুদ্ধজাহাজ থাকতে পারে। এটি জরুরি পরিস্থিতিতে সাবমেরিনগুলোর নিরাপত্তা এবং দ্রুত চলাচলের অনুমতি দেবে। বঙ্গোপসাগর উপকূলে চীনকে এমন ঘাঁটি দেয়া ভারতের জন্য পিত্তজ্বালার।

চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বকে অনন্য উচ্চতায় নেয়ার কথা যতবার বলা হয়, তা ভারতকে ততোবার ভাবায়। এর মাঝে বাংলাদেশকে ব্রিকস জোটেও স্বাগত জানিয়ে রেখেছে চীন। বাংলাদেশ তা মোটামুটি কবুলও করে রেখেছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর এ জোট বাংলাদেশের জন্য কতটা আশীর্বাদের কতটা অভিশাপের তা বলার চূড়ান্ত সময় এখনো আসেনি। এর বাকি সদস্যরা হচ্ছে- ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। আরো অনেক দেশ এতে শামিল হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটি একটি মার্কিনবিরোধী জোট। পশ্চিমাদের টেক্কা দেয়ার এ আন্তর্জাতিক জোটের জয়গান নিয়মিত গেয়ে আসছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। সেইসাথে বাংলাদেশকে ‘আমাদের আপন বন্ধু’ বলে উচ্ছ্বাস তার। ইয়াও ওয়েন প্রসঙ্গ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের প্রশংসা করেন নিয়মিত। যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করে ক’দিন আগেও বলেছেন, শেখ হাসিনা যেভাবে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন, তাকে চীন সবসময় সম্মান করে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বরাবরই ভালো থাকে, এখনো আছে। ভারত তার সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত রাজ্যগুলোতে মালামাল পরিবহনের জন্য করিডোর হিসেবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করছে। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারত অনুমতি পেয়েছে। বাংলাদেশ কয়েক বছর থেকেই ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করছে। সুন্দরবনের রামপালে ভারত যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে। চীনের সাথে বাংলাদেশের কোনো সীমান্ত নেই। তাদের অর্থনীতির ওপর বাংলাদেশের অনেক ভরসা। অর্থনীতির পাশাপাশি চীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও ফ্যাক্টর।
বাংলাদেশের অনেক বড় বড় প্রকল্প চীনের সহায়তায় নির্মিত। চীনের প্রতিষ্ঠান পদ্মা সেতু এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল তৈরি করেছে।

এখন চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীন নির্মাণ করছে চায়না অর্থনৈতিক জোন। এই চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বরাবর চরম শত্রুতার। ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তান হচ্ছে চীনের পরম মিত্র। ফলে ভারত ও চীনের সাথে সমান্তরাল সম্পর্কের মাঝে ঝুঁকিও অনেক। চীনের সাথে বাংলাদেশের অতি ঘনিষ্ঠতা ভারতের অপছন্দ। ভারতের সাথে মাখামাখিও চীনের অপছন্দ। আবার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীন-ভারত দু’দেশের ঘনিষ্ঠতাই অপছন্দের। বাংলাদেশের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভারত-চীন-রাশিয়ার আধিপত্য যুক্তরাষ্ট্রকে হজম করতে হয়েছে। এর একটা জের এখনো অবশিষ্ট। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো তাদের উদ্বেগ-বিরক্তি জানিয়েই আসছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের কাছেই সুপার অত্যাবশ্যকীয় করে তুলেছে। চীনের মূল উদ্দেশ্য ভারতের কাছে বাংলাদেশের নোঙরে পৌঁছা, যাতে তারা নয়াদিল্লির ওপর দৃষ্টি রাখতে পারে। মেগা অবকাঠামো উন্নয়নের নামে চীনের মূল উদ্দেশ্য ইউনান প্রদেশ থেকে বাংলাদেশের বন্দরের সুযোগ পাওয়া, যা ভারতের খুব কাছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে অধিক পরিমাণে উদ্বিগ্ন, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে শক্তির লড়াই চলছে। বাংলাদেশ সেখানে ভারসাম্যের চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের জন্য কূটনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জের পাহাড় তৈরির সূচনাবিন্দু হচ্ছে বাংলাদেশে চীনের প্রভাব।

ভারতের কাছে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যেকোনো মূল্যে তারা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখবে। ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষতি করতে বিদেশী কোনো শক্তিকে তার মাটি ব্যবহার করতে দেবে না। বাংলাদেশ আরো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, বাংলাদেশে চীনের ভূমিকাকে দেখা উচিত একটি উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে। এর মাঝে সময় ও পারিপার্শ্বিকতায় আশপাশে কিছু উপাদান বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। মোদি লাক্ষা দ্বীপের কার্ড খেলেও চায়না থেকে মালদ্বীপকে সরাতে পারেনি। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট চীন সফর শেষে বরং উল্টো হুঁশিয়ারি দিয়ে মার্চের মধ্যে ভারতকে সৈন্য প্রত্যাহারে বাধ্য করেন। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের এই আধিপত্য ঠেকাতে ভারতের ব্যর্থতা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক অশনিসঙ্কেত। শুধু মালদ্বীপে নয়, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানেও চীনের কারণে ভারত তার আধিপত্য হারিয়েছে। বঙ্গোপসাগর উপকূলে অপেক্ষাকৃত অধিক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ভূরাজনৈতিক অবস্থানে থাকা বাংলাদেশকে কোন পরিণতিতে নেয় এ নিয়ে অপেক্ষা অনেকের। মালদ্বীপের মতো বাংলাদেশে ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে ভবিষ্যতে চীনের আধিপত্য ঠেকানোর মার্কিন উদ্যোগ, সামনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মাঠের খেলাকে কোন দিকে নেবে-এ প্রশ্ন থাকছেই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement