২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বর্ষার আগেই ভয়াবহ জলাবদ্ধতা আতঙ্কে ডিএনডির ২০ লাখ মানুষ

সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে নারায়ণগঞ্জের ডিএনডির নিচু এলাকা : নয়া দিগন্ত -

বর্ষাকাল আসতে আরো সপ্তাহ খানেক বাকি, এরই মধ্যে জলাবদ্ধতা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) এলাকায় বসবাসকারী প্রায় ২০ লাখ মানুষের মধ্যে। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ডিএনডির নিচু এলাকা। অনেক বসতবাড়িতে পানি উঠেছে। তলিয়ে গেছে বিভিন্ন এলাকার অলিগলি। এতে একদিকে যেমন দুর্ভোগ বেড়েছে অন্যদিকে আসন্ন বর্ষায় আরো ভয়াবহ জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করছেন এখানের মানুষ। এছাড়া সময় মতো পানি নিষ্কাশন প্রকল্প কাজ শেষ না হওয়ায় মানুষের মধ্যে জলাবদ্ধতা আতঙ্ক আরো বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ডিএনডির ফতুল্লা এলাকায় মাত্র তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে বিশাল এলাকা ডুবে গেছে। ইসদাইর বুড়ির দোকান, পশ্চিম ইসদাইর, গাবতলী ব্যাংক টাউন, টাগারেরপাড়, লালপুর, শিয়ারচর দেলপাড়া, ভুঁইগড়, মামুদপুর, নয়ামাটিসহ নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হয়েছে।
স্থানীয় ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে ডুবে যাওয়া এলাকাগুলো থেকে সহসা আর এই পানি নামবে না। আসন্ন বর্ষায় আরো বৃষ্টিপাত হবে এবং পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে। তাই এসব এলাকার সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কেউ বলতে পারছে না পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। গোটা এলাকা হাঁটু পানির নিচে ডুবে গেছে।
পশ্চিম ইসদাইর ব্যাংক টাউন এলাকার বাবুল আহম্মেদ বলেন, তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে অত্র এলাকার সব ঘরে পানি ঢুকেছে। ডুবে গেছে স্কুল ও দোকানপাট। আমরা ঘর থেকে বের হতে পারছি না। গত তিন বছর ধরেই চলছে এই অবস্থা। অথচ সরকার নাকি ৬০০ কোটি টাকার কাজ করাচ্ছে। আমরা জলাবদ্ধতা হবে না বলে শুনে আসছি আশ^াসের বাণী। কিন্তু বাস্তবতা হলো পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। বর্তমানে যে পানি জমেছে আর বৃষ্টি না হলেও এই পানি নামতে লাগবে অন্তত এক সপ্তাহ। আর এখন তো বৃষ্টির সময়। মাত্র জ্যৈষ্ঠ মাস চলছে। আষাঢ়, শ্রাবণ তো রয়েছেই। কি যে হবে। আতঙ্কের মাঝে আছি।
গাবতলী এলাকার বাসিন্দা হাজী মহিউদ্দিন বলেন, পরিস্থিতি ভয়াবহ। আমার চারতলা বাড়ির নিচতলা ডুবে গেছে। রাস্তায়ও হাঁটু পানি। আমি বাড়ি থেকে বের হতে পারছি না। কিন্তু তিন বছর ধরে শুনতে পাচ্ছি সরকার শত শত কোটি টাকার কাজ করাচ্ছে। কিন্তু এত টাকার কাজ করার পরেও কেনো এত পানি জমবে। এখন তো দেখি জলাবদ্ধতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তাই বিষয়টি এখনই সরকারের ওপর মহলে তুলে ধরা জরুরি বলে আমি মনে করি।
সরেজমিন দেখা গেছে, পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভয়াবহ। সামনে লাগাতার বৃষ্টি হলে পরিস্থিতি যে কী হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই এখনই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নিলে এসব এলাকার লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগের কোনো সীমা থাকবে না।
জানা যায়, গত দু’দিনের বর্ষণে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতায় ডিএনডির অভ্যন্তরের নিচু এলাকায় বসবাসরত বাসিন্দারা পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বর্ষণে সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী, নয়াপাড়া, গোদনাইল, মুজিববাগ, রসুলবাগ, মিজমিজি, নয়াআটি, নিমাইকাশারী, সানারপাড়সহ বিভিন্ন এলাকার অনেক বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে।
সরেজমিন দেখা যায়, কদমতলী এলাকার প্রতিটি বাড়ি পানিতে তলিয়ে আছে। এ সময় কদমতলী নয়াপাড়ার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম জানান, এখন ঘরের মেঝেতে পানি। বর্ষণে রাস্তাঘাট ডুবে ঘরেও পানি প্রবেশ করেছে। পানির সাথে ময়লা থাকায় দুর্গন্ধে থাকা যাচ্ছে না। ভাড়াটিয়া সেলিনা বেগম বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এ অবস্থা অন্যান্য এলাকায়ও। আদমজীর সচেতন নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক এম এ মাসউদ বাদল সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের কাছে খোলা চিঠি দিয়ে বর্তমান জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য আবেদন জানিয়েছেন।
শিমরাইলের পাম্প হাউজে গিয়ে দেখা যায়, ৫১২ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন চারটি পাম্পের মধ্যে ২টি পাম্প চালু রাখা হয়েছে। ঢাকা যান্ত্রিক পাম্প হাউজ (শিমরাইল পাম্প হাউজ) বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাম প্রসাদ বাসাক জানান, বর্তমানে ২টি পাম্প চালু আছে। সবগুলো পাম্প চালু করলে ময়লা আটকে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। তিনি আরো জানান, বর্তমানে ময়লা পরিষ্কার করার জন্য শ্রমিক না পাওয়ায় পরিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
এ দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ নানা জটিলতায় পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট একনেকের সভায় ৫৫৮ কোটি টাকার এই মেগা প্রকল্প পাস হওয়ার খবরে সিদ্ধিরগঞ্জ, ফতুল্লা, ঢাকার ডেমরাসহ আশপাশের এলাকায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।
২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের উপস্থিতিতে বিশাল জনসভায় এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়। ২০১৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর এই প্রজেক্ট সম্পন্ন করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে সেনাবাহিনী চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর কাজ শুরু করে সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধীনস্থ ১৯ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন। এদিকে প্রকল্পের কাজ ২০১৯ সালের জুনে সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও দেখা দেয় নানা প্রতিবন্ধকতা। বেড়ে যায় প্রকল্প ব্যয় ও সময়।
সর্বশেষ গত ৮ মার্চ (ডিএনডি) এলাকার নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের (২য় পর্যায়) উদ্বোধনকালে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক জানিয়েছিলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রাথমিক অবস্থায় ৫৫৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও এর ব্যাপকতা বেশি হওয়ায় আরো প্রায় ৭০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। ডিএনডির খাল খনন ও পানি নিষ্কাশন প্রকল্পের ৭০ ভাগ কাজই সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ করতে আরো প্রায় ৭০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে যাচাই-বাছাই করে প্রথম পর্যায়ের প্রকল্প ব্যায় সংশোধন করে নতুন করে বরাদ্দ চেয়ে সরকারের একনেক সভায় প্রস্তাবও পাঠিয়েছে বলে জানান।


আরো সংবাদ



premium cement