০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কদম ফুলের দিন

-

সকাল হতেই ঝুম বৃষ্টি। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে পৃথিবীর আকাশ। সকালে ঘুম ভেঙেছে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে। কদমের মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে লাগছে। দোতলার জানালার পাশে কদম গাছটা দাঁড়িয়ে আছে। একটানা রিমঝিম ছন্দে বৃষ্টি ঝরছে তার ওপর। গাছের ডালে থোকায় থোকায় ঝুলে আছে হাজারও কদম ফুল। মেঘের আঁধার যেন দূর হয়ে গেছে এত এত শুভ্র ফুলের সৌন্দর্যে! বৃষ্টির স্বচ্ছ জল চুঁঁইয়ে পড়ছে ফুলের পরাগ বেয়ে। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কদমের মিষ্টি ঘ্রাণে বিমোহিত হয়ে গেলাম আরো। আনন্দের সুর যেন বাজতে লাগল মন-মহুয়ায়।
কদম ফুল বর্ষার দূত। সবুজ পাতার ফাঁকে ফুটে থাকা কদম ফুল জানান দেয় আষাঢ়ের আগমনী বার্তা। বর্ষাকাল আসতে না আসতেই বসতে থাকে কদম ফুলের মেলা। বর্ষা মানেই কর্দমাক্ত রাস্তা আর গ্রামের দস্যি ছেলেদের কদম ফুল নিয়ে হই-হুল্লোড়। বর্ষার মেঘের সাথে মিতালি বলেই হয়তো এর আরেক নাম মেঘাগমপ্রিয়। আর নারীর সৌন্দর্যের সাথে তুলনা হয় বলে হয়তো এর আরেক নাম ললনাপ্রিয়। কদমের ঘ্রাণ অনেক কম হলেও কদমকে ডাকা হয় সুরভি নামে। বৃত্তপুষ্প, কর্ণপূরক, ভৃঙ্গবল্লভ, মঞ্জুকেশিনী, পুলকি, সর্ষপ, প্রাবৃষ্য, সিন্ধুপুষ্প নামেও কদমের পরিচিতি আছে সংস্কৃত ভাষায়।
দেশের প্রায় সব এলাকায়ই কদম গাছ দেখা যায়। বিলের ধারের কদম গাছগুলো বড় চমৎকার দেখায়। খাল-বিলের উপচে পড়া জল যেমন শাপলাকে সাজিয়ে তোলে, তেমনি পরিবেশকে মাতিয়ে তোলে বর্ষার কদম ফুল। মানুষের নাম থেকে শুরু করে স্থান, চুলের ছাঁট, মিষ্টি ইত্যাদির নামের কদমের ব্যবহার দেখা যায়।
‘এসো নীপ বনে নবধারাজলে’ লিখে রবীন্দ্রনাথ কদমকে বাঙালি মননে স্থায়ী করে দিয়েছেন বর্ষার ফুল হিসেবে। তিনি লিখেছেন, বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান...।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের এই চরণ যেন দিন দিন আধুনিক জীবনে বর্ষা আবাহনের অনন্য ব্যঞ্জনায় পরিণত হয়েছে। যদিও সেই প্রথম কদম ফুল আজ আর বাদল দিনের জন্য অপেক্ষা করে থাকে না। দিনপঞ্জির হিসেবে বর্ষা আসার আগেই সে প্রস্তুত হয়ে থাকে বাদল দিনের আগমনী বার্তা নিয়ে।
আমাদের পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের মতো করে কবিতায় গ্রামবাংলার কদম ফুলের বর্ণনা আর কেউ করতে পারেনি। কবি তার ‘পল্লী বর্ষা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাট-মেঘের আড়ে/কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে/কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়/ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!/বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়/সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।’
লোকগাথা, পল্লীগীতি, রবীন্দ্র কাব্যে পর্যন্ত কদম ফুলের উল্লেখ রয়েছে। ভানুসিংহ, পদাবলী, বৈষ্ণব পদাবলী ও শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে নানাভাবে নানা আঙ্গিকে এসেছে কদম ফুলের কথা।
বাংলার বনে বনে বর্ষার বারিধারায় কদম ফুলের রেণু এখনো ভেসে বেড়ায়। গাছে গাছে বর্ষার বাহারি ফুলের সাথে ভিজে আরো দ্বিগুণ স্নিগ্ধতায় হেসে ওঠে কেয়া-কদম। কদম গাছ ছাড়া কি গ্রাম হয়! এরা অবহেলা-অনাদরেই বেড়ে ওঠে গ্রামের আনাচে কানাচে। কদম গাছ দীর্ঘ আকৃতির এবং বহু শাখাবিশিষ্ট উদ্ভিদ। রূপসী তরুর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কদম গাছ। কদমের পাতা বড় বড় ডিম্বাকৃতি ও উজ্জ্বল সবুজ হয়ে থাকে। নিবিড় পত্রবিন্যাসের জন্য কদম ছায়াঘন একটি গাছ। গাছের উচ্চতা ৪০ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত হয়।
শীতকালে কদমের পাতা ঝরে যায় আর বসন্তে কচি পাতা গজায়। কদমের কচি পাতা হালকা সবুজ রঙের হয়। কদমের একটি পূর্ণ মঞ্জরীকে একটি ফুল বলে মনে হলেও তা মূলত বর্তুলাকার মাংসল পুষ্পাধারে অজস্র সরু ফুলের বিকীর্ণ বিন্যাস। কদম ফুল বলের মতো গোলাকৃতির হয়। রং সাদা ও হলুদ হয়ে থাকে। তবে পাপড়ি ঝরে গেলে গোলাকৃতির হলুদ বলের মতো দেখায়। গাছের ফল অত্যন্ত মাংসল ও টক হয়, যা বাদুড় ও কাঠবিড়ালির প্রিয় খাদ্য।
সাধারণত আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিতেই কদম ফুল ফোটে। তবে কখনো কখনো বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠেও ফুটতে দেখা যায়। কদম গাছ বর্ণে, ঘ্রাণে ও সৌন্দর্যে এ দেশের রূপসী তরুর অন্যতম।
ছোটবেলা বর্ষাকাল এলেই বন্ধুদের সাথে গাছ থেকে কদম ফুল পাড়ার উৎসবে মেতে উঠতাম। বিলের দিকে ঝুঁকে থাকা গাছের ডাল থেকে পানিতে লাফ দিয়ে চলত দাপাদাপি। আগের মতো এখন আর খুব একটা কদম গাছ চোখে পড়ে না। শহর তো বটেই, গ্রাম থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে বর্ষার ঐতিহ্য সাদা-হলুদ মঞ্জরীর চিরচেনা কদম ফুল। অনেক জায়গায় কদম গাছকে তুচ্ছ মনে করে কেটে ফেলা হয়। কিন্তু কদম ছাড়া বর্ষা যে একেবারেই বেমানান! তাই প্রাকৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে কদম গাছ রোপণ করা খুবই প্রয়োজন।হ


আরো সংবাদ



premium cement