২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কালের সাক্ষী সুবেদার শায়েস্তা খানের কন্যা বিবি মরিয়মের সমাধি

অনন্য স্থাপত্য
-

মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে ১৬৬৪ থেকে ১৬৮৮ সাল পর্যন্ত বাংলার সুবেদার ছিলেন শায়েস্তা খান। তার মেয়ে তুরান দখত স্থানীয়ভাবে বিবি মরিয়ম নামে পরিচিত। তিনি শায়িত আছেন নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জের কেল্লারপুলে। শায়েস্তা খান নিজেই মেয়ের কবরে একটি সমাধি নির্মাণ করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। শায়েস্তা খানের আরেক মেয়ে ইরান দখত যিনি পরী বিবি নামে পরিচিত তার সমাধি রয়েছে লালবাগ কেল্লার পাশে। বিশিষ্ট প্রতœতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ এবং ভাষাবিদ আহমদ হাসান দানীর মতেÑ বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধটি সুবাদার শায়েস্তা খায়ের আমলেই নির্মাণ করা হয়। মরিয়মের নামের সাথে মিল রেখে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে মসজিদ ও বিবি মরিয়ম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়।
প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের তালিকায় নারায়ণগঞ্জের ১৫টি স্থাপনার মধ্যে বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থাপনাটি রক্ষায় দরকার জাদুঘর ও প্রতœতত্ত্ব বিভাগের তদারকি এবং স্থানীয় উদ্যোগ। তবেই টিকে থাকবে সুবেদার শায়েস্তা খান নির্মিত বিবি মরিয়মের ঐতিহাসিক সমাধিটি। কিন্তু প্রতœতাত্ত্বিক এ নিদর্শন এখন অযতেœ-অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। বিবি মরিয়মের সমাধির দেয়াল থেকে খসে পড়ছে ইট-সুরকি। রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই।
সমাধিসৌধটির পশ্চিম পাশে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট বিবি মরিয়ম মসজিদ রয়েছে। সমাধিসৌধটি সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা একটি আয়তাকার প্রাঙ্গণের মধ্যখানে ভূমি থেকে উঁচু ভিতের উপর নির্মিত। বর্গাকার ইমারতটিতে একটি গম্বুজ দেখা যায়। এ ছাড়াও ভবনের চারদিকে খিলান ছাদ বিশিষ্ট বারান্দা ঘিরে রয়েছে। সমাধিসৌধটির কেন্দ্রস্থলে চতুষ্কোণ কক্ষে রয়েছে তিন ধাপ বিশিষ্ট সমাধি। সমাধিটি শ্বেত পাথরে নির্মিত ও লতা পাতার নকশা অঙ্কিত। এ ছাড়াও কবর ফলক ও সমাধি লাগোয়া বারান্দায় বেশ কয়েকটি সাধারণ কবরও রয়েছে।
সমাধিসৌধটির পশ্চিম পাশে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ রয়েছে যার নির্মাণকাল সৌধটির সমসাময়িক। অর্থাৎ, ১৬৬৪-৮৮ সালের মধ্যে শায়েস্তা খান নির্মাণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়। সমাধিতে শায়িত বিবি মরিয়মের নামেই এটি বিবি মরিয়ম মসজিদ নামকরণ করা হয়েছে। পূর্ব দিকে নির্মাণ করা হয়েছে প্রহরীদের থাকার জায়গা। সমাধিসৌধে প্রবেশের জন্য উত্তর দিকে নির্মাণ করা হয়েছিল গেট। এই গেটটি দিয়েই একসময় হজীগঞ্জ কেল্লায় প্রবেশ করতে হতো। কিন্তু এখন গেটটি পরিত্যক্ত। এ ছাড়া, অঞ্চলটিতে নারী শিক্ষা উন্নয়নের জন্য বিবি মরিয়মের সমাধির পাশেই নির্মিত একটি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নাম বিবি মরিয়মের নামে নামকরণ করা হয়।
বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধটি ছাদ বিশিষ্ট বারান্দা দিয়ে ঘেরা বর্গাকার এক গম্বুজের। চতুর্দিকে পাঁচটি করে কারুকাজমণ্ডিত প্রবেশদ্বার। কেন্দ্রস্থলে তিন ধাপ বিশিষ্ট শ্বেত পাথরে নির্মিত ও লতা-পাতার নকশা অঙ্কিত সমাধি। লালবাগ কেল্লা প্রাঙ্গণে অবস্থিত পরী বিবির সমাধিসৌধের খাড়া আকৃতির গম্বুজ এবং অন্যান্য নির্মাণশৈলীর সাথে নারায়ণগঞ্জের বিবি মরিয়মের এই সমাধির নির্মাণশৈলীর সাদৃশ্য রয়েছে।
বিবি মরিয়মের সমাধির চারদিকের প্রাচীর ঘেঁষে স্থায়ীভাবে গড়ে উঠেছে বহু দোকানপাট। সন্ধ্যা হলেই সমাধিসৌধটি হয়ে পড়ে একটা ভুতুড়ে বাড়ির মতো, সমাধিসৌধটি ছাড়া এর আশপাশে কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। সমাধিসৌধসংলগ্ন মসজিদে লাইট থাকলেও পুরো সমাধিসৌধটির জায়গা থাকে অন্ধকারে। রক্ষণাবেক্ষণের লোক থাকলেও ঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে না এই প্রাচীন নিদর্শনটি।
বর্তমানে এটির নিয়ন্ত্রণ ও দেখভাল করছে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর, ঢাকা বিভাগ। কিন্তু প্রাচীনতম এই সমাধিসৌধটির কোনো সংস্কার হচ্ছে না বহুবছর ধরে। যার কারণে ঐতিহাসিক স্থাপনাটির প্রাচীরের পুরানো ইটগুলোও খসে পড়ছে, সেইসাথে সমাধিসৌধটিও। অনেক পুরনো স্থাপনা হওয়ায় সমাধিসৌধটির প্রাচীরসহ এর মূল স্থাপনাও শেওলায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
১৯৬৮ সালের পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনের চতুর্দ্দশ ধারার বলায় আছে, কোনো ব্যক্তি এই পুরাকীর্তির কোনো রকম ধ্বংস বা অনিষ্ট সাধন করলে বা এর কোনো বিকৃতি বা অঙ্গচ্ছেদ ঘটালে বা এর কোনো অংশের উপর কিছু লিখলে বা খোঁদাই করলে বা কোনো চিহ্ন বা দাগ কাটলে, তিনি সর্বাধিক এক বছর পর্যন্ত জেল বা জরিমানা অথবা এই উভয়প্রকার দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধটিতে যাদুঘর ও প্রতœতত্ত্ব বিভাগের লাগানো একটি বিজ্ঞপ্তি ছাড়া সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। দেখাশুনার অভাবে অযতেœ পড়ে আছে কালের সাক্ষী এ প্রতœতত্ত্ব নির্দশনটি।

 


আরো সংবাদ



premium cement