১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলকদ ১৪৪৫
`


বিস্তীর্ণ উপকূলে ঢুকে পড়েছে লবণাক্ততা

-

দীর্ঘমেয়াদি খরার প্রভাব

- সার্বিক উৎপাদন কমছে
- অসুস্থতা বাড়ছে
- জমি উর্বরতা হারাচ্ছে
- সবুজায়ন কমছে

দীর্ঘমেয়াদি খরার প্রভাবে উপকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঢুকে পড়েছে লবণ পানি। শুষ্ক মৌসুমে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ অনেক বেশি বাড়ে। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা অঞ্চলের নদীতে শুষ্ক মৌসুমে এখন লবণাক্ত পানির পরিমাণ অনেক বেশি। এই অঞ্চলের জেলে, মাঝি অথবা কৃষকদের কাছে জিজ্ঞাসা করলেই তারা বলছেন, তারা নদীর পানিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি লবণ অনুভব করছেন। লবণাক্ততা নদীর চার পাশে মাটিতে ঢুকে যেতে শুরু করেছে। এর ফলে সার্বিক কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, বনভূমি উজাড় হচ্ছে, সবুজায়ন বিলিন হয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে লবণ পানি মিঠা পানির সাথে মিশে যাওয়ায় মানুষ বাধ্য হচ্ছে, লবণ মিশ্রিত পানি পান করতে। ফলে এসব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বেড়ে চলেছে উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টের সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একজন মানুষের জন্য প্রতিদিন ৫ গ্রামের বেশি লবণ না খাওয়ার পরামর্শ দিলেও উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০০ গুণ বেশি লবণ খেতে বাধ্য হচ্ছেন বলে আইসিডিডিআরবি, লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে।
উজান থেকে মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীতে জোয়ারের সাথে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে পলি পড়া। ধীরে ধীরে নদীগুলোতে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে এক সময় যেখানে বড় লঞ্চ, ট্রলার চলাচল করত এখন সেখানে চর পড়ে গেছে। তাপপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় সার্বিক কৃষি উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। কারণ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সার্বিক তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকলে পরাগায়ণে বাধাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু তীব্র তাপপ্রবাহে খুলনা বিভাগীয় তাপমাত্রা এখন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে যাচ্ছে বলে ঠিকমতো পরাগায়ণ হচ্ছে না। ফলে এই অঞ্চলে বিশেষ করে ধানের ফলনে প্রভাব পড়ছে।

নয়া দিগন্তের খুলনা প্রতিনিধি মো: শাসুদ্দোহা খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, তীব্র তাপদাহ ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে গত ১০ বছরে খুলনা অঞ্চলে ১২১ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জমির ফসলসহ অন্যান্য মিলিয়ে ক্ষতি হয়েছে অর্ধ শতাধিক কোটি টাকা। খুলনা অঞ্চলে এক হাজার ১৮৭টি খাল ছিল, ৬১৫টি খাল ইতোমধ্যে ভরাট হয়ে গেছে। আরো অনেক খাল ভরাট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষিজমিতে এবং কমে যাচ্ছে উৎপাদন। অন্য দিকে খালগুলোতে কম-বেশি পানির প্রবাহ রয়েছে, সেগুলোতে স্লুইস গেট না থাকায় জমিতে লবণাক্ত পানি উঠে আসে। লবণাক্ত পানির কারণে খেতের ফসল মরে যায়। জানা গেছে, বর্তমানে খুলনা অঞ্চলে ৬৪৯টি স্লুইস গেট অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর গ্রামের কৃষক সাদেক আলী বলেন, ‘ধানে পানি দিতে পারছি না বলে ধানগাছ মরে যাচ্ছে। ডুমুরিয়া উপজেলার প্রায় সর্বত্রই পানির স্তর অন্তত ৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। টিউবওয়েলেও পানি ওঠে না, মেশিনেও পানি ওঠে না। খাল অথবা নালায় কোথাও পানি নেই। কৃষকরা খুবই দুশ্চিন্তায় আছে।

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি মুহাম্মদ জিল্লুর রহমান জানিয়েছেন, সাতক্ষীরা জেলায় কপোতাক্ষ, তেতনা, ইছামতি, খুলপেতুয়া, কালিন্দী, কাকশিয়ালী, মরিচপ নদীর পানিতে জোয়ারের সময় অনেক দূর পর্যন্ত লবণাক্ত পানি চলে আসে। জোয়ারের সময় লবণাক্ত পানি নদীর একটি জায়গায় গিয়ে আটকে থাকে উজানের মিঠা পানির চাপে। জোয়ার চলে গেলে সেখানে দেখা যায় নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে উঠেছে অর্থাৎ সেখানে কয়েক ইঞ্চি পলি পড়ে নদী ভরাট হয়ে চর জেগে যায়। তিনি বলেন, হিরণ পয়েন্টে এক সময় বনবিভাগ, কোস্ট গার্ডের জেটিতে বড় লঞ্চ ও ট্রলার নোঙর করত। কিন্তু ইদানীং দেখা গেছে, হিরণ পয়েন্টের জেটি থেকে এক থেকে দুই কিলোমিটার চর পড়ে গেছে।
নয়া দিগন্তের বরগুনা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বরগুনায় পায়না, বিষখালী ও বলেশ্বরের মতো নদীতে আগের তুলনায় এখন অনেক এলাকাজুড়ে লবণাক্ত পানি উঠে আসছে। জেলেদের উদ্ধৃত করে তিনি জানান, জেলেরা এখন আগের চেয়ে আরো উজানের পানিতে লবণ পাচ্ছেন।
আইসিডিডিআরবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজের গবেষকরা খুলনা জেলার দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় ১৮ মাস পর্যন্ত খাবার পানির লবণাক্ততা ও ওই অঞ্চলের মানুষের রক্তচাপ পরিমাপ করেছেন। দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা নিতে আসা এক হাজার ২০৮ গর্ভবতী মায়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা বলেছেন, এই অঞ্চলের বৃষ্টি, ফিল্টার, পুকুরের পানির চেয়ে নলকূপের পানিতে বেশি লবণ পাওয়া গেছে। এই পানির কারণে গর্ভবতী মায়েরা বেশি মাত্রায় উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন।
মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এসআরডিআই) হিসাব অনুযায়ী, উপকূলীয় অঞ্চলে মাঝারি থেকে খুবই তীব্র মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৮ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর (স্বল্পমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত জমিকে বাদ দিয়ে)। এসব জমিতে প্রতি বছর লবণাক্ততার কারণে শস্য উৎপাদন কম হচ্ছে হেক্টরপ্রতি গড়ে ৩.৪৮ টন। সব মিলিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলের জমিগুলো শুধু লবণাক্ততার কারণে ফলন হারাচ্ছে বছরে ৩০ লাখ ২৭ হাজার টনেরও বেশি। প্রতি কেজি শস্যের গড় মূল্য ৭৭ সেন্ট হিসাবে বছরে এ ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩৭ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় চার হাজার ৪২০ কোটি টাকা।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টি কম থাকে। উজান থেকে নেমে আসা পানিপ্রাবহ কমে যায়। উজান থেকে নেমে আসা পানির চাপ কম থাকলে সমুদ্র থেকে বেশি চাপে পানি উজানে উঠে আসে। শুধু যে জোয়ারের পানির চাপে লবণাক্ত পানি ওপরে উঠে আসছে তা নয়, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেও জোয়ারের পানি উজানে উঠে আসছে।

নদীর উজানে লবণাক্ত পানি উঠে আসার পেছনে মনুষ্য সৃষ্ট কিছু কারণ রয়েছে। তিনি বলেন, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা অঞ্চলে অনেক চিংড়ি ঘের গড়ে উঠেছে। চিংড়ি ঘেরের জন্য লবণাক্ত পানির প্রয়োজন। মালিকরা স্লুইস গেট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চিংড়ি ঘেরে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করিয়ে থাকে। মৎস্য ব্যবসায়ীরাই ঠিক করেন কখন পানি ঢুকবে, কখন বন্ধ হবে। এভাবে চিংড়ি ঘেরের আশপাশের ভূমিতেও লবণ পানি মিশে যাচ্ছে। ফলে এসব এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। ফলে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা অঞ্চলের হাজার হাজার একর চিংড়ি ঘেরের চার পাশে সবুজ বনানী নষ্ট হয়ে গেছে। এসব অঞ্চলে এখন আর ধান উৎপাদন হয় না। এ ছাড়া বড় ঘূর্ণিঝড় যেমন- সিডর, আইলার সময়ে যে লবণাক্ত পানি ঢুকেছিল বাগেরহাট, সাতক্ষীরা অঞ্চলে সে পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর দেখা গেছে, এসব অঞ্চলে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চির মতো পলি পড়ে গেছে। পরিবেশবিদ মেহেদী আহসান বলেন, উজানে লবণাক্ত পানি প্রবেশ অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ শিগগিরই মরু অঞ্চলে পরিণত হবে। এটা বন্ধে যতগুলো কারণ আছে সব কারণ খতিয়ে দেখতে হবে। উজান থেকে যেন মিঠা পানির প্রবাহ অব্যাহত থাকে সে জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। পদ্মা দিয়ে যে পরিমাণ পানি অতীতে আসত, এখন কেন তা বন্ধ হয়ে গেল এর কারণ বের করে এর সমাধানে চেষ্টা করতে হবে আমাদের প্রয়োজনেই। তিনি বলেন, আগামী দিনে রূপসা নদীর জোয়ারের লবণাক্ত পানি যশোর, নড়াইল, মাগুরা, কুষ্টিয়া পর্যন্ত চলে আসতে পারে। এর একটি রাজনৈতিক দিক আছে, তা রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, কিছু বিষয় আছে তা স্থানীয়ভাবেই নিরূপণ করতে হবে। প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারে ব্যবস্থা নিতে হবে। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের পরিমাণ বাড়িয়ে সবুজায়ন বাড়ানো যেতে পারে। অন্য দিকে প্রাকৃতিক জলাধারগুলো থেকে লবণাক্ত পানি সরিয়ে মিঠা পানিতে পরিবর্তিত করা যেতে পারে।

 


আরো সংবাদ



premium cement