২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ব্লাস্ট প্রতিরোধক গমের জাত উদ্ভাবনের দাবি বাকৃবি ও বিনার

বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে
-

ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধক গমের সম্ভাবনাময় একটি জাত উদ্ভাবনে সাফল্য অর্জনের দাবি করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) বিজ্ঞানীরা। আগামী বছর মাঠ পর্যায়ে চূড়ান্ত ফলাফল দেখে ২০২১ সাল নাগাদ ওই জাতটি চাষাবাদের জন্য কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়া হবে। ব্লাস্ট প্রতিরোধক জাত আবাদের মাধ্যমে দেশের গমের আমদানি হ্রাস ও বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে বলেও আশাবাদ বিজ্ঞানীদের।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. বাহাদুর মিয়া জানান, ২০১৬ সালে দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, বরিশাল, ভোলাসহ সাতটি জেলায় গমের ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এবং চাষিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর ধারাবাহিকতা ছিল বিগত তিন বছর। যদিও সরকারিভাবে ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধের জন্য অ্যাকশস প্ল্যান গ্রহণ এবং সাময়িকভাবে গমচাষ নিরুৎসাহিত করা হয়। ফলে দেশজুড়ে গমের আবাদ হ্রাস পায়। এ সঙ্কট উত্তরণের জন্য সরকার বিজ্ঞানীদের উপায় উদ্ভাবনের আহ্বান জানায়। পরে বাংলাদেশ রিসার্চ কাউন্সিল (বিআরসি) গমে ব্লাস্ট দমনের উদ্যোগ গ্রহণ ও একটি কমিটি গঠন করে।
কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. মো: বাহাদুর মিয়াকে প্রধান করে ‘গমে ব্লাস্ট রোগ দমন ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ নামে একটি গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করেন। ওই প্রকল্পে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে (বিনা) সম্পৃক্ত করা হয়। প্রফেসর বাহাদুর মিয়া জানান, বাকৃবি ও বিনা যৌথভাবে গম বীজে রেডিয়েশনের মাধ্যমে ব্লাস্ট প্রতিরোধক জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে গবেষণা শুরু করে। দুই বছর গবেষণার পর এখন তৃতীয় বছরে গবেষণায় সাফল্য অর্জিত হয়। এরই মধ্যে কিছু জাত পাওয়া গেছে; যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। আগামী বছর জাতগুলোকে চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পরের বছর (২০২১ সালে) ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধক গমের জাতটি চাষাবাদের জন্য কৃষকদের হাতে পৌঁছে দেয়া হবে। উদ্ভাবিত ব্লাস্ট প্রতিরোধক গমের জাত চাষ করে কৃষকেরা লাভবান হবেন। এতে গমের আবাদ বাড়বে। কমবে আমদানি এবং সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা।
ড. বাহাদুর আরো জানান, ধানের ব্লাস্ট ছত্রাকের সংক্রমণের সাথে গমের ব্লাস্ট ছত্রাকের মধ্যে কিছুটা মিল থাকায় প্রথমে মনে করা হয়েছিল যে ধান থেকেই হয়তো এটা গমে ছড়িয়েছে। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা যায় যে দু’টি জাতে দুই ধরনের ছত্রাক। একই প্রজাতির ছত্রাক হলেও গমের প্যাথোটাইপ ধানে এবং ধানের প্যাথোটাইপ গমে ব্লাস্ট রোগ সংঘটিত করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং যুক্তরাজ্যের সেইনসবারি ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ সিকোয়েনসিংয়ের মাধ্যমেও প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত গমের ব্লাস্ট রোগের জীবাণু ধানের ব্লাস্টের জীবাণু থেকে আলাদা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এবং গম গবেষণা কেন্দ্রের পরীক্ষায়ও দেখা গেছে যে, গমের ব্লাস্ট রোগের জীবাণু ধানের চারা গাছে এবং ধানের ব্লাস্ট রোগের জীবাণু গমের চারা গাছে রোগ সৃষ্টি করে না।
গবেষক দলের অন্য কৃষিবিজ্ঞানী বিনার উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আবুল কাশেম জানান, গমে ব্লাস্ট রোগের তীব্রতা কমানোর জন্য বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যেমন সিলিকন, সিলিয়াম, বোরন, ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়াম প্রয়োগ করে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে যে পুষ্টি উপাদানটি ভালো কাজ করে রোগ প্রতিরোধক ফসল দিবে; সেই জাতের ফসলটি আবারো দুই বছর মাঠপর্যায়ে চাষাবাদের মাধ্যমে গবেষণার পর যদি এটি ব্লাস্ট প্রতিরোধক জাত হিসেবে গণ্য হয়; তাহলেই ব্যাপকভাবে চাষের জন্য কৃষকদের হাতে তুলে দেয়া হবে। এ গবেষণা কার্যক্রম ময়মনসিংহে অবস্থিত বিনার গবেষণা মাঠ ও মেহেরপুর জেলার মদনাডাঙ্গাতে কৃষকদের মাঠে অত্যন্ত সর্তকতার সাথে চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ড. বাহাদুর মিয়ার মতে গম চাষ করতে হলে ব্লাস্ট রোগ কমাতে হবে। বর্তমানে দেশে গমের উৎপাদন হচ্ছে ১০ থেকে ১২ লাখ টন। দরকার ৬০ লাখ টন। ডায়াবেটিক রোগী বেড়ে যাওয়ায় গমের চাহিদাও বেড়ে গেছে। ধনীরাও এখন দুই বেলা আটার রুটি খাওয়া শুরু করেছেন। এ বছর সরকারকে ৩০-৪০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৬০ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়েছে। দেশের দশটি জেলায় যেভাবে গমের আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছিল ২০১৬ সালে ব্লাস্ট দেখা দেয়ার পর সেই উৎপাদন কমে গেছে। এখন যদি ব্লাস্ট প্রতিরোধক গমের জাত চাষিদের কাছে দেয়া যায় তাহলে চাষিরা আবারো গম চাষের দিকে ঝুঁকে পড়বে। কারণ গম চাষ সহজ, খরচ কম এবং লাভজনক।
বিনার মহাপরিচালক ড. হোসনেয়ারা বেগম জানান, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ২৩টি জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে রেডিয়েশন দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে ৪৩টি মিউটেন্ট পাওয়া গেছে। সেগুলো মাঠে লাগানো হয়েছে। এর মধ্যে একদিকে জাতটির সহনশীলতা দেখা হচ্ছে। অন্য দিকে জিন, সিলেলিয়াম, সিলিকন ও বোরন প্রয়োগ করে দেখা হচ্ছে কোনটির ফলাফল কী হয়। আমরা আশাবাদী যে এরই মধ্যে যেসব জার্মপ্লাজম পাওয়া গেছে এর মধ্যে ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাতের মিউট্যান্ট আছে। এসব জাত পাশাপাশি লাগানোর পর কয়েকটি মিউট্যান্টে কোনো রোগের লক্ষণ পাওয়া যায়নি। এতে বুঝা যাচ্ছে, ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের পাওয়া যাবে। তিনি আরো জানান, তিন বছরের গবেষণায় এখন জাত উন্নয়নের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। চলতি মওসুমে গবেষণা মাঠে ব্লাস্ট প্রতিরোধক গম চাষে প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জিত হয়েছে। আগামী দুয়েক বছরের মধ্যে ব্লাস্ট প্রতিরোধক গমের জাত উদ্ভাবন সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।
গবেষক দলে বিনার উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান ড. মো: আবুল কাসেম ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: ইমতিয়াজ উদ্দিন রয়েছেন। ওই প্রকল্পে দুইজন পিএইচডি ও দশজন এমএস শিক্ষার্থী গবেষণা নিয়োজিত রয়েছেন।
ছত্রাকঘটিত এই রোগ অতি দ্রুত এক ক্ষেত থেকে অন্য ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রতিকারের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ছত্রাকনাশক এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে রোগ বা আটকাতে যেসব এলাকায় ছত্রাকের সংক্রমণ দেখা যায়, তা আগুন জ্বালিয়ে নষ্ট করে দেয়া হয়; যাতে অন্য এলাকা সংক্রমণ না হয়। ছত্রাকের প্রজাতি ও ক্ষেত ভেদে ব্লাস্ট সংক্রমণে ক্ষয়ক্ষতি ভিন্ন ভিন্ন হয়। গড়ে ক্ষেতের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ গমের ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেতে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত গমের ক্ষতির নজির আছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement