২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলাদেশে বাড়ছে আত্মহত্যা

একদিনে মারা যায় ২৮ জন
-

সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক কারণে বাংলাদেশে বেড়ে যাচ্ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। শহরের চেয়ে গ্রামে আত্মহত্যার প্রবণতা ১৭ গুণ বেশি। আবার পুরুষের চেয়ে মহিলাদের মধ্যে এ প্রবণতা অনেক বেশি। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার পেছনে যেসব কারণ দায়ী এসব চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে না পারলে এ প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। গ্রামে যারা আত্মহত্যা করে তাদের বেশির ভাগ অশিক্ষিত ও দরিদ্র। আত্মহত্যায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপুর্ণ ১০ থেকে ১৯ বছরের বয়সী মেয়েরা।
স্বাস্থ্যসম্পর্কিত আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নাল ল্যানচেটের গবেষণা অনুসারে বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। কারণ এখানে নারীদের সামাজিক মর্যাদা কম। ল্যানচেট আরেকটি কারণ বলেছে আত্মহত্যার। তা হলোÑ বাংলাদেশে অশিক্ষিতের উচ্চ হার এবং নারীরা অর্থনৈতিকভাবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঝুনু শামসুন্নাহার জানান, মানসিক রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। ব্যক্তিত্বের সমস্যা, মাদকাসক্তি, সারাক্ষণ যারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভোগে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। এদের মধ্যে আশাহীনতার সৃষ্টি হয়ে থাকে তীব্রভাবে। দুনিয়ার সবকিছু তারা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যেতে থাকলে এক সময় মুক্তির উপায় হিসেবে নিজেকে শেষ করে দেয় নিজের জীবন নিজের হাতে নিয়ে। তিনি বলেন, অর্থনীতিতে মন্দাভাব দেখা দিলেও আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডোলোসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রির সহযোগী অধ্যাপক ডা: হেলাল উদ্দিন আহমেদ জানান, বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতনে, দাম্পত্য কলহে, সম্পর্কের জটিলতার (পারিবারিক/ প্রেম/বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক) কারণে। উত্ত্যক্তকরণ ও প্ররোচিত করার কারণেও আত্মহত্যা হয়ে থাকে এখানে। এ ছাড়া অনাকাক্সিত গর্ভধারণ, লোকলজ্জার ভয়েও এ ঘটনা ঘটে থাকে। এর বাইরে রয়েছে প্রেম ও পরীক্ষায় ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক সঙ্কট (দারিদ্র্য ও বেকারত্ব) এবং আত্মহত্যার উপকরণের সহজলভ্যতা। কিছু শারীরিক অসুস্থতার কারণেও আত্মহত্যা হয়ে থাকে। এগুলো হলো- বিষণœতা, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়া। বাংলাদেশে ১৬.১০ শতাংশ পরিণত বয়সের নারী-পুরুষ এবং ১৮ শতাংশ শিশু মানসিক রোগে ভুগছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যাকে বাংলাদেশের দণ্ডবিধিতে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কেউ আত্মহত্যা করতে চেয়েছে এমনটি প্রমাণ করতে পারলে দণ্ডবিধির ৩০৯ নম্বর ধারায় এক বছরের কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। আইনটি সম্বন্ধে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে এরাতো নয়ই, যারা আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজটি করেন তাদের অনেকেই জানেন না।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য এবং নিয়ন্ত্রণও করা যায়। সংস্থাটি আত্মহত্যা প্রতিরোধে কয়েকটি সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো- কীটনাশক (বিষ), আগ্নেয়াস্ত্র এবং কিছু ওষুধ প্রাপ্তিতে কড়াকড়ি আরোপ করা, মাদক ব্যবহার নীতি কঠোর করা, মানসিক বিষাদগ্রস্ত রোগ, ক্রনিক পেইন (দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা) ইত্যাদি সমস্যায় আগে-ভাগেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, বিশেষজ্ঞ ছাড়াও অন্যান্য শ্রেণীর মানুষকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে যেন তারা আত্মহত্যা প্রবণতা কমিয়ে আনার ব্যবস্থাপনা ও কৌশল রপ্ত করতে পারে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশে গড়ে দৈনিক ২৮ জন আত্মহত্যা করে। বেশির ভাগ ২১ থেকে ৩০ বছরের নারী। এ ছাড়া বাংলাদেশে ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে আছে। এদের বেশির ভাগই অল্প বয়সী এবং ৮৯ শতাংশই নারী। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ৭.৮ জন আত্মহত্যা করে থাকে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুযায়ী বছরে ১০ হাজার মানুষ বিষ খেয়ে অথবা ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করছে।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ নামক প্রতিষ্ঠানটির রিপোর্ট অনুসারে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেছে। প্রতি লাখে ৭.৩ জন আত্মহত্যা করছে। বয়স, লিঙ্গ, পেশা এবং ভৌগোলিক অবস্থানভেদে ৮ লাখ ১৯ হাজার ৪২৯ জনের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে তারা এ তথ্য পেয়েছেন। ২০১৭ সালের পুলিশ প্রতিবেদন অনুসারে দেশে ১১ হাজার ৯৫ জন আত্মহত্যা করে। পুলিশের রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশে দৈনিক তিনজন আত্মহত্যা করেছে ২০১৭ সালে। রিপোর্ট বলছে, প্রতি বছরই বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার বাড়ছে। এ দেশে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা হয় বিষ (কীটনাশক জাতীয়) পানে। ২০১৭ সালে বিষপানে আত্মহত্যার এ সংখ্যাটা ছিল তিন হাজার ৪৬৭টি। এরপরই রয়েছে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যার হার। ওই বছর ৫৬৯টি এ ধরনের ঘটনা ঘটে।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০১৬ সালে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্য ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর কারণ। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে বিশে^ যত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে এর ৭৯ শতাংশ নি¤œ ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে হয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement