২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সমস্যায় জর্জরিত দেশের চা শিল্প

-

চায়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সব কিছুই একটু বেশি বেশি। দেশে চায়ের উৎপাদন প্রতি বছরই বাড়ছে। আবার বছর বছর বাড়ছে চা আমদানির পরিমাণও। অথচ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চায়ের দাম। অভ্যন্তরীণ চাহিদা তথা দেশে চায়ের ব্যবহার বাড়ছে, কিন্তু কমছে কেবল রফতানি। রফতানি পণ্য হিসেবে এক সময় পাটের পরেই ছিল চায়ের অবস্থান। আর চা এখন যে পরিমাণ রফতানি হয়, আমদানি হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। দেশের ঐতিহ্যবাহী ও সম্ভাবনাময় চা শিল্প এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। বিনিয়োগের অভাবে বিরাণভূমি হতে চলেছে অনেক চা বাগান। ব্যাহত হচ্ছে নতুন এলাকায় চা চাষের উদ্যোগও। অতি রোদ আর অতি বৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক সঙ্কটের মুখে পড়ছে বিদ্যমান চা বাগানগুলো। রয়েছে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির সমস্যা ও আরো অনেক জটিলতা।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দুই বছর ধরে উৎপাদন মওসুমে অতিবৃষ্টি, মেঘে ঢাকা আকাশ ও সূর্যের আলো স্বল্পতাসহ নানারকম বৈরী আবহাওয়ায় দেশের চা বাগানগুলোতে স্বাভাবিক উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে চা গাছে রোগবালাইয়ের তীব্রতাও মারাত্মকভাবে বেড়েছে। এ ছাড়া চা শিল্প বিনিয়োগের অভাবে তীব্র আর্থিক সঙ্কটের সম্মুখীন। বিদ্যমান ব্যাংক ঋণের সুদের হার উচ্চ হওয়ায় বিনিয়োগের জন্য ঋণের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা উৎপাদনকারীদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চা বাগানের জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ এবং চা কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সমস্যা এ শিল্পের উন্নয়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এ বছরও আশানুরূপ উৎপাদন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন এ শিল্পের সাথে জড়িতরা।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, ১৯৮২ সালে এ দেশ থেকে চা রফতানি হয় তিন কোটি ৪৪ লাখ কেজি। তিন যুগের ব্যবধানে রফতানি অস্বাভাবিক কমে এখন তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৫ লাখ কেজিতে। ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ কেবলই রফতানিকারক দেশ ছিল। এখন আমরা একাধারে বড় ধরনের চা আমদানিকারক এবং ছোট আকারের রফতানিকারক। গত বছর বাংলাদেশ থেকে চা রফতানি হয় ২৫ লাখ কেজি। এর বিপরীতে আমদানি হয় ৬২ লাখ কেজি। অর্থাৎ রফতানির চেয়ে আমদানি হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। চা রফতানির বিশ্ববাজারে পঞ্চম অবস্থান থেকে পেছাতে পেছাতে বাংলাদেশ এখন ৭৭তম।
চা গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, প্রয়োজনীয় সূর্যের আলোর অভাবে এবার চা গাছের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে মাটির আর্দ্রতা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় চা গাছের দৈহিক পুষ্টি সঞ্চালন ক্ষমতা ব্যাহত হচ্ছে। এতে চা গাছে লাল মাকড়শা, মশা এবং পাতার রস শোষণকারী কীটপতঙ্গের আক্রমণ বেড়েছে। দেখা দিয়েছে ‘লিফ রাস্ট’ নামক ভয়াবহ রোগ। বিস্তৃত এলাকায় এ রোগের প্রাদুর্ভাবের ফলে চা গাছের নতুন কুঁড়ি গজানোর সাথে সাথে তা শুকিয়ে, পাতা কালো রঙ ধারণ করছে। চা বাগানে এমন রোগ দেখা দেয়ায় শ্রমিক, কর্মকর্তা-কমর্চারী ও মালিকপক্ষ হতাশ হয়ে পড়েছেন। তারা জানান, ভরা মওসুমে যখন প্রতিদিন হাজার হাজার কেজি চা পাতা উত্তোলন করার কথা, সেখানে উৎপাদন নেমে এসেছে চার ভাগের এক ভাগে। গত ছয় মাসে চা আহরণ মারাত্মকভাবে কমে গেছে ২০১৬ সালের প্রথম ছয় মাসে যেখানে দুই কোটি ২৭ লাখ কেজি চা পাতা আহরিত হয়েছিল সেখানে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে আহরিত হয় মাত্র এক কোটি ৩০ লাখ কেজি। গত বছরের একই সময়ে আহরিত হয়েছিল এক কোটি ৯৬ লাখ কেজি।
ব্যবসায়ীরা জানান, চায়ের ভালো দিন ছিল ২০১০ সাল পর্যন্ত। তার পর থেকে প্রতি বছরই দেশে চায়ের উৎপাদন কম হচ্ছে। আমদানি শুরু হয় তখন থেকেই। গত আট বছরে দেশে মোট চা আমদানি হয় পাঁচ কোটি ৯৫ লাখ কেজি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছিল ২০১৫ সালে, ১ কোটি ৫৮ লাখ কেজি। ২০১৬ সালে ৮৭ লাখ কেজি এবং ২০১৭ সালে ৬২ লাখ কেজি চা আমদানি হয়। গত ১০ বছরে দেশে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে দুই কোটি কেজি, স্বাধীনতার পর থেকে বেড়েছে আট কোটি কেজি। অর্থাৎ বছরে গড়ে উৎপাদন বাড়ছে সাড়ে ৩ শতাংশ হারে। একই সময়ে চায়ের চাহিদা বেড়েছে তিন কোটি ৩৮ লাখ কেজি। বছরে চাহিদা বাড়ছে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে।
প্রথম চা গাছ রোপণ থেকে ধরলে বাংলাদেশে চা শিল্পের বয়স ১৯০ বছর। এই অঞ্চলে প্রথম চা বাগান করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ১৮২৮ সালে। অবিভক্ত ভারতে চট্টগ্রামের কোদালায় তখনই জমি নেয়া হয়। বর্তমানে যে স্থানটিতে রয়েছে চট্টগ্রাম ক্লাব, ১৮৪০ সালে সেখানেই পরীক্ষামূলকভাবে রোপণ করা হয় প্রথম চা গাছ। তবে চায়ের প্রথম বাণিজ্যিক আবাদ শুরু হয় সিলেটে ১৮৫৪ সালে। সে বছর সিলেট শহরের উপকণ্ঠে মালনিছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬০ সালে হবিগঞ্জের লালচান্দ চা বাগান ও মৌলভীবাজারের মির্তিঙ্গা চা বাগানে চায়ের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়। ২০০০ সালে উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়েও ছোট পরিসরে চায়ের চাষ শুরু হয়। ২০০৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামেও শুরু হয় চায়ের চাষ। সারা বাংলাদেশে বর্তমানে ১৬২টি বাগানে ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদিত হচ্ছে চা। সমগ্র বাংলাদেশে চা আবাদের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলায় চাষযোগ্য জমি চিহ্নিত করা হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement