২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

১২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকার বিকল্প বাজেট প্রস্তাব অর্থনীতি সমিতির

বর্তমানে দেশ থেকে ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে; দেশে পুঞ্জীভূত কালো টাকার পরিমাণ ৫-৭ লাখ কোটি টাকা
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সংবাদ সম্মেলন : নয়া দিগন্ত -

আগামী অর্থবছরের জন্য ১২ লাখ ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি বিকল্প বাজেট প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। এই বাজেট প্রস্তাবটি চলতি অর্থবছরেরর বাজেটের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। চলতি অর্থবছরে বাজেটের আকার চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের যে বাজেট আগামী ৭ জুন দিতে যাচ্ছেন সেটিরও সম্ভাব্য আকার নির্ধারণ করা হয়েছে চার লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতি সমিতি মনে করছে, দেশ থেকে বর্তমানে ৭০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। এই পাচার থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা আটকানো সম্ভব হলে তা বাজেটে ব্যবহার করা সম্ভব। দেশে পুঞ্জীভূত কালো টাকার পরিমাণ পাঁচ থেকে সাত লাখ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করেছে অর্থনীতি সমিতি। সমিতি আরো বলেছে, দেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা এক কোটি ৭৫ লাখ।
গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বাজেট প্রস্তাবনা ২০১৮-১৯’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ বিকল্প বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। প্রস্তাবটি তুলে ধরেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। সংবাদ সম্মেলনে সূচনা বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ।
লিখিত বক্তব্যে সরকারপন্থী হিসেবে চিহ্নিত অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বলেন, প্রস্তাবিত ১২ লাখ ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বিকল্প বাজেটের অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় হবে পাঁচ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন খাতে যাবে ছয় লাখ ৬৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব আয় থেকে আসবে ৯ লাখ ৯০ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। টাকা কোথা থেকে আসবে এই প্রশ্নের জবাবে বারকাত বলেন, দেশে এক কোটি টাকা কর দিতে পারেন এমন মানুষের সংখ্যা রয়েছে ৫০ হাজার। এদের কাছ থেকে যদি কর আদায় করা সম্ভব হয় তবে বছরে তাদের কাছ থেকেই আয়কর আসবে ৫০ হাজার কোটি টাকা।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বারকাত বলেন, দেশে ধনী-দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য বড় দুর্ভাবনার বিষয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একশ্রেণীর ‘রেন্ট সেকার’ হাতে অবৈধ সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। এ কারণে বেড়ে যাচ্ছে বৈষম্য। তিনি বলেন, দরিদ্র্র মানুষের ৮২ শতাংশ গ্রামে বাস করে। গ্রামে ৬০ শতাংশ ভূমিহীন, ৪০ ভাগ খানায় বিদ্যু সংযোগ নেই, ৬০ ভাগ মানুষ সরাকারি স্বাস্থ্যসেবা থেকে কার্যত বঞ্চিত। ১০ শতাংশ ধনী মোট সম্পদের প্রায় ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রয়ক।
আবুল বারকাত বলেন, দেশে এখন ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে। বাজেটে এ সমস্যা সমাধানে পদ্ধতিগত নির্দেশনা থাকতে হবে। আমরা অর্থপাচার রোধ থেকে আগামী অর্থবছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের প্রস্তাব করছি।
একই সাথে তিনি বলেন, দেশে পুঞ্জীভূত কালো টাকার আনুমানিক পরিমাণ হবে পাঁচ থেকে সাত লাখ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতে কালো টাকা দেশের মোট জিডিপির ৪২-৮০ শতাংশ। এটাকে কমানোর জন্য সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে পারে, অন্য দিকে একটি কার্যকর কমিশন গঠন করতে পারে। আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে ২৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ কালো টাকা উদ্ধারের প্রস্তাব করছি।
যদিও কী পদ্ধতিতে এই টাকা উদ্ধার করা হবে সেটা স্পষ্ট করেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রাষ্ট্র্রীয় জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. বারকাত।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ২০১৬ সালে মৌলবাদের অর্থনীতির নিট মুনাফা তিন হাজার ১১২ কোটি টাকা, দেশের মূল অর্থনীতির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ থেকে ৭ শতাংশ হলেও মৌলবাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে তা ৯ থেকে ১০ শতাংশ। গত ৪০ বছরে দেশে মৌলবাদের অর্থনীতির নিট মুনাফা দুই লাখ কোটি টাকারও বেশি।’
তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ বলা হলেও দেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা এক কোটি ৭৫ লাখ।’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল অসংক্রামক রোগের বিস্তৃতি বৃদ্ধির কারণে প্রতি বছর ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। তাই প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে আবুল বারকাত বলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৪-১৫ হাজার কোটি কালো টাকা সাদা করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকার পেয়েছে মাত্র আট হাজার কোটি টাকার মতো। অথচ বাংলাদেশে কালো টাকার পারিমাণ জিডিপির ৮২-৮৩ শতাংশ। সে হিসাবে এটা ১৫ লাখ কোটি টাকারও বেশি। ফলে কালো টাকা থেকে সাত লাখ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আনা সম্ভব।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে বড়জোর ১০০ জন ব্যক্তি বছরে এক কোটি টাকা অথবা তার বেশি ব্যক্তিগতপর্যায়ে কর দেন। বাস্তবে এই সংখ্যা হওয়ার কথা কমপক্ষে ৫০ হাজার; যেখান থেকে বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করা সম্ভব।
রাজস্ব আয়ের প্রধান খাতগুলো সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, খাতগুলো হবে আয় ও মুনাফার ওপর কর, মূল্য সংযোজন কর, লভ্যাংশ ও মুনাফা, জরিমানা-দণ্ড, বাজেয়াপ্তকরণ, সম্পূরক কর, লভ্যাংশ ও মুনাফা, অর্থপাচার রোধ থেকে প্রাপ্তি, কর ব্যতীত অন্যান্য রাজস্ব ও প্রাপ্তি, কালো টাকা উদ্ধার থেকে প্রাপ্তি, সম্পদ কর, যানবাহন কর, মাদক শুল্ক ও ভূমি রাজস্ব।
বাজেটে বরাদ্দের খাত : শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে সবচেয়ে বেশি ব্যয়, এরপর বিদ্যু ও জ্বালানি, জনপ্রশাসন, পরিবহন ও যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ, কৃষি, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিস, গৃহায়ন।
সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেনÑ আপনাদের এখানের কেউ অর্থমন্ত্রী হলে এ প্রস্তাবিত বাজেট পাস করতেন কি না? এর জবাবে আবুল বারকাত বলেন, আমি ওই জিনিস (অর্থমন্ত্রী) হবো না। আমাদের এখান থেকে কেউ যদি অর্থমন্ত্রী হয় এ বাজেট পাস করত।
আবুল বারকাত বলেন, উন্নয়নপ্রক্রিয়াটি হতে হবে প্রবৃদ্ধির সাথে বণ্টন ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণের, দ্রুত বৈষম্য হ্রাসকরণের, মানবসম্পদ দ্রুত বিকশিতকরণের, শিল্পায়ন ত্বরান্নয়ন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগসহ (এসএমই) আত্মকর্মসংস্থান বিকশিতকরণের এবং সর্বোপরি সমগ্র প্রক্রিয়ায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের।
রাজস্ব বাড়াতে রাজস্ব কমিশন গঠনের প্রস্তাবও দেন ড. আবুল বারকাত। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের বাজেট তৈরি করা হয় সব মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে এবং অর্থ বিভাগ তা চূড়ান্ত করে। এ ব্যবস্থায় সৃজনশীল চিন্তার সুযোগ কম। এ ক্ষেত্রে শুধু মেকানিক্যাল অর্থাৎ শতকরা হার বৃদ্ধি অথবা ব্যবহার করা হয়। এতে সমস্যার দোরগোড়ায় পৌঁছানো যায় না এবং বাজেট বাস্তবসম্মত হয় না। এ অবস্থা নিরসনে আমরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি রাজস্ব কমিশন গঠনের প্রস্তাব করছি, যারা বাজেট কিভাবে যুগপোযোগী করা যায় এ নিয়ে কাজ করবে।
তিনি বলেন, সরকারি অর্থ যারা নাড়াচাড়া করে তারা এ অর্থ না খেয়ে থাকতে পারে না। এসএমই মন্ত্রণালয় গঠন ও প্রবীণ নীড় গঠনের প্রস্তাব করছি।

 


আরো সংবাদ



premium cement