২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


মালয়েশিয়া থেকে বেশির ভাগ রেমিট্যান্স আসছে হুন্ডিতে

-

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী রেমিট্যান্স এখন গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। প্রথম দিকে এটিকে হালকাভাবে নিলেও এখন রেমিট্যান্স ছাড়া জিডিপির প্রবৃদ্ধি কল্পনার বাইরে। প্রতি বছরই রেমিট্যান্স প্রবাহের রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। এটি যেমন নিঃসন্দেহে দেশের জন্য সুখকর তেমনি অশুভ ছায়ার প্রভাবও রয়েছে। প্রবাসীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে নায়কের ভূমিকায় থাকলেও খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বৈধ চ্যানেলে ৩৫ ভাগ রেমিট্যান্স এলেও অবৈধ বা হুন্ডির মাধ্যমে আসছে ৬৫ ভাগ।
বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর ধারণা ৪১ শতাংশ রেমিট্যান্স আসছে হুন্ডির মাধ্যমে। কিন্তু রেমিট্যান্স বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সংখ্যা আরো বেশি।
এতে সরকার যেমন রেমিট্যান্স প্রবাহের সঠিক পরিসংখ্যান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি একজন প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধা ও প্রাপ্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। দেশটিতে চাকরি, ব্যবসা, স্থায়ীভাবে বসবাস বা মাই সেকেন্ড হোমসহ যেসব অনুকূল সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, যা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নেই বাংলাদেশীদের জন্য। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে বড় ভূমিকা রাখছে এসব মালয়েশিয়া প্রবাসী।
কিন্তু প্রবাসীরা বৈধ পন্থায় অর্থ না পাঠিয়ে কেন হুন্ডির আশ্রয় নিচ্ছেন? এই অবৈধ কালো পথ থেকে প্রবাসীদের ফেরানোর উপায় কী? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এ প্রতিবেদক কুয়ালালামপুরের ব্যাংক, মানিট্রান্সফার, মানি এক্সচেঞ্জ, রেমিট্যান্স হাউজে প্রায় এক মাস সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ করেছেন। রেমিট্যান্স সংশ্লিষ্ট সেন্টারগুলোতে গিয়ে প্রবাসীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে কিছু চমকপ্রদ তথ্য। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা ঘরে বসে আবার কিছু কিছু এলাকায় প্রকাশ্যে অফিস খুলে নির্বিঘেœ ব্যবসা করছে। শহরের আনাচে কানাচে হাতের নাগালেই রয়েছে হুন্ডি চক্র। হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিষয়ে মালয়েশিয়ার সরকারের যেমন কোনো অভিযান নেই, তেমনি করে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে কোনো দৃশ্যমান সচেতনতামূলক উদ্যোগ কখনো চোখে পড়েনি। বেশির ভাগ প্রবাসী ভালো করে জানেনই না বৈধভাবে টাকা পাঠালে কী লাভ আর হুন্ডিতে টাকা পাঠালে কী ক্ষতি। তাদের সচেতন না করা গেলে হুন্ডির কালো পথ থেকে ফেরানো সম্ভব নয়। বৈধপথে পাঠানো টাকার রেট থেকে হুন্ডিতে পাঠানো টাকার রেট সবসময় ১২ টাকা বেশি প্রদান করে প্রবাসীদের প্রলুব্ধ করা হয়। সহজ সরল প্রবাসীরা নগদ লাভটা আগে দেখে পেছনে কী কী সুবিধা সরকারের পক্ষ থেকে পাওয়া যাবে সে চিন্তা করে না।
তা ছাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে বৈধভাবে টাকা পাঠানোর কিছু জটিলতার চেয়ে হুন্ডিতে টাকা পাঠানো খুবই সহজ। ব্যাংকে গিয়ে নির্দিষ্ট ডকুমেন্টসসহ যাবতীয় তথ্য পূরণ করতে হয়। হুন্ডিতে ঘরে বসেই যেকোনো মোবাইলের মাধ্যমে মুহূর্তেই টাকা পাঠাতে পারছে। লেনদেন করা হচ্ছে অনলাইন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। তাই এর কোনো রেকর্ড না থাকায় সঠিক পরিসংখ্যানও কারো জানা নেই।


ছুটির দিনে কুয়ালালামপুরের কোতারায়া ও বুকিত বিনতাংয়ের বাংলাদেশী মার্কেটে একটু বেশি ভিড় থাকে। প্রবাসীরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে কেনাকাটা ও টাকা পাঠাতে আসেন। একটি মানি ট্রান্সফার সেন্টারের সামনে কুমিল্লার প্রবাসী মো: রফিকুল হাসান তার দুই সহকর্মীকে নিয়ে এসেছেন দেশে টাকা পাঠাতে। মোবাইল ফোনে অপরপ্রান্তে বলছে আজ ব্যাংকের রেট ১ রিংগিত সমান বাংলাদেশী ২৪ টাকা ২০ পয়সা চলছে, হুন্ডিতে পাঠালে কত রেট দেবেন? অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর এলো ২৬ টাকা ১০ পয়সা। তখন আমি হুন্ডির কথা শুনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। হুন্ডি তো অবৈধ। ব্যাংকে টাকা পাঠাচ্ছেন না কেন? ব্যাংকে পাঠালে তো প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ঋণ সুবিধা, ওয়েজ আনার্স বোর্ড থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ পাঠানো টাকার বৈধতা পাওয়া যায়। রফিকুল হাসান বললেন, আমাদের টাকা হুন্ডিতে পাঠালে নগদ লাভ পেয়ে থাকি, আর ব্যাংকে পাঠাতে বিভিন্ন ডকুমেন্টস ও সময় লাগে। তিনি আরো বলেন, আমি এখন মারা গেলে চাঁদা তুলে আমার দেশে পাঠাতে হবে, সকসো, ইন্স্যুরেন্স, এসবের সহযোগিতা পেতে হয়রানি হওয়া লাগে, আর শর্তের বেড়াজালে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ঋণ কেউ পায় না। তা ছাড়া ওয়েজ আনার্স বোর্ড থেকে বিভিন্ন সুবিধা পাওয়া দুরূহ। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রবাসীরা সহজে সুবিধা পান না, তাই আমরা এসব আশা করি না।
মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বৈধভাবে দেশে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক অগ্রণী ব্যাংকের ‘অগ্রণী রেমিট্যান্স হাউজ’। তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে প্রবাসীদের বৈধভাবে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত করে থাকে। মালয়েশিয়ায় সারা দেশে অগ্রণী রেমিট্যান্স হাউজের ছয়টি ব্র্যাঞ্চ রয়েছে। মালয়েশিয়া অগ্রণী রেমিট্যান্স হাউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও পরিচালক মো: খালেদ মোর্শেদ রিজভী দীর্ঘ ৯ বছর ধরে রেমিট্যান্স নিয়ে কাজ করছেন। হুন্ডির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণ প্রবাসীরা নগদ লাভকে আগে দেখেন, অবৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠিয়ে কী ক্ষতি হচ্ছে- এ বিষয়ে তারা অজ্ঞ, বৈধ চ্যানেলে অর্থ প্রেরণে দেশের কী মঙ্গল হচ্ছে তারা তা বোঝেন না, এটি আসলে অসচেতনতার অভাব, হুন্ডি আগেও ছিল এখনো আছে। তিনি আরো বলেন, আমার ৯ বছর প্রবাস জীবনে অভিজ্ঞতা থেকে একটি জরিপে আমি যে তথ্য পেয়েছি সেটি হলো ৩৫ ভাগ রেমিট্যান্স বৈধ চ্যানেলে পাঠানো হয় আর বাকি ৬৫ ভাগই হুন্ডি ও বিকাশে পাঠানো হয়, আমরা সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করে সুপারিশ করেছি প্রবাসীদের প্রণোদনা শতকরা আড়াই ভাগ থেকে বাড়িয়ে ৫ ভাগ করার জন্য, তা হলে প্রবাসীরা ব্যাংকমুখী হবে ওই দিকে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা আর কোনো সুবিধা করতে পারবে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement