০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ডায়াবেটিস যেভাবে দৃষ্টি কেড়ে নেয়

-


ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি চোখের তথা রেটিনার সূক্ষ্ম রক্তনালীর এক ধরনের প্রদাহ বা সমস্যা বলা যেতে পারে। রক্তে উচ্চ মাত্রার গ্লুকোজ বা সুগারের কারণে সূক্ষ্ম রক্তনালীতে এই সমস্যাটি দেখা দেয়। চোখ ছাড়াও যে সমস্ত অঙ্গে সূক্ষ্ম রক্তনালী বিদ্যমান যেমন মস্তিষ্ক, হার্ট এবং কিডনি এগুলোতেও একই ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ডায়াবেটিসে রক্তনালীতে যে সমস্যা সৃষ্টি করে
রক্তে উচ্চ মাত্রার সুগার রক্তনালীর জন্য খুবই ক্ষতিকর। স্বাভাবিক অবস্থা হলো খাবার থেকে যে সুগার দেহে প্রবেশ করে তা রক্তনালীর মাধ্যমে দেহের আনাচে-কানাচে পৌঁছে যায় এবং রক্তনালী থেকে নির্গত হয়ে কোষে প্রবেশ করে। কোষে প্রবেশে ইনসুলিন নামক হরমোনের সহায়তার প্রয়োজন হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের বেলায় এই ইনসুলিন স্বল্পতার জন্য সুগার দেহের কোষে প্রবেশ করতে পারে না বিধায় রক্তনালীতেই থেকে যায় । দীর্ঘদিন এই অবস্থা চলতে থাকলে রক্তনালীর গায়ে এক ধরনের পরিবর্তন দেখা দেয়। সূক্ষ্ম নালীগুলো দুর্বল ও সরু হয়ে রক্তসঞ্চালনে অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এতে কোষে অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দেয়। কোষে অক্সিজেন স্বল্পতার এই অবস্থাকে বলা হয় ইস্কেমিয়া। কোষে অক্সিজেন স্বল্পতা বা ইস্কেমিয়ার দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে-
প্রথমত, অক্সিজেন বঞ্চিত কোষগুলো ক্রমান্বয়ে নিস্তেজ হয়ে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, অক্সিজেন বঞ্চনা থেকে কোষকে রক্ষার বিকল্প হিসেবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন রক্তনালী তৈরি হতে পারে। এটি দেহে বিদ্যমান একটি প্রাকৃতিক পদ্বতি। উদ্দেশ্য অতিরিক্ত রক্তনালীর সাহায্যে অতিরিক্ত রক্তসঞ্চালনের মাধ্যমে অক্সিজেন ঘাটতি পূরণ করা। দুর্ভাগ্য হলো এই রক্তনালীগুলো সর্বদা অপরিপক্ব ও ভঙ্গুর। ফলে খুব সহজেই এগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে।
দীর্ঘমেয়াদে ইস্কেমিয়া বা অক্সিজেন স্বল্পতার প্রভাবে রক্তনালীর গায়ে যে ক্ষত ও ভঙ্গুর অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং এর পরিণতিতে রক্তক্ষরণসহ অন্যান্য বিরাজমান অবস্থাটিকে বলা হয় রেটিনোপ্যাথি। ডায়াবেটিসজনিত কারণে বিধায় এটিকে বলা হয় ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। অন্যান্য অনেক কারণ আছে যাতে রেটিনোপ্যাথি হতে পারে।
রিস্ক ফেক্টর : ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর মাঝে যে সব আনুষঙ্গিক অবস্থা বিদ্যমান থাকলে রেটিনোপ্যাথির ঝুঁকি বেড়ে যায় সেগুলোকে বলা হয় রিস্ক ফেক্টর। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির বেশ কিছু রিস্ক ফেক্টর রয়েছে যেগুলো জানা থাকলে অনেক সময় রেটিনোপ্যাথি পরিহার করা সম্ভব।
ডায়াবেটিসের মেয়াদ : মেয়াদ বলতে কত দিন যাবৎ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত সেটিকে বোঝায়। যাদের ডায়াবেটিস ৩০ বছর বয়সের আগেই শনাক্ত হয় অর্থাৎ টাইপ-১ ডায়াবেটিস তাদের বেলায় ১০ বছর মেয়াদে ৫০ শতাংশ এবং ৩০ বছর মেয়াদে ৯০ শতাংশ রেটিনোপ্যাথির সম্ভাবনা। পরিমাপক হিসাবে ঐনঅ১প বেশ কার্যকর। হিমোগ্লোবিন এ ওয়ান সি ৬-৭ এর মধ্যে রাখতে পারলে সর্বাধিক ফললাভের সম্ভাবনা থাকে।
উচ্চ রক্তচাপ : রেটিনোপ্যাথিকে ত্বরান্বিত করে বিশেষ করে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে। এর সাথে হার্টের সমস্যা বা হাইপারলিপিডেমিয়া বা উচ্চ কোলেস্টেরলের মাত্রা রেটিনোপ্যাথির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
কিডনি সমস্যাতেও রেটিনোপ্যাথির সম্ভাবনা বেশি থাকে।
গর্ভাবস্থায় রেটিনোপ্যাথির ঝুঁকি বেড়ে যায়। গর্ভাবস্থার প্রথম চার মাসে এই ঝুঁকির মাত্রা বেশি। আবার গর্ভাবস্থার আগে থেকে যাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত তাদের বেলায় রেটিনোপ্যাথির সম্ভাবনা বেশি।
স্থূলতা , ধূমপান, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি রেটিনোপ্যাথিকে ত্বরান্বিত করে।
রেটিনোপ্যাথির প্রভাব : ব্যাকগ্রাউন্ড ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বা রেটিনোপ্যাথির প্রাথমিক অবস্থাÑ অক্সিজেন স্বল্পতা বা ইস্কেমিক প্রভাবে রক্তনালীর গায়ে যে দুর্বলতা বা ভঙ্গুরতা দেখা দেয় তার প্রভাবে রক্তনালী রক্তকণিকাকে ধরে রাখতে পারলেও প্লাজমা বা রক্তের তরল অংশকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। ফলে রক্তের তরল বা প্লাজমা রক্তনালী থেকে বের হয়ে রেটিনার কোষে জমা হতে থাকে। রেটিনার কোষে এই তরল জমা হওয়াকে বলা হয় ইডিমা। এছাড়া ছোট ছোট রক্তক্ষরণের মতো ঘটনা ঘটে থাকে। এই অবস্থায় রেটিনার স্নায়ুকোষগুলোর কার্যকারিতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে।
প্রোলিফারেটিভ বা তীব্রতর অবস্থা-রেটিনোপ্যাথির প্রাথমিক অবস্থা দীর্ঘদিন বিরাজিত থাকলে অক্সিজেন স্বল্পতা বা ইস্কেমিক মাত্রা তীব্রতর হয়। এ ক্ষেত্রে অক্সিজেন প্রবাহ বৃদ্ধিকল্পে নতুন নতুন রক্তনালী তৈরি হয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এই রক্তনালীগুলো অপুষ্ট এবং ভঙ্গুর। অপুষ্ট নতুন নতুন রক্তনালীর উপস্থিতির অবস্থাটিকে বলা হয় প্রোলিফারেটিভ রেটিনোপ্যাথি।এই অবস্থায় যেকোনো সময় ভঙ্গুর রক্তনালী থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এই অবস্থায় দ্রুত রেটিনার কোষগুলো নষ্ট হয়ে অন্ধত্ব বয়ে আনে।
চিকিৎসা
১. প্রথম কাজ হলো রেটিনোপ্যাথিকে ঠেকিয়ে রাখা। রেটিনোপ্যাথি ঠেকিয়ে রাখার উপায় হলো-
ষ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা।
ষ টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ওজন কমানো এবং নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস করা।
ষ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা।
ষ কিডনি সমস্যা থাকলে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া।
ষ রক্তশূন্যতা থাকলে তার ব্যবস্থা নেয়া।
ষ ধূমপান পরিহার করা।
ষ হাইপারলিপিডেমিয়া বা কলেস্টেরলের মাত্রা বেশি হলে তার ব্যবস্থা নেয়া।
২. রেটিনোপ্যাথি হলে বা তার পরবর্তী জটিলতা দেখা দিলে তার জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা জরুরি। তবে প্রাথমিক কাজ হবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও রিস্ক ফেক্টর এড়িয়ে চলা।
এমবিবিএস, এফসিপিএস (চক্ষু), এমএস (চক্ষু
চক্ষুবিশেষজ্ঞ ও সার্জন; প্রাক্তন সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল।
কনসাল্টেন্ট- আইডিয়াল আই কেয়ার সেন্টার
৩৮/৩-৪, রিং রোড, আদাবর, ঢাকা। ০১৯২০ ৯৬২৫১২


আরো সংবাদ



premium cement