২১ মে ২০২৪, ০৭ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলকদ ১৪৪৫
`


শিশুর বৃক্কের অসুখ নেফ্রোটিক সিনড্রোম

-

শিশুদের শরীর যদি হঠাৎ বা দিনে দিনে পানি এসে ফুলে যায় তা হলে আমাদের কয়েকটি অসুখ নিয়ে চিন্তা করতে হয়। বৃক্ক (কিডনি), হৃৎপিণ্ড, যকৃতের অসুখের পাশাপাশি শিশু তীব্র মারাত্মক অপুষ্টি রোগে ভুগছে কি না সেটা খুঁজে বের করা জরুরি।
রাহাত নামের তিন বছরের একটি শিশু আমাদের কাছে এলো এক সপ্তাহ ধরে অতি অল্প প্রস্রাব আর শরীর ফোলা নিয়ে। প্রথমে তার চোখের পাতা ফুলে পরে পায়ের পাতা আর পেটেও পানি আসে।
আমরা একটি কাচের নলে প্রস্রাব নিয়ে জ্বাল দিয়ে দেখলাম এটি অনেকটা দধির মতো জমে গেছে।
রোগটি ছিল নেফ্রোটিক সিনড্রোম নামক একটি বৃক্কের অসুখ। শতকরা নব্বই ভাগ রোগীর অসুখের কোনো কারণ জানা যায় না। ২ থেকে ৬ বছরের শিশুদের এবং মেয়েদের থেকে ছেলেদের একটু বেশি পরিমাণে অসুখটি দেখা যায়। তবে ১৫-১৬ বছর পর্যন্ত এবং দুর্লভ ক্ষেত্রে ১ বছরের নিচেও অসুখটি হতে পারে।
আমাদের বৃক্ক অনেকটা ছাকনির কাজ করে। অর্থাৎ রক্তের দরকারি উপাদান ছেঁকে রেখে দিয়ে দূষিত পদার্থ বের করে দেয়। কোনো কারণে এই ছাঁকনি যদি ঠিকমতো কাজ না করে তবে এলবুমিন নামের অতি প্রয়োজনীয় প্রোটিনকে সে আটকে রাখতে পারে না। প্রস্রাব দিয়ে বের হয় বলে জ্বাল দেয়া প্রস্রাব দধির মতো হয়ে যায়। এলবুমিনের কাজ হচ্ছে রক্তের নালীতে পানি ধরে রাখা। এর অভাবে রক্ত নালী থেকে পানি শরীরের অন্যান্য প্রকোষ্ঠে জমা হয় আর শরীর ফুলতে থাকে। ওদিকে বৃক্কে প্রস্রাব তৈরি হয় কম, যকৃৎ অতিরিক্ত চর্বি তৈরি করতে থাকে আর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে এর প্রতিক্রিয়া হয়।
নেফ্রোটিক সিনড্রোম রোগটি নির্ণয়, চিকিৎসা এবং সম্পূর্ণ নিরাময় রোগী, অভিভাবক এবং চিকিৎসকের জন্য বিশাল একটি ধৈর্যের পরীক্ষা। রোগ নির্ণয় করতে এবং জীবাণুর আশঙ্কা খুঁজে বের করতে প্রথম ধাক্কাতেই রক্ত, প্রস্রাব আর এক্সরে করা লাগে। অভিভাবককে ধৈর্য ধরে বুঝতে হবে অসুখটি বৃক্কে হলেও রক্তের এলবুমিন, চর্বি, জীবাণু, প্রস্রাবের জীবাণু, প্রোটিনের পরিমাণ,বৃক্কের কার্যকারিতা, বুকের জীবাণু না দেখে সঠিক চিকিৎসা দেয়া অসম্ভব। এমনকি অসুখের পরবর্তী জটিলতায় আরো অনেক পরীক্ষা লেগে যেতে পারে।
ধরুন রোগটি নিশ্চিত নির্ণয় করা হয়ে গেছে। আমাকে এখন ‘প্রেডনিসোলোন’ ওষুধটি শুরু করতে হবে। কিন্তু রক্ত, প্রস্রাব বা ফুসফুসে জীবাণু রেখে এই ওষুধ শুরু করলে জীবাণু পুরো শরীরে ছড়িয়ে আরো বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি করতে হবে। ওয়ার্ডে ভর্তি অভিভাবককে বোঝাতে হবে, (অনেকক্ষেত্রে) ভর্তির দুই তিন সপ্তাহ হয়ে গেছে, রোগ নির্ণয় হয়ে গেছে, তবু ‘আসল’ ওষুধ কেন শুরু করা যাচ্ছে না।
রোগীর স্বজন প্রশ্ন করেন, এই জীবাণুমুক্ত করার সময় যদি মুখে ওষুধ চলে, তবে হাসপাতালে কষ্ট না করে বাসায় চিকিৎসা করা যায় কি না। উত্তর, না যায় না। কারণ রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে, হৃৎপিণ্ডে সমস্যা হতে পারে, পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হতে পারে, এমনকি জীবাণু নির্মূলের বদলে বেড়ে যেতে পারে। বাসায় বসে চিকিৎসা বিপজ্জনক। এ ছাড়া হাসপাতালে প্রতিদিন প্রস্রাব জ্বাল দেয়া, ওজন, প্রস্রাবের পরিমাণ, রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ করা হয়।
চিকিৎসা শুরুর পর রোগীর উন্নতির একটি পরিমাপক হচ্ছে জ্বাল দেয়া প্রস্রাব স্বাভাবিক হওয়া। প্রস্রাব পরিষ্কার (ঘওখ) হতে কারো ‘আসল ওষুধ’ (প্রেডনিসোলোন) শুরুও করা লাগে না, কারো ৩-৭ দিন লাগে, কারো ১৫-২০ দিন লাগে, ভাগ্য খারাপ হলে ১ মাসেও পরিষ্কার হয় না। কোনো রোগীর প্রস্রাব কত দিনে পরিষ্কার হবে, চিকিৎসকের পক্ষে আগেই বলা অসম্ভব। এটি অনেকটাই ভাগ্য নির্ভর। তাই প্রস্রাব পরিষ্কার না হলে চিকিৎসকের সাথে রাগ করা অযৌক্তিক।
নেফ্রোটিক সিনড্রোম রোগে বৃক্কের স্থায়ী কোনো ক্ষতি হয় না। যদিও ১৫- ১৬ বছর পর্যন্ত অসুখটি বারবার হতে পারে, এরপর এটি এমনিই ভালো হয়ে যাবে। বৃক্ক বিকল হওয়া, ডায়ালাইসিস লাগার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে কিছু খারাপ ক্ষেত্রে বছরে চারবার বা ছয় মাসে তিনবারের বেশি রোগটি হলে কিছু উচ্চ মাত্রার ওষুধ লাগে।
প্রস্রাবে প্রোটিন বের হওয়ার সময়ে কিছু খাদ্যাভ্যাস মানতে হয়। লবণ ও লবণজাতীয় খাবার (চিপস, ঝালমুড়ি, ফলের ভর্তা), চর্বিজাতীয় খাবার নিষেধ। পানি ও পাকা ফল নেফ্রোটিক সিনড্রোমে নিয়ন্ত্রিত না হলেও ‘এজিএন’ নামে আরেকটি কিডনি রোগে নিয়ন্ত্রিত হয়। অতিরিক্ত প্রোটিনও বৃক্কের ক্ষতির কারণ হতে পারে। ছেলে শিশুদের খতনা করালে রোগটি কম হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
লেখক : শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ, আইসিএমএইচ, মাতুয়াইল, ঢাকা।


আরো সংবাদ



premium cement