০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`


আমলাদের প্রশিক্ষণ নিতে ভারত যাওয়ার সমঝোতায় বিশিষ্টজনদের উদ্বেগ

এ চুক্তি আত্মবিশ্বাস নষ্ট করবে

-

ভারতে বাংলাদেশের ১৮ শ’ সরকারি কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক নিয়ে গভীর উদ্বেগ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। জাতি হিসেবে এটা বাংলাদেশের জন্য খুবই হতাশাজনক ও দুঃখজনক একটি বিষয় বলে মনে করেন তারা। এ ধরনের চুক্তি আমাদের আত্মবিশ্বাসহীনতা, পেশাদারিত্বের অভাব এবং পরনির্ভরশীলতার উদাহরণ। তাদের মতে, এক সময় বাংলাদেশে খুবই দক্ষ সিভিল সার্ভেন্ট বা আমলারা ছিলেন। কিন্তু অতি দলীয়করণের মাধ্যমে তা সেই প্রক্রিয়াটা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। দক্ষ সিভিল সার্ভেন্ট পেতে হলে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মেধাবীদের নিয়োগ দিতে হবে। কেবল তাহলেই দক্ষ প্রশাসন পাওয়া সম্ভব।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, ভারতে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ নিয়ে কোনো লাভ হবে না এটা আমি বলতে পারি। আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা কেন সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে যাবে? এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে। সে কারণ কি চিহ্নিত করা হয়েছে?
সাবেক এই উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা নির্ভর করে স্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়া, প্রশিক্ষণ এবং পদোন্নতির মাধ্যমে। মুখ দেখে আর অমুকের বাড়ি কোথায়, তার রাজনৈতিক পরিচয় কী এসব দেখে নিয়োগ ও পদোন্নতি দিলে দক্ষ সরকারি কর্মকর্তা পাওয়া যাবে না। দলীয় পরিচয়ে নিয়োগ দিলে হবে না।
অতীতের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমরা আমলা থাকাকালে যেভাবে স্বাধীনভাবে কাজ করেছি, বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীন অবস্থান নিয়েছি তা কি এখন সম্ভব? কেন সম্ভব নয় এখন?
তিনি প্রশ্ন করে বলেন, আমাদের দেশে কি প্রশিক্ষনের যথেষ্ট আয়োজন নেই? অবশ্যই আছে। সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য যা যা দরকার তার সবই আমাদের আছে। চাকরির শুরু এবং মাঝপথেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। এতে আমাদের ঘাটতি নেই।
তিনি বলেন, আমরা বিদেশে গিয়েছি উচ্চশিক্ষার জন্য, ডিগ্রির জন্য। সেটা আলাদা বিষয় ছিল। কিন্তু আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যাওয়ার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।
ভারতে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার বিষয়ে বিবিসি বাংলার সাথে এক সাক্ষাৎকারে এম হাফিউদ্দিন খান বলেছেন, তাজমহল দেখা ও বউয়ের জন্য শাড়ি কেনা ছাড়া ভারতে আমলাদের প্রশিক্ষণে পাওয়ার কিছু নেই। আমলাদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের দ্বারস্থ হওয়ায় আমি অবাক হয়েছি। প্রশিক্ষণের যথেষ্ট ব্যবস্থা থাকার পরেও কেন ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হবে তার যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাচ্ছি না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, ভারতে গিয়ে আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা কী প্রশিক্ষণ নেবেন সেটা একটা বড় বিষয়। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সাবেক কর্মকর্তাদের লেখা বিভিন্ন বই পড়ে আমরা যেটা জানি সেটা হলো তারা খুব গভীরে তৎপরতা চালান। রাষ্ট্রের স্বার্থে তারা কোনো ছাড় দেন না। রাষ্ট্রের স্বার্থে তারা যেসব কাজ করেন তা আমাদের অনুকূলে নাও হতে পারে। সেজন্য এ ধরনের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের আগে গভীরভাবে ভাবার দরকার ছিল। দেশেও এ নিয়ে আগে আলোচনা হতে পারত।
প্রফেসর মাহবুব উল্লাহ বলেন, ভারতের সাথে আমাদের বহু অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে। আমরা আজো নদীর পানি বুঝে পাইনি। এ অবস্থায় যেখানে ভারতের কর্মকর্তাদের সাথে আমাদের দেশের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ইস্যুতে একই টেবিলে বসে দরকষাকষি করতে হয়, সেখানে তাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিলে আলোচনার টেবিলে আমাদের কর্মকর্তাদের মনোভঙ্গি কী দাঁড়ায় সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তিনি বলেন, অল্পসংখ্যক লোক প্রশিক্ষণের জন্য যেকোনো দেশেই যেতে পারেন। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক লোকের ভারতে প্রশিক্ষণে যাওয়ার আসলে প্রয়োজন নেই। এভাবে আমাদের অন্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়।
প্রফেসর মাহবুব উল্লাহ বাংলাদেশে দক্ষ সিভিল সার্ভেন্ট তথা দক্ষ প্রশাসন পাওয়ার জন্য শিক্ষার মান উন্নত করা, স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া মেনে চলা দরকার বলে মনে করেন। তা না করে এক তরফাভাবে নিয়োগ দিলে দক্ষ আমলা পাওয়া যাবে না। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, পাকিস্তান আমলের সিএসপি নিয়ে আমরা কেন গর্ব করি? কেন তাদের এত কদর? কারণ তখন দেশের সবচেয়ে মেধাবী আর প্রথম কাতারের ছাত্ররা নিয়োগ পেতেন সিএসপি হিসেবে। তাদের অত্যন্ত কঠোর প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। দক্ষতা যোগ্যতায় কোনো ছাড় দেয়া হতো না।
কিন্তু ধীরে ধীরে রাজনীতিকীকরণের ফলে আমাদের পেশাদারিত্ব হারিয়ে গেছে। আমরা এখন আত্মবিশ্বাসও হারিয়ে ফেলেছি। এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।
এই অধ্যাপক পরামর্শ দিয়ে বলেন, আমাদের প্রশিক্ষণে যদি ঘাটতি থেকে থাকে তাহলে সে ঘাটতি দূর করার উদ্যোগ নেয়া দরকার। কিন্তু এভাবে বিদেশে পাঠানোর ফল ভালো হতে পারে না।
এদিকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, আমি বিষয়টিকে পজিটিভলি দেখছি। বহু ক্ষেত্রে ভারত আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী। বিশেষ করে প্রযুক্তিগত বিষয়ে। তাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
ভারতের সাথে আমাদের বিতর্কিত এবং অমীমাংসিত ইস্যু, বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের চুক্তি কতটা ঠিক জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ কারণেই এ ধরনের প্রশিক্ষণ আরো অর্থবহ হবে। পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি হবে। দ্বন্দ্ব দূর হবে। পরস্পরকে বুঝতে সহায়ক হবে এবং এটা শেষ পর্যন্ত সমস্যা সমাধানেও কাজে লাগানো যেতে পারে।
তিনি বলেন, আমাদের বাস্তবতা মেনে পথ চলতে হবে। তা না হলে আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না।
বাংলাদেশ থেকে ১৮ শ’ সিভিল সার্ভেন্ট বা আমলা তাদের চাকরির মাঝপথে প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যাবেন মর্মে গত শুক্রবার দুই দেশ যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা করেছে।
দিল্লিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের নেতৃত্বে ওই দিন পঞ্চম যৌথ কনসাল্টেটিভ কমিশনের (জেসিসি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই বৈঠকেই এ মর্মে একটি সমঝোতাপত্র বা মেমোরান্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিংও (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement