২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কাটছেন ছাত্রের চুল

শিক্ষার বদলে চলছে দুর্নীতি বিশৃঙ্খলা

-

দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশের অবনতি নিয়ে নিয়মিত খবর প্রকাশ হচ্ছে। সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের অপমান ও লাঞ্ছিত করছেÑ এগুলো ছিল গুরুতর সব খবর। এক শিক্ষককে মেরে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেও দেখা গেছে। তবে এসব খবর ছাপিয়ে শিক্ষকদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার বহু ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে নতুন প্রতিষ্ঠিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠছিল। অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষেত্রে নিয়মিত একের পর এক রেকর্ড গড়ছিল। এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কয়েকজন ভিসি দুর্নীতি-অনিয়মের হোতা হয়ে ওঠেন। শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে সব রেকর্ড পেছনে ফেলে এবার দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ছাত্রদের মানহানি ও লাঞ্ছিত করেছেন। স্বভাবত প্রশ্ন জাগে মানুষ গড়ার কারিগরদের মানের এই চরম অবনতি কিভাবে হলো?
গত এক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়লেও শিক্ষার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু হয়ে উঠেছে অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়া। একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে কিছু দুর্নীতিবাজের জন্য লাভজনক প্রকল্প। এগুলো ঘিরে গড়ে উঠেছে সুবিধাভোগী চক্র। দেখা যাচ্ছে ভিসিদের আগ্রহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ আর কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে। জাতীয় এসব প্রতিষ্ঠানকে স্বজনদের নিয়োগ দিয়ে অনেকে পারিবারিকীকরণ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে এখন শত শত দুর্নীতির অভিযোগ। সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে ইউজিসির দিশেহারা অবস্থা। গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের এগারজন ভিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করা হয়। কেউ ভিসি নিযুক্ত হয়ে রীতিমতো স্বৈরাচারী কায়দায় প্রশাসন চালাচ্ছেন। মাসের পর মাস ঢাকায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালাচ্ছেন। একজন শেষ রাতে ক্লাসের আয়োজন করে সাড়া ফেলে দেন। অন্যের প্রকাশনা চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দেয়ার ঘটনা এখন মামুলি ব্যাপার। এসব নিয়ে প্রচুর লেখালেখি-সমালোচনা হলেও কথিত এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার গতি একেবারে ধীর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে না।
সিরাজগঞ্জের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চলমান চরম দুর্নীতিপরায়ণ পরিবেশের বিশৃঙ্খল ব্যবস্থার সর্বশেষ নজির। উচ্ছৃঙ্খল ও বখাটে ছাত্ররা যেমন অপকর্ম করে তিনিও তেমনটিই করে বসেছেন। অপকর্মের দিক দিয়ে এটি ছাত্রদের রেকর্ডকেও ভেঙে ফেলেছে। তিনি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক। বিভাগের প্রথমবর্ষের ছাত্ররা একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে হলে ঢোকার সময় তিনি নিজে কাঁচি দিয়ে ১৪ শিক্ষার্থীর চুল কেটে দেন। বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সভায় তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্র নির্যাতন ও লাঞ্ছনার কথা উল্লেখ করলেও অপরাধের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি। তবে ছাত্রদের অভিযোগ ও পরবর্তী আন্দোলনের জেরে তার বিরুদ্ধে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ছাত্রদের করা অভিযোগের সত্যতা না পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা নয়। এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক কোন যোগ্যতায় এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এমন ব্যক্তিদেরই কি শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে; যারা সমাজের অনুকরণীয়-অনুসরণীয় আদর্শ বদলে নিজেরাই মন্দের প্রতীক হয়ে উঠছেন।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে যে বিধিবিধান ও ঐতিহ্য রয়েছে সেগুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করা হচ্ছে। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকারি দলের শাখা সংগঠনের নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও হয়ে যাচ্ছেন। দলীয় লোক আর আত্মীয়করণের জালে আমরা আটকা পড়ছি। মেধার বিষয়টি আগেই উপেক্ষিত ছিল। এখন নীতিনৈতিকতাহীনরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক বনে যাচ্ছেন। আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অধঃপতনের যে পর্যায়ে নেমে এসেছে তা উদ্ধার করাই এখন দুরূহ। শিক্ষদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বড় যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে; সেগুলোর প্রকৃত তদন্ত হয়নি। প্রমাণিত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এখনো দূরঅস্ত। ইতোমধ্যে সংঘটিত হওয়া প্রত্যেকটি অপরাধের বিহিত হতে হবে। এরপর নতুন শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা যাতে সঠিকভাবে মানা হয়; সে জন্য কঠোর হতে হবে। দুঃখজনক হচ্ছেÑ সে ধরনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement