২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
প্রতারিত হয়েই চলেছেন গ্রাহকরা

আইন-কানুনের প্রয়োগ নেই

-

বহুস্তর বিপণন বা এমএলএমের মাধ্যমে ফটকাবাজি করে সাধারণের অর্থ আত্মসাতের সুযোগ ক্রমাগত বেড়েছে। এর সাথে আগে থেকেই ছিল বিভিন্ন নামের সমবায় সমিতি। বিশেষ করে গত এক দশকে এগুলো এক নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে সারা দেশে। আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কোনো নিয়ম-কানুন না থাকলে দেশে এমন অরাজকতা অবস্থা হতে পারে। করোনাকালে যোগ হয়েছে ই-কমার্সের নামে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এসব অনলাইন প্লাটফরম রীতিমতো হয়ে উঠেছে জুয়াড়িদের বোর্ড। সমবায় সমিতি ও ই-কমার্সের নামে সব মিলিয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। একটি দেশের জনগণের আর্থিক নিরাপত্তা যদি এতটাই ঠুনকো হয় তাহলে দেশটিকে কতটা সুস্থ বলা যায়। দেশে ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা নিয়ে হইচই হয়। সেই ক্ষেত্রে এমন অরক্ষিত একটি রাষ্ট্রকে কী বলা যেতে পারে।
খবরে জানা যাচ্ছে, এই লুটপাট তুঙ্গে ওঠে করোনার মৌসুমে। মানুষের চলাচল সীমাবদ্ধ হওয়ায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ই-কমার্স। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে এগুলো নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানানো হয় তখন। এই সময়ে ই-অরেঞ্জ ও ইভ্যালির মতো অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো দান মেরেছে। ই-অরেঞ্জ আত্মসাৎ করেছে ১১ শ’ কোটি টাকা। ইভ্যালি আত্মসাৎ করেছে এক হাজার কোটি টাকা। বোঝা যাচ্ছে, এগুলোর সাথে রাঘববোয়ালরা জড়িত। যারা বিধিবিধান জানেন তারা প্রচলিত নিয়ম-কানুন যথাযথ মানার পরিবর্তে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ফাঁকফোকর দিয়ে কিভাবে মানুষের টাকা হাতিয়ে নেয়া যায়। মহামারীর সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যখন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল তখনই প্রতারক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা ছিল। আইন মানতে বাধ্য করা জরুরি ছিল। দেশীয় আইন-কানুনের দুর্বল দিকগুলো শুধরে জনসাধারণের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে তা করা হয়নি।
বহুস্তর বিপণন, সমবায় সমিতি ও ই-কমার্সের নামে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখে সহজে অনুমেয়, সরকারের পক্ষ থেকে যে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের কথা ছিল তা মোটেই হয়নি। বাস্তবে গ্রাহকরা সবসময়ই অরক্ষিত ছিল। ২০০৬ সালে যুবক আত্মসাৎ করে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ইউনিপে টু ইউ আত্মসাৎ করে ছয় হাজার কোটি টাকা। ২০১২ সালে ডেসটিনি আত্মসাৎ করে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এ ধারায় ২০১৭ সালে দেখা যায়, ২৬৬টি সমবায় সমিতি চার হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। ২০২১ সালে ১১ প্রতিষ্ঠান আত্মসাৎ করে তিন হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। হিসাব মতো প্রথম প্রতারণার ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার কথা। যারা কেলেঙ্কারি করেছে তাদের বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার কথা। দেখা যাচ্ছে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি এর জবাব চাওয়ার মতো শক্তিশালী কোনো পক্ষ দেশে নেই। এসব ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়মের চেয়ে সরকারের মনোভাব ও ইচ্ছা প্রাধান্য পাচ্ছে।
বিষয়টি এখন পরিষ্কার, এগুলো ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অবাস্তব সব লাভের অফার দেয়া হয়েছে। সেই লাভ দেয়া একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব কি না নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান খতিয়ে দেখেনি। এসব অফার যখন দেয়া হয় তখন এর স্বচ্ছতা-জবাবদিহি চায়নি সরকারও। ফলে সর্বস্বান্ত হয়েছে লাখো মানুষ। বিভিন্ন সময়ে সর্বস্ব হারানো যুবকদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এরপরও প্রতারণা ব্যবসা বন্ধ হয়নি। অথচ আর্থিক অনিয়ম বন্ধে দেশে উপযুক্ত আইন রয়েছে। আইনের প্রয়োগ হলে এভাবে মানুষ প্রতারিত হতো না। যখন প্রতারকরা চিহ্নিত হলো তখনো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এভাবে আর চলতে পারে না। অন্ততপক্ষে চলমান মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের পাওনার ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বড় কথা, ভবিষ্যতে যেন এমন আরেকটি কেলেঙ্কারির ঘটনাও না ঘটে সে ব্যবস্থা করতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement