২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনা উদ্যোগ

ফের যেন ‘বলির পাঁঠা’ না হয়

-

রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের চলতি বছরেই নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সূচনা হতে পারে। আগামী এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে বলে আশাবাদী পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। চীনের মধ্যস্থতায় গত মঙ্গলবার চীন-বাংলাদেশ-মিয়ানমার ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে পরীক্ষামূলকভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সাথে চুক্তি করে মিয়ানমার। তার পর দুই বছর পেরিয়ে গেলেও সেই চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়নি দেশটি। ২০১৯ সালে দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়; কিন্তু ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা দেয়নি মিয়ানমার। ফলে রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরতে রাজি হননি। বাংলাদেশ এখন রাখাইন পরিস্থিতি সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের আস্থায় নিয়ে এগোতে চায়। এ জন্য রোহিঙ্গাদের গ্রাম বা এলাকাভিত্তিক প্রত্যাবাসন, রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় মিয়ানমার নিরাপত্তাবাহিনীর পাশাপাশি জাতিসঙ্ঘ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান, চীন, ভারত ও সার্বিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বেসামরিক প্রতিনিধিদের উপস্থিতি চেয়েছে ঢাকা। কিন্তু এসব শর্ত মানতে এখনো নারাজ নেপিডো। আমাদের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, গ্রাম বা এলাকাভিত্তিক প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমার সম্মতি দেয়নি। তিনি বলেন, রাখাইনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপস্থিতির ব্যাপারে চীন গঠনমূলক ভূমিকার ওপর জোর দিলেও মিয়ানমার কোনো কথা বলেনি।
আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিষয়ক বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের ত্রিপক্ষীয় ফোরামের মহাপরিচালক পর্যায়ের যৌথ কার্যকরী গ্রুপের (জেডব্লিউজি) বৈঠকে রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির ওপর জোর দেবে ঢাকা। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে তিন দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক। এরপর সুবিধাজনক সময়ে তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের আয়োজন করা হবে। এবারের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনে সাহায্য করেছে চীন। ভবিষ্যতেও দেশটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমঝোতার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও অন্যান্য সহায়তা দিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ বৈঠকের বিষয়ে কতটা আশাবাদী হওয়া যায় তা বিচার-বিশ্লেষণ সাপেক্ষ।
ভারতকে বাইরে রেখে এ ধরনের উদ্যোগ কতটা সফল হবে; তা নিয়ে সংশয় প্রকাশের বাস্তবতা রয়েছে। এর অন্যতম কারণ, বাংলাদেশে চীন-ভারতের স্বার্থের টানাপড়েন। এ ছাড়াও মঙ্গলবারের বৈঠকের ইতিবাচক ফল নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেও চীন যে বিবৃতি দিয়েছে সেটিও লক্ষণীয়। ঢাকায় চীনা দূতাবাস জানিয়েছে, বৈঠকে অংশ নেয়া চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার লুও ঝাও হুই বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে চীন রোহিঙ্গা সঙ্কট দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের ওপরেই জোর দিয়ে আসছে। তবে চীনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ সঙ্কট জটিল করার পরিবর্তে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করা উচিত।
এই শেষ বাক্যটি গভীরভাবে ভেবে দেখার মতো। এটি হলো একটি কূটনৈতিক ভাষ্য যা সুচারু কূটনৈতিক শৈলীতে মোড়ানো। এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন আছে একাধিক ইঙ্গিত। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে মামলা এগিয়ে নেয়া, এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিশ্বকে সক্রিয় রাখা, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণে জাতিসঙ্ঘ, আসিয়ান ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের প্রতিনিধি রাখার বিষয়ে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা এসব কিছু থেকে বাংলাদেশকে বিরত থাকার কথাই বলছে চীন। বলছে, এমন কিছু করো না যাতে বিশ্বে মিয়ানমারকে বেকায়দায় পড়তে হয়, অপদস্থ হতে হয়। আসো নিজেরা বসে সমস্যা মিটিয়ে ফেলি। অর্থাৎ চীন- মিয়ানমারের কথা মতো কাজ করলেই সেটি হবে ইতিবাচক। যেকোনো বিবেচনায় এটি একটি বিপজ্জনক প্রস্তাবনা। মিয়ানমারকে বিশ্বাস করা যায় এখন পর্যন্ত এমন কোনো নজির সৃষ্টি করতে পারেনি দেশটি। নামকাওয়াস্তে প্রত্যাবাসন শুরু করে বিশ্বকে দেখাতে চায় যে, নেপিডো এ বিষয়ে আন্তরিক। আর উপর্যুপরি ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশও এই মুহূর্তে সেটিই চায়।
কিন্তু চীনের কথামতো বিষয়টিকে জটিল না করে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আদৌ কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। বরং এতে করে মূল পক্ষ যারা সেই নিপীড়িত রোহিঙ্গাদেরই আরো বড় বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া হবে। রাখাইনে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হলে তারা ফের গণহত্যার শিকার হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তা দেখার কোনো উপায় থাকবে না।


আরো সংবাদ



premium cement