২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
করোনা মোকাবেলাই জরুরি

বৈশ্বিক যুদ্ধবিরতি সময়ের দাবি

-

করোনা মহামারী বিশ্বজুড়ে যে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে, অতীতে মানবজাতি এমন মহাদুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে খুব কমই। মধ্যযুগে এমন মহামারী এসেছে পৃথিবীতে। আর আধুনিককালে দু’টি বিশ্বযুদ্ধ মানবজাতিকে বড় বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। মহামারীর ওপর মানুষের কোনো হাত নেই। কিন্তু যুদ্ধ মানুষের নিজের তৈরি দানব, যা কেবল ধ্বংসই ডেকে আনে। যুদ্ধ যে শুধু মানুষের জীবন কিংবা সম্পদের ধ্বংস ডেকে আনে তা-ই নয়, বরং তা মানুষের যুগের পর যুগ ধরে তিলে তিলে রক্তে-ঘামে গড়ে তোলা সভ্যতাকে ভেতরে ও বাইরে উভয় দিক থেকে ধ্বংস করে দেয়। জীবন ও সম্পদের পাশাপাশি মানুষের যে অন্তর্গত অর্জন, তার মূল্যবোধ, দর্শন, নীতিনৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা অর্থাৎ যা কিছু তার আত্মিক সম্পদ তাকেও নিঃশেষ করে দেয় যুদ্ধ।
বর্তমান করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক তাণ্ডবের সময় বিশ্বের বহু জায়গায় বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ অব্যাহত আছে। বিশ্বের সব পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তি কোনো-না-কোনোভাবে এসব যুদ্ধে জড়িত। আবার সংশ্লিষ্ট সব দেশই কমবেশি কোভিড-১৯ মহামারীতে আক্রান্ত। একই সাথে রণাঙ্গনের যুদ্ধ এবং কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে যুক্তরাষ্ট্র। করোনা সংক্রমণে পর্যুদস্ত দেশটি কিন্তু হুঁশে নেই। এখন পর্যন্ত তারা যুদ্ধংদেহী মনোভাব ছাড়তে পারেনি।
এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিরতির আবেদন জানিয়েছেন সব দেশের প্রতি। ১০টি দেশের উদ্যোগে প্রণীত এই যৌথ বিবৃতি গত ২২ জুন প্রকাশ করা হয়। জাতিসঙ্ঘের ১৭২টি সদস্য ও পর্যবেক্ষক সদস্য দেশ এতে সমর্থন জানায়। গত মঙ্গলবার নিউ ইয়র্কে এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ, ইকুয়েডর, মিসর, জ্যামাইকা, জাপান, মালয়েশিয়া, ওমান, সেনেগাল, স্লোভেনিয়া ও সুইডেন যৌথভাবে এই বিবৃতিটি হস্তান্তর করে। বিশ্বের সব সঙ্ঘাতপূর্ণ এলাকায় তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধ থামানোর প্রয়াস হিসেবেই এই যৌথ বিবৃতি।
বলা হয়েছে, কোভিড-১৯-এর সময়ে যুদ্ধ ও বৈরিতার প্রভাবে বিপর্যস্ত মানবতার জন্য এই বিবৃতিটি বৈশ্বিক সংহতি ও মমত্ববোধের এক শক্তিশালী ও স্পষ্ট বার্তা বহন করে এনেছে। অস্ত্রবাজ পৃথিবী এই আহ্বানের সাথে সাথে সব অস্ত্রশস্ত্র মাটিতে নামিয়ে রেখে একযোগে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়বে এমনটা আশা করার কোনো কারণ নেই। কারণ খোদ এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণও অনেক দেশের মধ্যে বৈরিতার অন্যতম কারণ হয়ে আছে। চীন ও আমেরিকার বৈরিতা নতুন মাত্রা পেয়েছে করোনা সংক্রমণকে কেন্দ্র করে।
ট্রাম্প কোনো প্রমাণ ছাডাই বারবার করোনাভাইরাসকে বলছেন ‘চায়না ভাইরাস’। তিনি এটিকে চীনের ল্যাবে তৈরি জীবাণু-অস্ত্র বলেও মন্তব্য করেন। এমনকি চীনের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট এমন অভিযোগ তুলে এই মহাদুর্যোগের সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অর্থায়ন বন্ধ করে দেন তিনি। এসব ঘটনায় আমেরিকায় চীনবিরোধী বর্ণবাদ যেমন উসকে উঠেছে, তেমনি দু’দেশের সম্পর্কের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সতর্ক করে বলেছেন, গত কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সহযোগিতার ফলে যে সুফল সৃষ্টি হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি সেটি নষ্ট করে দেয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি তো হবেই, পুরো বিশ্বের স্থিতিশীলতা এবং সচ্ছলতা হুমকিতে পড়বে। দৃশ্যত কোভিড-১৯ মহামারী চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে এমন এক অবস্থায় এনেছে যেখানে দু’দেশের বাণিজ্যযুদ্ধের অবসান নয়, বরং এখন নতুন করে শীতল যুদ্ধ শুরুর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই আশঙ্কা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দেয়ার হুমকি দেন। এমনই এক সময়ে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের যুদ্ধবিরতির আহ্বান খুবই আশাব্যঞ্জক একটি পদক্ষেপ। তার এ আহ্বান যদি বিশ্বকে সত্যিই যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে সাময়িকভাবে হলেও রেহাই দিতে পারে তাহলে স্থায়ী শান্তির পক্ষে সেটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বিশ্বের এখন রণাঙ্গণের যুদ্ধ নয়, মানুষ বাঁচানোর, সভ্যতার অর্জনগুলো রক্ষা করার লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়।


আরো সংবাদ



premium cement