২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
চিকিৎসককে তাৎক্ষণিক কারাদণ্ড

সবারই জবাবদিহিতা প্রয়োজন

-

রাজধানীর শাহজাহানপুরে অবস্থিত ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের একজন ইউনানি চিকিৎসককে তার চেম্বার থেকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত রোববার বেলা ১১টার দিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশকুমার বসু ফোর্সসহ সেখানে হাজির হন এবং মিজানুর রহমানকে নানা রকম জিজ্ঞাসাবাদ করে একপর্যায়ে তাকে আটক করে নিয়ে যান এবং দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, মিজানুর রহমান হেকিম হয়েও ‘ডাক্তার’ হিসেবে প্রেসক্রিপশন দেন এবং প্রেসক্রিপশনে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ লেখেন। এটা বেআইনি। ম্যাজিস্ট্রেট এরপর হাসপাতালের ডিসপেনসারিতে যান এবং অননুমোদিত ওষুধপত্র ও সরঞ্জাম রাখার দায়ে জরিমানা করেন।
ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল দেশের খ্যাতনামা একটি হাসপাতাল। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকের জন্য নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাত এটি। এখানে দেশের প্রথিতযশা চিকিৎসকদের অনেকেই রোগী দেখেন। নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও হাসপাতালটির সুনাম রয়েছে। এমন একটি হাসপাতালে এভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা বেশ উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। হাসপাতালটির সুপার ডা: সিরাজুল ইসলাম যিনি এর আগে সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি সংবাদপত্রকে বলেছেন, পুরো ঘটনাটি খুবই হতাশাজনক। ইউনানি ডিগ্রিপ্রাপ্ত কেউ নামের আগে ডাক্তার লিখতে পারবেন না, এমন কোনো আইন আমার জানা নেই। তিনি বলেছেন, সরকার যখন গ্রামপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে ইউনানি ও আয়ুর্বেদিককে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে সেখানে কর্মরত ডাক্তারকে গ্রেফতার করে দণ্ড দেয়া অন্যায়।
বাংলাদেশ ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বুয়ামা) বলেছে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ডা: মো: মিজানুর রহমানকে ভুয়া ডাক্তার হিসেবে অভিহিত করে যে বক্তব্য প্রদান করেছেন তা সঠিক নয়। ডা: মিজানুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি ইউনানি অ্যান্ড আয়ুর্বেদিক মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৯১-৯২ সেশনে ‘ব্যাচেলর অব ইউনানি মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি’ (বিইউএমএস) পাস করেন (১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষা) এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে স্থায়ী সনদপ্রাপ্ত (সনদ নং: ইউ-৪১) হয়ে ইউনানি গ্র্যাজুয়েট হন। এ ছাড়া তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লিভার রোগে এমফিল ফেলো এবং হৃদরোগে পিএইচডি করেন। দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা সনদ থাকা সত্ত্বেও তাকে ভুয়া ডাক্তার হিসেবে আখ্যায়িত করায় বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হোমিও ও দেশজ চিকিৎসা, অল্টারনেটিভ মেডিক্যাল কেয়ার (এএমসি) বিভাগের পরিচালকের স্বাক্ষরিত আদেশ রয়েছে এ ব্যাপারে। আদেশে বলা হয়েছে, বিএএমএস এবং বিইউএমএস পাসকৃতরা তাদের নামের আগে ডাক্তার (সংক্ষেপে ডা:) লিখতে পারবেন। এ ব্যাপারে এএমসির পরিচালক আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থাকে হয়রানি না করার অনুরোধসংবলিত অফিস আদেশও রয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন উল্লেখ করেছে, নামের পাশে ডাক্তার লেখা এবং প্রয়োজনে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ লেখার ব্যাপারে মহামান্য হাইকোর্টের রিট পিটিশন রয়েছে (রিট পিটিশন নং : ৭০৪৩ অব ২০১২)। হাইকোর্টের রুলে বলা হয়েছে, ‘জারিকৃত রুলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিএএমএস ও বিইউএমএস ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে অর্থাৎ নামের পূর্বে ডাক্তার লিখতে ও প্রয়োজনে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ লেখার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার গ্রেফতার, হয়রানি বা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’ ডা: মিজানুর রহমান মহামান্য হাইকোর্ট ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের আদেশ মেনেই চিকিৎসা করছিলেন এবং তিনি আইন অমান্য করেননি।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট কোন আইন বলে সরকারি সনদপ্রাপ্ত একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী চিকিৎসককে ভুয়া ডিগ্রিধারী বলে উল্লেখ করে তাৎক্ষণিকভাবে দুই বছরের জেল দিলেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়। এখানে ব্যক্তিগত কোনো আক্রোশের বিষয় সম্পৃক্ত কি না সেটিও দেখার বিষয়। আমরা জানি, বিচারকরা বিচার কাজে ভুল করতে পারেন। এটি বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত একটি বিষয়। এ কারণে নিম্নতর বিচার আদালত থেকে ধাপে ধাপে উচ্চতর আদালত পর্যন্ত বিচারের রায় পুনর্বিবেচনা করার আইনি ব্যবস্থা রয়েছে। নি¤œ আদালতের বহু রায় ঊর্ধ্বতন আদালতে পাল্টে যায়। দেশের করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে যখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এক সঙ্কট চলছে তখন ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী চিকিৎসককে কোন ক্ষমতা বলে এ ধরনের তাৎক্ষণিক দণ্ড দিলেন তা বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা হওয়া উচিত জরুরি ভিত্তিতে। তা না হলে আইন এবং আইনের আশ্রয় গ্রহণের পুরো ব্যবস্থার প্রতি অনেকেরই আস্থাহীনতা সৃষ্টি হতে পারে।

 


আরো সংবাদ



premium cement