০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`


আহমদ ছফা প্রতিবাদী সাহিত্যিক

-

“এই বাঙাল মুলুকে আমাদের স্থিতি হয়েছিল সেই কবে মোগল আমলে। মোগল আমল, নবাবী আমল, ইংরেজ আমল কতো কাল এলো গেলো। কতো রাজ্য কতো রাজা এসেছে আর গিয়েছে। কত যুদ্ধবিগ্রহ, ধ্বংস সৃষ্টি, বিপ্লব উপবিপ্লব সব কিছুর আঘাত সহ্য করেও সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল আমাদের পরিবার। কোনো আকস্মিক বিপদ আপদই আমাদের পরিবারকে স্পর্শ করতে পারেনি। অখণ্ড প্রতাপ খণ্ড খণ্ড হয়ে পড়েছে, বিশাল জমিদারি কোথায় বিলীন হয়েছে। তার পরও এক পুরুষের পর এক পুরুষ এসেছে। হৃদয় লালিত অহংকারে ভরিয়ে দিয়ে গেছে উত্তর পুরুষের বুক। বংশপঞ্চিত তাদের আশ্চর্য সব নাম পাঠ করে আর ততোধিক আশ্চর্য কীর্তি কাহিনী শ্রবণ করে আমি নিজেও কতোবার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছি। এ সম্মোহনের মধুর স্বাদ কি করে কাটাই।”
লেখক, লেখক শিল্পী, চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান বিদ্রোহী, অভিমানী লেখক আহমদ ছফার বিখ্যাত ছোট উপন্যাস ‘ওঙ্কার’ এর কিছু অংশ।
লেখক অনেকেই হন, তবে মনীষী লেখক আমরা তাদেরকে বলি যাঁদের রচনায় একই সঙ্গে যুগ যুগান্তরের স্বপ্ন ও সাধনা মূর্ত হয়ে ওঠে। আহমদ ছফা ছিলেন আমাদের দেশের সে রকম এক বিরল জনপ্রিয়তাসম্পন্ন লেখক। লিপিকুশলতার সঙ্গে মনীষার এমন মানকাঞ্চন যোগ সচরাচর ঘটে না, সব লেখকের বেলায় তো নয়ই। আহমদ ছফার প্রজ্ঞা, মননশীলতা, অন্তর্দৃষ্টি, ইতিহাসবোধ, ঐতিহ্য সচেতনতা, মানবপ্রীতি সামাজিক দায়বদ্ধতা তাঁকে সাহিত্যিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে আমাদের কালের এক চিন্তানায়কের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।
আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলায় হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হেদায়েত আলী এবং মাতা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান। ছিলেন আমৃত্যু অবিবাহিত।
আহমদ ছফার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় তার পিতার প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। তিনি ১৯৫৭ সালে নিজ গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ‘ম্যাট্রিকুলেশন’ পাস করেন। তখন এসএসসি
কে ‘ম্যাট্রিকুলেশন’ বলা হতো। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
সুধাংশু বিমল দত্তের সাহচার্য্যে তিনি কৃষক সমিতি ন্যাপ বা তৎকালীন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্য সেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলেন। কিছুদিন গ্রেফতার এড়াতে পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপনে থাকেন। ১৯৬২ সালে তিনি চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন। সেই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হয়নি। ১৯৬৭ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ডিগ্রি পাস করেন। ১৯৭০ সালে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগে বাংলা একাডেমির এক বৃত্তি পেয়ে পিএইচডির উদ্দেশ্যে তিন বছরের জন্য ফেলেশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৮ খিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের জন্য জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন।
এ দিকে ১৯৭১ সালে তিনি প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। তার পক্ষে পরে পিএইচডি শেষ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ সালে লেখক সংগ্রাম শিবির গঠন করে নানা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা ‘প্রতিরোধ’ প্রকাশ করেন। ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের উদ্দেশে কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘দাবানল’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে লেখালেখিতে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৮০ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় ঢাকার কাঁটাবনের বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষা কেন্দ্র’ চালু করেন। ১৯৮৬ সালে এই লেখক জার্মান ভাষার ওপর গেটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তী লেখক জীবনে গেটের অমর সাহিত্য কম ‘ফাউস্ট’ অনুবাদ করা তার পক্ষে সহজ হয়ে পড়ে।
আহমদ ছফা সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণ কাহিনী মিলিয়ে প্রায় ত্রিশের অধিক গ্রন্থ রচনা করেন। আহমদ ছফা রচনাবলী তার জীবিত থাকাকালীন প্রকাশিত হয়। নিয়মিত পত্রপত্রিকায় তিনি লিখতেন। তার সব চেয়ে জনপ্রিয় লেখা হচ্ছে আবদুর রাজ্জাক স্যারকে নিয়ে লেখা ‘যদ্যপি আমার গুরু’।
স্বাধীনতার পর পর ১৯৭১ সালে আহমদ ছফার প্রথম গ্রন্থ ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’ মুক্তধারা প্রকাশ করে। ১৯৭২ সালে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ এবং ১৯৭৯ সালে ‘সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস’ ও ১৯৮১ সালে বাঙালি মুসলমানের মন গ্রন্থ প্রকাশের পর দেশে এক নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করে।
১৯৭২ সালে দৈনিক গণকণ্ঠ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস রচনা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ‘বিতর্ক বা আলোড়ন সৃষ্টিকারী লেখার ফলে সরকারের রোষে পড়েন। সেই সময় দেশের প্রতিষ্ঠিত অপ্রতিষ্ঠিত লেখকরা প্রতি সপ্তাহের লেখা পড়ার জন্য আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করতেন। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-দীর্ঘ এ কালখণ্ডে বুদ্ধিজীবীরা কিভাবে আত্মবিত্তির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন, কিভাবে পুরস্কার, পদক-পদবির জন্য মরিয়া ছিলেন, তা তথ্য- উপাত্তসহ জাতির সামনে লেখনীর মাধ্যমে তোলে ধরেন।
লেখক আহমদ ছফার কথায়:-
“আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানী ছিলেন,
বিশ্বাসের কারণে নয়- প্রয়োজনে। তখন
অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন-সেও ঠেলায় পড়ে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে প্রবন্ধ নিবন্ধ রচনা, গল্প-উপন্যাসে পাকিস্তান প্রশস্তি, স্বৈরশাসকের জীবনী অনুবাদÑ এসব বিষয়কে আহমদ ছফা দেখেছেন লেখকের মেরুদণ্ডহীনতার চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ মুহূর্তে লেখক সমাজের নিষ্ক্রিয়তা, যুদ্ধের সময় দ্বিধান্বিত ভূমিকা, ভারতে পালিয়ে বেড়ানো, ভোগ বিলাসে মত্ত থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আহমদ ছফা উল্লেখ করেছেন তখনকার বুদ্ধিজীবী, লেখক সমাজ কতটা অপরিণামদর্শী ও অদূরদর্শী ছিলেন।
আহমদ ছফার বিখ্যাত রচনাগুলোর মধ্যে প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, শিশু সাহিত্য, অনুবাদ, কবিতা বিশেষভাবে আলোচিত। যেমন: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস ১৯৭২,বাঙালি মুসলমানের মন ১৯৮১, সন্ধ্যার ১৯৭৫, একজন আলী কেনানের উত্থান পতন ১৯৮৮, অলাতচক্র ১৯৯৩, পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ ১৯৯৬, যদ্যাপি আমার গুরু ১৯৯৮, ফাউস্ট ১৯৮৬, মরণ বিলাস ১৯৮৯, সূর্য তুমি সারথী ১৯৬৭, তানিয়া ১৯৬৭।
কাব্য : জল্লাদ সময় ১৯৭০, দুঃখের দিনে দোহা ১৯৭৫, একজন প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা ১৯৭৭ লেলিন ঘুমাবে এবার ১৯৭৭, গল্প: নিহত নক্ষত্র ১৯৬৭
কিশোর গল্পে: দোলা আমার কনকচাঁপা ১৯৬৮
শিশুতোষ ছড়া: গো-হাকিম ১৯৭৭
অনুবাদ: তানিয়া ১৯৬৭, সংশয়ী রচনা ১৯৮১
আহমদ ছফার উপন্যাস ওঙ্কার বেশ কিছু লেখা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ওঙ্কার উপন্যাসটি চলচ্চিত্র হয়েছে। তার পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ উপন্যাসটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ হয়। তিনি বেশ কিছু গানও লিখেছেন। গ্যোটের ফাউস্ট কাব্যনাট্যের বঙ্গানুবাদ তার এক অমর কীর্তি।
সমাজের বঞ্চিত শিশুদের জন্য তিনি সুলতান পাঠশালা প্রতিষ্ঠা তার অন্যতম কীর্তি।
জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মতে ‘ছফার রচনাবলী গুপ্ত ধনের খনি এবং সাহিত্যকর্ম স্বকীয় এক জগতের সৃষ্টি করে যে জগতে যে কোনো পাঠক হারিয়ে যেতে পারে।
কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, আহমদ ছফাকে ‘অসম্ভব শক্তিধর একজন লেখক বলে অভিহিত করেছেন। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের মতে ‘আহমদ ছফা চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত এক শ’ ভাগ খাঁটি সাহিত্যিক। জাফর ইকবাল আরও বলেন, “আমাদের সৌভাগ্য তার মতো একজন প্রতিভাবান মানুষের জন্ম হয়েছিল।”
বিশিষ্ট লেখক, বুদ্ধিজীবী, কবি ফরহাদ মজহার বলেছেন আহমদ ছফা গাছবাড়িয়া গ্রাম থেকে আসা অতি সাধারণ একটি গ্রামের ছেলে। কিন্তু সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিন্তা ও রাজনীতির জগতে সে যে উথাল পাথাল ধাক্কা দিয়ে গেল তার ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য বলি, সংস্কৃতি বলি, রাজনীতি বলি, বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড বলি তার সঙ্গে খোদ একটা বোঝাপড়া না করে কোনো ক্ষেত্রেই অগ্রসর হওয়া যাবে না।
এই অসাধারণ সাহিত্যিক আহমদ ছফা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আহমদ শরীফ বলেন, “সুবিধাবাদীদের খরভব রং ধ পড়সঢ়ৎড়সরংব তত্ত্বে ছফার আস্থা নেই। আজকের বাংলাদেশে এমনি স্পষ্ট ও অপ্রিয়ভাষী আরো কয়েকজন ছফা যদি আমরা পেতাম, তাহলে শ্রেয়তর পথ স্পষ্ট হয়ে উঠত।
সরকার ফজলুল করিম বলেছিলেন, “ছফা কেবল পাঠ করার বিষয় নয়, চর্চা করার বিষয়।” আহমদ ছফার সাহিত্য এক একটি যেন শব্দ যেন শিলাখণ্ডের মতো ভারী। তার মধ্যে রয়েছে গভীর ভালোবাসা, মমতা তার কোনো হিসাব নেই। অমর এই কথাশিল্পী ২০০১ সালে ২৮ জুলাই, দুনিয়া ছেড়ে চলে যান।

 


আরো সংবাদ



premium cement