১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


বাঙালি নাট্যকার ইবনে শাইখ

-

আসকার ইবনে শাইখের দুনিয়ায় দুরন্ত দুর্নিবার শাইখি শক্তি। শতাব্দী শ্রেষ্ঠ বাঙালি নাট্যকার ইবনে শাইখ। শাইখি শক্তি এতই শক্তিমান যে তার আবেদন বাঙালি হৃদয়ে জাগরুক থাকবে অনন্তকাল। সমাজ মনস্কতার এ প্রতিধ্বনি সময় ও সমকালের স্মৃতির মিনার। মাটি ও মানুষের কাছাকাছি নয়, মাটি ও মানুষই মূল উপজীব্য। ভাষাসৈনিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, গীতিকার, জীবনীকার, গল্পকার হলেও মূলত নাট্যকার। নাটকের মহীরুহ, নাটকের বটবৃক্ষ, নাটকের তাজমহল, নাট্যবিশ্ববিদ্যালয়। বাঙালির বাতিঘর। বাঙালি বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সঞ্চালক ও সঞ্চায়ক ইবনে শাইখ।
অন্যায়, অনাচার, অবিচার, অন্যায্যতা, কদাচার, কুটিলতা, কূটবুদ্ধি, কপটতা, কপটাচারী, কুপ্রবৃত্তি, কূটনীতি, গোঁড়ামি, পশ্চাৎপদতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, সঙ্কীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত উদার-মুক্তমনা সমাজ-সংস্কৃতি সৃষ্টির সুপথের স্রষ্টা। পতন্মুখ হতাশাক্লিষ্ট বাঙালিকে জাগ্রত ও শক্তিমানতার প্রতীকে পৌঁছানোর প্রয়াসে আত্মনিবেদন করেন। আত্মজাগরণ, জাতীয় জাগরণ ও সমাজ বিপ্লবের গান শোনার মন্ত্র শুধুই শাইখি নাটক। তাই তো তিনি বাংলা নাটকের যথার্থ প্রতিনিধি।

যাপিত জীবনের কর্মচাঞ্চল্য, কর্মপ্রক্রিয়া, কর্মপরিকল্পনা, কার্যকলাপ, কল্পনাজগৎ, কল্পনাশক্তি, কর্মবাচ্য, কর্মজ্ঞ, কর্তব্যকরণ, কার্যকরণ, কৃতকর্ম, কর্মতৎপরতা, কর্মাকর্ম, ক্রীড়া কৌতুক ও স্বপ্নগাড়ির সমষ্টিই সামাজিক নাটক। সমকালীন সমাজকে তিনি শুধু নাট্যকারের দৃষ্টিতে দেখেননি, পাশাপাশি সমালোচকের চোখেও উপলব্ধি করেছেন। ফলে সমাজের অসঙ্গতি ও রুচিনীতি, ইতিহাসের নানা উপখ্যান তার নাটকে আশ্রয় পেয়েছে। কলমের শক্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিস্তীর্ণ পরিসরে। নাটকের তাজমহল এঁকেছেন নিপুণ হস্তে। শিল্পচর্চার রুদ্ধদ্বার নিরাভরণ করেন।
গণমানুষের ক্লেশ, ক্লেদ, যন্ত্রণা ও আর্তির নাট্যরূপে আনন্দ বিনোদনও হাজির। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সাংসারিক টানাপড়েন, ত্যাগের কথা, সংগ্রাম-সফলতার কাহিনী। আছে হার না মানা প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, অবিরাম লড়াইয়ের সাধনা। সত্যকে গোপন করে মিথ্যাকে কায়েম করা ও তার বিরুদ্ধে লড়াই।
বহুভুজ জীবনের জলছবির নাট্যরূপ বিরোধ। জীবন চতুর্ভুজের স্বপ্নলোকের ছোটগল্পের আরাধনাতে আসকারের সামাজিক নাটক প্রবাহিত। সামাজিক সমস্যার মর্মমূলে প্রবেশ করে উদ্ধার করেন জীবননদীর গূঢ় তাৎপর্য। বাঙালি জীবনের পারিবারিক ও সামাজিক চিত্র নিয়েই বিরোধ। শতবছর আগের জীবনযাত্রার সাথে বর্তমান জীবনযাত্রার খুব একটা ফারাক সৃষ্টি হয়নি। প্রযুক্তিগত দিক আলাদা, গ্রামীণ মানুষের চরিত্র, নৈতিকতা, খাদ্যাভ্যাস, চালচিত্র, নীতিবোধ, নীতিহীনতা ব্যতিক্রম ছাড়া সমরেখায় সাযুজ্য। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিরোধ নাটকের আবেদন ও বাস্তবতা আজো জীবন্ত। বিরোধ বাঙালি জীবনের প্রথম সার্থক ও পূর্ণাঙ্গ নাটক। সে হিসেবে ত্রুটি থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে চার দিকে আজ নাটকের যে রমরমা আয়োজন, তার মূল সিলসিলা বিরোধ। আজো টিভি নাটকই বলি, আর মঞ্চ নাটকই বলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ‘বিরোধী’য় কালচারই বর্তমান। তাই তো ইবনে শাইখ আজো নমস্য। সমকালীন কবি আহসান হাবীব ১৯৪৭ সালে বিরোধ নাটকের ভূমিকায় লেখেন, ‘বিরোধে ঘাত প্রতিঘাত সৃষ্টির ক্ষমতা দেখে চমৎকৃত হয়েছি। চরিত্র সৃষ্টিতেও লেখক অক্ষম নন। নাটকের পরিণতি স্বাভাবিক ও সৃষ্ট পথেই এগিয়ে গেছে।
বাংলার গ্রামজীবনের পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ-মামলা মোকদ্দমা; ফলে মৃত্যু, দারিদ্র্য, ধ্বংস-এর মূলে যে আভিজাত্যবোধ, যে স্বাতন্ত্র্যবোধ মানুষের মনে কাজ করে তাকে বিদ্রƒপ না করে সহানুভূতির সাথে বিচার করেছেন লেখক। আধুনিক শিক্ষা ও আলোকপ্রাপ্ত তরুণ সমাজ এসেছে সেই আভিজাত্যবোধের মিথ্যা অহমিকাকে ভেঙে দিতে, বিদ্রƒপ নিয়ে নয়, প্রীতি নিয়ে, প্রেম নিয়ে, শ্রদ্ধা নিয়ে।’
হিন্দুসমাজের সমোজ্জ্বল চিত্রের নাট্যরূপ বিল-বাঁওড়ের ঢেউ। পদ্মাপাড়ের মানুষের জীবনসত্তা ও জীবনাচার এবং উপনিবেশবাদীদের গৃহপালিত ‘ল্যান্ড লর্ড’দের লুণ্ঠন, লুটতরাজ ও কৃষ্ণলীলার ছায়াছবি বিদ্রোহী পদ্মা। ল্যান্ড লর্ড আর লাঠিয়াল প্রমুখ বলশালী ও শান্তিকামী জনতার প্রতিবাদ প্রতিরোধমুখর প্রথম বাঙালি নাট্যপ্রকাশ বিদ্রোহী পদ্মার সার্থক রূপকার ইবনে শাইখ। কর্তৃত্ববাদের করালগ্রাস এবং শোষিতের সংগ্রাম বিদ্রোহী পদ্মা; ২০০৬ সালে যার চলচ্চিত্রে রূপদান করা হয়।
বাংলা নাট্যান্দোলনের কীর্তিমান সিংহপুরুষ। শীর্ষ সংস্কৃতিবোদ্ধা ও সংস্কৃতিযোদ্ধা। নাটকে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও বাঙালি জীবন অনুপম ব্যঞ্জনায় ভাস্বর। বাঙালির সুদীর্ঘ সংগ্রামী ঐতিহ্য অসাধারণ স্বাতন্ত্র্যের ভাষারূপ। বাঙালির বিবর্ণ বয়ানের বিবরণ ‘মেঘলা রাতের তারা’। সংগ্রামী বাঙালিদের জীবনলাখ্যের সমোজ্জ্বল প্রতিচ্ছবির নাট্য সঙ্কলন। সুদিনের আশায় বাঙালিদের ত্যাগ-তিতিক্ষার ধারাবাহিক আলেখ্য নতুন করে ভাবতে শেখায় আমাদের। একদা টেলিভিশনে ঝড় তুলেছিল। দর্শক- শ্রোতারা সপ্রশংস অভিনন্দন জানিয়েছিল।

দুর্যোগভরা অন্ধকারাচ্ছন্ন মেঘলা রাতে আসমানে নক্ষত্রের হাজিরা চর্মচোখে দৃষ্টিগোচর হয় না। তাই বলে আসমানে নক্ষত্র নেই বলে প্রচার যুক্তিহীন। এ ছাড়া গভীর চোখে বিরলদৃষ্ট তারার হাজিরা নজরের বাইরে থাকে না। বিরলদৃষ্ট সেসব স্বর্ণপ্রদীপদের নিয়ে আয়োজন মেঘলা রাতের তারা। বাঙালির পরাধীন যুগে, সুদীর্ঘ পটপরিক্রমায়, অকথিত বয়ানের ভেতরেও নাম জানা-অজানা অগুনতি দেশনায়কের হাজিরা úষ্ট। বর্তমানের উড়ে এসে জুড়ে বসা কথিত নেতাদের ভিড়ে সেইসব উন্নত শিরগুলোকে ভুলতে বসেছে তাদেরই উত্তরসূরিরা। বাঙালি বীরদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই দেশাত্মবোধক টেলিনাট্য সিরিজ ‘মেঘলা রাতের তারা’। দৌলত আলী, মজনু শাহ, ভবানি পাঠক, নুরুদ্দিন, মুসা শাহ, সোবহান শাহ, চেরাগ আলি, টিপু পাগলা, তিতুমির, মাসুম খান, শরিয়তউল্লাহ, দুদু মিয়া, হাবিলদার রজব আলি প্রমুখ মহান বাঙালিদের সুকীর্তি নিয়েই টেলিভিশন নাট্যসিরিজটি তৈরি। এইসব মহাপুরুষ ও তাদের সুদীর্ঘ গৌরবদীপ্ত ইতিহাসকে ক্রিটিকাল আলাপ ও ভাবনায় নিয়ে আসতে মেঘলা রাতের তারা নাটক সিরিজটি অন্যতম অনুষঙ্গ। পলাশীর পথে, পলাশী, পলাশীর কান্না, অন্ধ রাতের ডাক, মন্বন্তর, বিদ্রোহ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, রেনেসাঁ, বাঁশের কেল্লা, ঝড়ের ডাক, ঝড়ের রাতে- এই ১১টি নাটকের সঙ্কলন আলোচ্য গ্রন্থ। এ প্রসঙ্গে না বললেই নয়, উনিশ শতকের কলকাতার কলোনিয়ান রেনেসাঁ বাঙালির নয়, বর্ণবাদীদের। বাংলার জনগণের জন্য ওই নবজাগরণ কোনো কল্যাণ বয়ে আনেনি। শুধুই কিছু বর্ণব্রাহ্মণের ধনবান, জনবান, ক্ষমতাবান ও ভগবান হওয়ার প্রক্রিয়া। তাদের কাছে ইংরেজ শাসন ভগবানের মঙ্গলময় বিধান।
আসকারের নাট্যাপ্রসাদ আলোয় আলোময়। অতীত আলোদের নিয়েই তার নাট্যভালো। বাঙালির বঙ্গবিপ্লবের বীরত্বগাঁথা নিয়ে অশ্বারোহী। নাটকের নায়ক যদিও অবাঙালি। বাঙালিরা এই অবাঙালি মহাবীরকে নিয়েই বাঙালি কৃষ্টির দুশমন, বাংলা ভাষার শত্রু সেন সরকারের বিলোপ ঘটান। বাংলা ভাষা বিকাশ-বিস্তৃতি ও সুরক্ষা তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। ইতিহাসশ্রেষ্ঠবীরের নাট্যমূল্যায়নে এখানে আশাহত হইনি আমরা। নাট্যকারের ভাষায় মুহাম্মাদ বখতিয়ারের জবানিতে উচ্চারণ, ‘এখানে মানুষ ধুঁঁকে ধুঁকে মরে। এখানে শয়তান মুক্ত-স্বাধীন! এখানে কুফর, জুলুম, জেহেল! যুগ যুগ ধরে, বুকফাটা কত দীর্ঘ-নিঃশ্বাসে এখানে অসীম জ্বালা! কত বিক্ষোভে জমে জমে এখানে আগ্নেয়রি! এখানে এসেছে কুরআনের আলো, নেভাতে চেয়েছে শয়তানি ঝড়! এস, জাগ্রত করি আগ্নেয়গিরি! হাতে না-ও নেয়া, নাঙ্গা তলোয়ার!! জীবন এখানে জাগ্রত হোক!! আবারো পুনরুক্তি ‘জাগো সঙ্গীরা জীবন সওয়ার! এসেছে সময়... জঙ্গে জেহাদ... কদম বাড়াও!! আঁধার-ঘেরা এ কবরগাহে জীবন জাগাও!!! নাট্যাচার্যের সাহসী উচ্চারণ জাগ্রত বাঙালির প্রত্যাশার প্রতিচ্ছবি।
বিশ শতকে বাঙালি জাগরণ ও মধ্যবিত্ত সমাজ বিকাশের অন্যতম প্রধান পুরোধা ইবনে শাইখ। মরুতে সৃষ্টি সবুজের সমারোহ। সেই তো উত্তম পুরুষ যিনি মানুষকে, সম্প্রদায়কে, জাতিকে খুশি রাখতে, এগিয়ে নিতে, ভালো রাখতে জীবনবাজি রাখেন, দেশ ও সমাজকে উন্নয়নের শীর্ষে নিতে কাজ করেন ইবনে শাইখও সেই পুরুষোত্তম। বাঙালি ঐতিহ্যের দৃষ্টিনন্দন সম্ভার শাইখ। পরমত সহিষ্ণুতা, অসাম্প্রদায়িকতা, উদারতা, নীতিবোধ, স্থানীয় কৃষ্টিকালচার, লোকজ আবহ তার লেখাবহ। বর্তমান অসহিষ্ণু সমাজ উপকৃত হতে পারে শাইখি সাহিত্যকর্ম থেকে।
অসত্য ও অসুন্দরের অবসান চেয়েছেন। কুসংস্কার, কুপমণ্ডকতা ও অন্ধকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন।
আবহমান বাঙালির বিশ্বাস-বিনোদন ব্যঞ্জনা এবং যুক্তিবর্জিত চিন্তাধারা ও পেশিশক্তি প্রদর্শনের প্রবণতায় সামাজিক বিশৃঙ্খলার কদর্যরূপ সামাজিক নাটক। বাঙালি রেনেসাঁস মানব। বাঙালি কৃষ্টির কীর্তিমান রাজ, কৃতদার। বাঙালি ঐক্য ও সংহতির রাজপুরুষ, বাঙালি ভাবনার বীর প্রতীক। ঢাকার নাটকের কারফিউ ভেদ করে নাট্যবীজের অঙ্কুরোদগম ঘটে আসকারের আবির্ভাবেই।

আসকারকে বাইরে রেখে বাংলা নাট্যালাপ জমানো বা আসর গরম অসম্ভব। নাট্যাজাল জাঁকাতে আসকার আলাপন অতি জরুরি। যারা শেকসপিয়র, ইবসেন, মিলারদের কাছে দান ভিক্ষা করেন, তাদের উচিত শাইখের সরোবরে সমর্পণ। তাহলে তারা আরো অধিক সমৃদ্ধ হবেন। নিজেদের মুক্তি ও সমৃদ্ধির পথও খুঁজে পাবেন। ক্রীতদাসী মনমানসিকতা থেকেও মুক্তি মিলবে। পাশ্চাত্যে শেকসপিয়ার আর ইবসেন এবং বাংলার পললভূমিতে ইবনে শাইখ। তার সময়কালেই শুরু যুগল নাট্যাভিনয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওবায়দুল হক সরকারের উদ্যোগে সহ-অভিনয়ে আসে এক নবপ্রভাত। নতুন অধ্যায়ে আসকার ইবনে শাইখ ছিলেন তখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নাটক রচনা, অভিনয়, পরিচালনা ও প্রযোজনায় নতুন যুগের সূচনার সূচক।
হেনরিক ইবসেনকে বলা হয়, প্রথা ভাঙার নাট্যকার। বলা হয় পাশ্চাত্যের আধুনিক নাটকের জনক। ইবনে শাইখও একই মর্যাদায় উদ্ভাসিত। হেনরিক ইবসেনের অ্যা ডলস হাউস সমালোচকদের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ নাটক। নোরা হেলমার সাংসারিক তিক্ততার মাঝে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে মুক্ত পৃথিবীর উদ্দেশে। গৌতম বুদ্ধও স্ত্রী ও শিশুপুত্র ছেড়ে নিরুদ্দেশ হন। সিদ্ধার্থের সাথে নোরার সদৃশ। নোরা বের হয়ে আসে এ জন্য তাকে নারী স্বাধীনতার প্রতীক এবং ইবসেন তাকে বের করে আনেন। এ জন্য তাকে নারী অধিকার আন্দোলনের নায়ক হিসেবে বিবেচনা করেন বিশেষ শ্রেণী। আমরা এখানে বিশেষ কোনো মাহাত্ম্য দেখি না। পায়ে ব্যথা পেয়েছি, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি, তাই পা কেটে বের করে ফেলব। কিংবা বাচ্চা অবাধ্য বা লেখাপড়া করে না, তাই ঘর থেকে বের করে দেবো- এর কোনো মানে হয় না। এটা কোনো সমাধান নয়। বরং স্বামী সংসার থেকে সমস্যার সমাধান করতে পারলেই নোরার জন্য সেটা শ্রেয়তর হতো। এরমধ্যেই আমরা বিশেষত্ব ও মাহাত্ম্যের হাজিরা খুঁজে নিতাম। ইবনে শাইখের নাটকে অপেক্ষাকৃত গুরুত্ববহ ঘটনা বিরল নয়।
বাঙালির মননচর্চা, বাঙালির আত্মোন্নয়ন, আত্মবিশ্লেষণ, বাঙালির উৎকর্ষ সাধনে, বাঙালির ভিতকে শক্তিশালীকরণে ইবনে শাইখের কৃতিত্ব কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন। এ ক্ষেত্রে তিনি পাইওনিয়ার। ‘আমি পারি, আমরা পারি’ ইবনে শাইখ দেখিয়ে দিয়েছেন অর্ধশতাব্দীকাল। কিন্তু শুধু ব্যক্তি নন, একটি ইনস্টিটিউশন। বড় বড় নামজাদা প্রতিষ্ঠান যা করতে পারেনি, ইবনে শাইখ একাই তা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। ‘আমাকে পারতে হবে, আমাকে পারতেই হবে’ এই ছিল তাঁর ভূষণ আর মিশন। দেশ ও জাতির প্রতি তার মেসেজ একটাই, উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য চাই একতা। এক হলে পারি, একা হলে হারি।
বাঙালি জীবনে সেকালে নাট্যাভিনয় বা নাটক হেয় চোখে দেখা তো। অভিনেতাদের এড়িয়ে চলার প্রবণতা ছিল সমাজে। তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করা হতো। ভদ্র সমাজে তাদের নিয়ে কটুবাক্য বর্ষিত হতো। হাসি-তামাশা তো ছিলই। ইবনে শাইখ সে প্রথা ভেঙে দেন নিজ কারিশমায়। তাই তো তিনি কারিশমাটিক নাট্যকার। তিনি নাটককে সর্বজনগ্রহণযোগ্য করে তোলেন আপন শক্তিতে। সে শক্তির কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয় সমকালীন বিরুদ্ধ সমাজ।

ইবসেন পশ্চিমা নাট্যসাহিত্যের জনক হলে ইবনে শাইখ অবশ্যই আধুনিক বাংলা নাটকের জনক ও পথিকৃৎ। আধুনিক বাংলা নাটককে পৌঁছান সাফল্যের স্বর্ণশিখরে। সামাজিক ও ঐতিহাসিক নাটকে তিনি অসাধারণ দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। মঞ্চ নাটক, বেতার নাটক, টেলি নাটক কি নেই তার ভাবনায়? বর্তমানে চার দিকে নাটকের যে রমরমা আয়োজন এসব ইবনে শাইখের কীর্তি। পাকিস্তানি আমল ও বাংলাদেশ আমলে যত নাট্যপুরুষদের আবির্ভাব হয়েছে সবাই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে তার কাছে ঋণী। ইবনে শাইখের এককালের সহকারী একালের নামজাদা নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশিদ ‘নাট্যক্রিয়ার ধমণীতে আসকার ইবনে শাইখ’ শীর্ষক স্মৃতিপ্রবন্ধে বলেছেন, ‘একেবারে নীরবে নিভৃতেই চলে গেছেন আমাদের গুরু। যিনি নাটকের ক্ষেত্রে প্রথম বাংলা একাডেমি পুরস্কারটি পেয়েছিলেন। কী অদম্য উৎসাহী প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন তিনি। ষাটের দশকেই তিনি তার নাট্যদল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন- ‘সাতরং’। কী যে অমত্য স্নেহ পেয়েছেন তার নাট্যসন্তানেরা। আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম, নাজমুল হুদা বাচ্চু, এমনকি আমিও।
নাটক তিনি যেমন করতেন, চরিত্রেও তিনি ছিলেন নাটকীয়। নাটক নির্দেশনাকালে এত আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতেন যে, কখনো-সখনো মাত্রা ছাড়িয়ে যেতেন। মঞ্চে অভিনয়ের সময় আমাদের কাউকে সাথে থাকতে হতো, যদি না আবার তিনি মঞ্চেও ঢুকে যান- এই ভয়ে।
আবদুল্লাহ আল-মামুনের প্রতিভার প্রতি তিনি ছিলেন অন্ধ। তার বাড়িটা প্রায় বিনামূল্যে ভাড়া দিয়েছিলেন তিনি। মামুন ভাই ভাড়া দিতে পারতেন না নিয়মিত। কোনো আফসোস ছিল না তার। তিনি নাটক লেখা শেখাতেন, অভিনয় শেখাতেন- নাটকের শুরু কিভাবে করতে হয়, সেখান থেকে। যদি ভুল লিখি, কাটাকাটি করে আবার নতুন করে লিখতে হবে। স্থান, কাল স্পষ্টভাবে লিখতে হবে। প্রথম পাতা যদি বেশি কাটাকাটি হয় তাহলে ছিঁড়ে ফেল, নতুন করে লেখো। তার প্রতিটি মুহূর্ত কাটত উত্তেজনায়। যখন তিনি লিখতেন তখনও উত্তেজিত।
প্রথম জীবনেই কলেজ অধ্যাপক। তার আগে এমএ পাস করেই তার প্রিয়তম লেখক তারাশংকরের গ্রাম লাভপুরে শিক্ষকতা নিয়েছিলেন। তারপর ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে। কী আবেগ তার তারাশংকরের প্রতি! ‘অগ্রদানী’ গল্পটা যে কতবার শুনেছি তার কাছ থেকে!
তিনি কত যে সুযোগ সৃষ্টি করতেন আমাদের জন্য- তা বলে শেষ করা যাবে না।’ হাতে কলমে তিনি নাটক শিখিয়েছেন নাট্যপিয়াসীদের। ১৯৪৭ সালে বিরোধ নাটকের মাধ্যমে তার যে জয়যাত্রা শুরু হয় দীর্ঘ ছয় দশক পর্যন্ত চলে সে গতিধারা।


আরো সংবাদ



premium cement
অন্যায়ভাবে আমাদের উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে : মান্ডা-জিরানী খালপাড়বাসী র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকছে : যুক্তরাষ্ট্র কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীতে নিখোঁজ কিশোরের লাশ উদ্ধার বাংলাদেশকে একটি সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত করার পাঁয়তারা চলছে : হামিদুর রহমান আযাদ ইউক্রেনের শতাধিক ড্রোন প্রতিরোধের দাবি রাশিয়ার বাস্তবতা বিবেচনা করে পরিকল্পনা প্রণয়নের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর জীবননগরে পাখিভ্যানের ধাক্কায় বাইসাইকেলচালক নিহত আড়াইহাজারে তরুণীকে সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ সাতক্ষীরায় ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ভ্যানচালক নিহত মোরেলগঞ্জে আগুনে পুড়ে ১২ দোকান ভস্মীভূত টেক্সাসে প্রবল বর্ষণে ৪ জনের মৃত্যু

সকল