২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রশ্নফাঁস চক্রে সরকারি কর্মকর্তা ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান

সবশেষ অডিটর নিয়োগের প্রশ্নফাঁস; পরীক্ষার্থী সেজে ডিভাইসে সরবরাহ; চক্রের ৭ জন ও ৩ শিক্ষার্থী গ্রেফতার
-

সরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস ও প্রশ্নের উত্তর শিক্ষার্থীদের কাছে সরবরাহ করে আসছিল একটি চক্র। সবশেষ গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ে অডিটর নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে চক্রের সদস্যরা। পরীক্ষার্থী সেজে পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যে তারা প্রশ্নফাঁস করে সেগুলো উত্তরসহ সরবারহ করে। এ জন্য তারা শিক্ষার্থীদের সাথে মোটা অঙ্কের টাকার চুক্তি করে। ডিবি পুলিশ বলছে, মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের (সিজিএ) বরখাস্তকৃত কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান আজাদ ও বগুড়ার ধুপচাঁচিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরীন রুপার যোগসাজশে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করে আসছিল। চক্রটির কয়েকজন সদস্য আগেও বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করে গ্রেফতার হয়েছিলেন।
মাহমুদুল হাসান আজাদ ও মাহবুবা নাসরীন রুপাসহ এ চক্রের সাত সদস্য ও তিন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতারের পর এ তথ্য জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। গ্রেফতার অন্যরা হলেন- নোমান সিদ্দিকী, আল আমিন রনি, নাহিদ হাসান, শহীদ উল্লাহ, তানজির আহমেদ, রাজু আহমেদ, হাসিবুল হাসান ও রাকিবুল হাসান। গত শুক্রবার দুপুর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মিরপুর, কাকরাইল ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় ধারাবাহিক অভিযানে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ছয়টি ইয়ার ডিভাইস, ছয়টি মাস্টার কার্ড মোবাইল সিম হোল্ডার, পাঁচটি ব্যাংকের চেক, সাতটি নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, ১০টি স্মার্ট ফোন, ছয়টি ফিচার মোবাইল, ১৮টি প্রবেশপত্র ও চলমান পরীক্ষার ফাঁস হওয়া তিনটি প্রশ্নপত্র সেট জব্দ করা হয়েছে। গতকাল শনিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে বিকেল সোয়া ৪টা পর্যন্ত প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের অধীনে ৫৫০টি অডিটর পদে নিয়োগের জন্য ৭০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এনএসআই ও ডিবি গুলশান বিভাগ গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে জানতে পারে, একটি চক্র এই নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে অর্থ হাতিয়ে নেয়া ও জালিয়াতির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত। পরে ধারাবাহিক অভিযানে তাদের ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রথমে কাকরাইলে অবস্থিত নিউ শাহিন হোটেল থেকে অসাধু উপায় অবলম্বনকারী দুই পরীক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্য মতে কাফরুল থানাধীন সেনপাড়া পর্বতা এলাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ডিভাইস, প্রশ্নপত্র এবং উত্তরপত্রের খসড়াসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। ডিবি পুলিশের অপর দল বিজি প্রেস উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে পরীক্ষার্থী এবং অন্যতম পরিকল্পনাকারী মাহবুবা নাসরীন রুপাকে টাকা, ডিজিটাল ডিভাইসসহ গ্রেফতার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্যমতে অন্য আসামিদের গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, চক্রটির একটি গ্রুপ পরীক্ষার আগে থেকে পরীক্ষার্থী সংগ্রহ ও অর্থ হাতিয়ে নেয়। নগদ, রকেট ও বিকাশসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস ও চাকরি পাইয়ে দিতে অর্থ লেনদেন হয়। টার্গেটকৃত পরীক্ষার্থী প্রতি ১৪ থেকে ১৬ লাখ টাকার লিখিত চুক্তি হয়। যেহেতু এমসিকিউ পরীক্ষা, তাই এমসিকিউ পরীক্ষায় পাস করার পরই ভাইভা। তাই এমসিকিউ পরীক্ষার আগে কিছু টাকা নিয়ে নেয় চক্রের সদস্যরা। নিয়োগ পাবার পর বাকি টাকা দেয়ার চুক্তি হয়।
চক্রের আরেকটি গ্রুপ ইলেকট্রনিক ডিভাইস, ইয়ার ডিভাইস, মাস্টারকার্ড মোবাইল সিম হোল্ডার ও বাটন মোবাইল টার্গেটকৃত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে সরবরাহ করে। পরীক্ষা শুরুর ২-৩ মিনিটের মধ্যেই প্রশ্নফাঁস করে বাইরে পাঠানো হয় ডিভাইসের মাধ্যমে। বাইরে থেকে প্রশ্নের সমাধান করে ডিভাইসের মাধ্যমে ফের পাঠানো হয় পরীক্ষার্থীদের কাছে।
অতিরিক্ত কমিশনার আরো বলেন, গ্রেফতারদের মধ্যে প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ে অডিটর মাহমুদুল হাসান আজাদ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ২০১৯ সালে বরখাস্ত হন। নাহিদ হাসান, আল আমিন সিদ্দিকী এর আগেও প্রশ্নফাঁস সংক্রান্তে ২০১৩, ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে গ্রেফতার হয়েছিল। গ্রেফতার আসামিরা অন্যান্য আসামিদের যোগসাজশে বিভিন্ন সোস্যাল অ্যাপস, ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে কেন্দ্র থেকে প্রশ্নফাঁস করে দেয়া, বাইরের রুমে ওয়ানস্টপ সমাধান কেন্দ্র বসিয়ে স্মার্টওয়াচ, এয়ার ডিভাইস, মোবাইল এসএমএস-এর মাধ্যমে উত্তর সরবরাহের কাজ করেছে।
এর আগেও তারা বিভিন্ন ব্যাংক, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন অধিদফতর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, সিটি করপোরেশন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন হিসাব নিরীক্ষক কার্যালয়, জ্বালানি অধিদফতর, সমবায় অধিদফতর, খাদ্য অধিদফতর, সাধারণ বীমা করপোরেশনসহ অন্যান্য সংস্থার প্রশ্নফাঁস এবং উত্তরপত্র সরবরাহ করে বিপুল পরিমাণ টাকা বিভিন্ন ব্যাংক এবং বিকাশের মাধ্যমে এবং নগদে হাতিয়ে নিয়েছে। পরীক্ষা বাতিল হবে কি না জানতে চাইলে হাফিজ আক্তার বলেন, কোনো সংস্থাই চায় না পরীক্ষা বিতর্কিত হোক। পরীক্ষা বাতিল হবে কি না তা সংশ্লিষ্ট দফতরই সিদ্ধান্ত নেবে। এর আগে বিভিন্ন পরীক্ষায় জালিয়াতি করেই জড়িতদের কয়েকজন বরখাস্ত হয়ে জেলও খেটেছে।
উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরীন রুপা ভূমিকা সম্পর্কে ডিবি প্রধান বলেন, তার ভূমিকা ছিল মধ্যস্থতার কাজ করা। একটি গ্রুপ অর্থ সংগ্রহ করেছে। আরেকটি গ্রুপ ডিভাইস সরবরাহ করেছে। মাহবুবা নাসরীন রুপা নিজে পরীক্ষা দিয়েছে, সাথে অন্য পরীক্ষার্থীদের কাছে ডিভাইস সরবরাহের কাজ করেছে। গ্রেফতারদের মধ্যে চক্রের মধ্যে শিক্ষার্থী তিনজন, চক্রের সদস্য সাতজন। ১৮ শিক্ষার্থীর সাথে তাদের চুক্তি হয়েছিল। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত তদন্তে ৯ শিক্ষার্থীর মাঝে ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রের উত্তর সরবরাহের তথ্য মিলেছে। এই চক্রের সাথে আরো যারা জড়িত রয়েছে তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মামলা দায়েরের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান ডিবি প্রধান।


আরো সংবাদ



premium cement