২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিলীন হচ্ছে স্কুল বসতবাড়ি ফসলি জমি

অসময়ে যমুনার ভাঙন
চৌহালীতে এভাবে ভাঙছে যমুনা : নয়া দিগন্ত -


অসময়ে যমুনার ভাঙনে বিলীন হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। পাবনার বেড়া, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার নদী-তীরবর্তী গ্রামগুলোতে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। এক সপ্তাহের ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে গেছে শতাধিক পরিবার। তারা পরিবার-পরিজন ও গবাদিপশু নিয়ে খোলা আকাশের নিচে ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে বড় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ইতোমধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শতাধিক বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। এ ছাড়া ভাঙনের হুমকির মুখে পড়েছে আরো ৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মাদরাসা, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ পল্লী বিদ্যুতের সাবস্টেশন।
ভাঙন কবলিতরা জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিনটি উপজেলার নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো খোঁজ-খবর নেয়া হয়নি। নদীভাঙনে অনেক সচ্ছল পরিবারও নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেকে সড়কের পাশে টিনের ঝুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে দিন যাপন করছেন। তাদের নেই বিশুদ্ধ পানি কিংবা খাবার।

গত ২৬ মে, শুক্রবার পাবনার বেড়া, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও চৌহালীর বেলকুচিতে ভাঙন কবলিত গ্রামগুলো সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ভাঙন আতঙ্কে মানুষজন বাড়ি-ঘর সরিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। অনেকেই পৈতৃক ভিটা হারিয়ে নদীপাড়ে বসে আহাজারি করছে। অনেকে ভেঙে পড়ার আগ মুহূর্তে বড় বড় গাছগুলো কেটে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। বাড়ির ভিটা থেকে প্রায় ৩০ ফুট নিচু অবধি নদীরপাড় খাড়া হয়ে আছে। ঘূর্ণায়মান স্রোতের টানে বিশাল এলাকা জুড়ে বড় বড় ফাটল ধরছে। কোনো কোনো ফাটল চোখের সামনে মুহূর্তের মধ্যেই ধসে পড়ছে নদীতে। নদী ভাঙনের এই তাণ্ডব লীলায় নদীপাড়ের গ্রামগুলোতে এখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
বেড়া উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মেসবা উল হক জানান, যমুনার পানি বাড়ার সাথে সাথে এ উপজেলার পুরান ভারেঙ্গা, নতুন ভারেঙ্গা ও হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের প্রায় ১০টি গ্রাম ভাঙনের কবলে পড়েছে। আকস্মিক ভাঙনে চরকল্যাণপুর, চরপাইখন্দ, চরনাকালিয়া, চরনাগদা, বেপারীপাড়া, দর্জিপাড়া, চরসাড়াশিয়াসহ হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নদীপাড়ের মানুষগুলো এখন দিশেহারা।
হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের চরনাগদা গ্রামের আবু দাউদ, আব্দুর রহমান, রুহুল আমীন, আব্দুল কাদের, লুৎফর রহমান, ইয়াসিন আলী, ইসমাইল হোসেন, আখলিমা খাতুন ও আব্দুল হালিম জানান, এই অসময়ে নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় এখানে আকস্মিক ভাঙন দেখা দিয়েছে। তীব্র ভাঙনে বাড়িঘর, গাছপালা ও ফসলি জমি বিলীন হতে শুরু করেছে।

বেড়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জানান, যমুনার ভাঙনে চরনাগদা সরকারি প্রাথমি বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয়, মসজিদ, কমিউনিটি ক্লিনিক, চরসাড়াশিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরপাইখন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পল্লী বিদ্যুতের টাওয়ার ভাঙনের মুখে এখন যায় যায় অবস্থা।
বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শুধাংশু কুমার সরকার জানান, এ ব্যাপারে পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন। আমরাও ভাঙনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকে জানিয়েছি।
পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য ফিরোজ কবীর বলেন, নদী ভাঙনের কবলে স্থানীয় বাসিন্দারাসহ এ অঞ্চলের পল্লী বিদ্যুতের সাবস্টেশনটিও হুমকির মুখে পড়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে চাহিদাপত্র দেয়া হয়েছে।
এ দিকে বেড়া উপজেলার ২৫ কিলোমিটার উজানে চৌহালী উপজেলার বেলকুচিতে যমুনার ভাঙনে দিশেহারা নদী পাড়ের মানুষজন। চৌহালীর দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বহু স্থাপনা ভেঙে গেছে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বিভাগ প্রায় ৬ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
চৌহালী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর ফিরোজ জানান, এ উপজেলার সোদিয়া চাঁদপুর ইউনিয়নের চাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একই ইউনিয়নের রেহাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে ওই ইউনিয়নের আরো তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ ছাড়া, চরমুরাদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং চরমিটুয়ানি সরকারি পাথমিক বিদ্যালয় থেকে মাত্র ১০ ফুট দূর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যমুনা নদী।

চরমিটুয়ানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, অসময়ে নদী ভাঙনের এমন দৃশ্য আগে দেখিনি। যে সময় নদী শান্ত থাকে এবার সেই সময়েই নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। স্কুলের আসবাবপত্র সরিয়ে নিয়েছি।
চৌহালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফসানা ইয়াসমিন মোবাইল ফোনে জানান, ভাঙন এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তালিকা পাওয়ার পর জানা যাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কি রকম। চৌহালীর ভাটিতে শাহজাদপুর উপজেলার খুকনী ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগ্রাম ও আরকান্দি গ্রামে যমুনার ভাঙনে নদীপাড়ের অনেক মানুষই বসতবাড়ি ও ফসলি জমি হারিয়েছে। কেউ কেউ অন্যত্র চলে গেছে, কেউ বা যাচ্ছে। কেউ কেউ খাস জায়গায় অথবা বাঁধের ঢালুতে আশ্রয় নিয়েছে। খোলা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঘরের চালা, কাঁথা-বালিশ, আসবাবপত্র, কাটা গাছপালা।

স্থানীয় শরিফুল ও আজাদ জানান, ব্রাহ্মণ গ্রামের এবং আরকান্দি গ্রামের ৮০ শতাংশ ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি ইতোমধ্যে নদীতে চলে গেছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত আবু বক্কার, নুরুজ্জামান, ফকির আশরাফ জানান, কেউ আমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছে না। আমাদের বসতভিটা ও ফসলি জমি কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। আমরা অসহায় ছিন্নমূলে পরিণত হয়ে যাচ্ছি বুঝি। ভাঙন কবলিত মানুষেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে কে কোথায় চলে গেছে, সে খবর কেউ জানে না। যমুনার অব্যাহত ভাঙনে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ব্রাহ্মণ গ্রাম ও আরকান্দি গ্রাম।
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাদিয়া আফরিন মোবাইল ফোনে নয়া দিগন্তকে জানান, নদী ভাঙনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও যাচাই-বাছাই করা হয়নি। এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement