২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পাবনার বাজারে দেশী মাছের সঙ্কট, ১৪ কারণ শনাক্ত

-

পদ্মা, যমুনা ও চলন বিল বেষ্টিত পাবনায় রয়েছে অনেকগুলো বড় বড় জলাশয়। পাবনার স্থানীয় হাটবাজারে এক সময় বিভিন্ন প্রজাতির দেশী মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন তেমন দেখা মেলে না দেশী মাছের। শুষ্ক মৌসুমে অধিকাংশ বিল-নদী-জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় প্রায় ১৫ হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়েন। সঙ্কট মোকাবেলায় অনেকে বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। এসব মাছ হারিয়ে যাওয়ার পেছনে অন্তত ১৪টি কারণ শনাক্ত করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
দেশীয় মাছের মধ্যে রয়েছে- কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, টেংরা, পুঁটি, মলা, চেলা, শৌল, বোয়াল, আইড়, ভ্যাদা, বাইম, খলিশা, ফলি, চিংড়ি, গজার, চিতল, কাকিলা, বৌরানীসহ প্রায় ৫০ প্রজাতির মাছ। অগ্রহায়ণ-পৌষ-মাঘ মাসে পুকুর, খাল, ডোবা, ঘেরের পানি কমতে থাকলে দেশী মাছ ধরার ধুম পড়ে যেত। এখন সেসব দেখা যায় না। বর্ষাকালে ধানের জমিতে কইয়া জাল, বড়শি ও চাঁই পেতে মাছ ধরার রীতিও হারিয়ে গেছে অনেক এলাকা থেকে। এক সময় যারা মাছ ধরে সংসার চালাতেন এখন তাদেরকে বাজার থেকে মাছ কিনতে হচ্ছে। দেশী মাছের আমদানি কম ও দাম বেশি হওয়ায় চাষের মাছ কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছে গ্রামের মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশীয় মাছ হারিয়ে যাওয়ার জন্য মূলত অনেকগুলো কারণ দায়ী। এর মধ্যে জলবায়ুর প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অবৈধ কারেন্ট জালের অবাধ ব্যবহার, চায়না দোয়াইর, জলাশয় দূষণ, নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, উজানে বাঁধ নির্মাণ, নদী সংশ্লিষ্ট খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়া, ডোবা ও জলাশয় ভরাট করা, মা মাছের আবাসস্থলের অভাব, ডিম ছাড়ার আগেই মা মাছ শিকার, ডোবা-নালা-পুকুর ছেঁকে মাছ ধরা, মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হওয়া। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই ১৪টি কারণে ৫০টির বেশি দেশী প্রজাতির মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে।
পাবনা মৎস্য বিভাগের একটি সূত্র জানায়, হারিয়ে যাওয়া দেশী প্রজাতির মাছের সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। হাটবাজারে এখন আর মিঠাপানির সুস্বাদু দেশী মাছ মিলছে না। দেশে হাইব্রিড জাতের সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, মিরর কার্প, কমন কার্প, বিগহেড, থাইসরপুঁটি, থাই কৈ, থাই পাঙ্গাশ, ব্ল্যাক কার্প, আফ্রিকান মাগুর, পাঁচ প্রজাতির তেলাপিয়াসহ ২৪ প্রজাতির মাছ চাষ হচ্ছে। হাইব্রিড জাতের মাছ চাষের আগে পুকুর ডোবার পানিতে নানা রকম বিষ মেশানোর কারণে মাছ, শামুক ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
মৎস্যজীবীরা জানিয়েছেন, অধিক মুনাফার আশায় হাইব্রিড মাছের চাষ করতে গিয়ে জলাশয়গুলো থেকে দেশী মাছের বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে।
বেড়া চতুরবাজারের মাছ ব্যবসায়ী সাঁথিয়া উপজেলার পানশাইল গ্রামের আদম আলী বলেন, ‘২০-২৫ বছর আগেও আমাদের এলাকায় মাছ কিনে খাওয়ার তেমন রেওয়াজ ছিল না। কেনার মধ্যে শুধু ইলিশ মাছ কেনার কথাই মনে পড়ে। মাছের প্রয়োজন হলে সবাই বাড়ির সামনে খালে বা নদীতে চলে যেত। খালে পুকুরে তখন এত মাছ ছিল যে, পানিতে নেমে খালি হাতে মাছ ধরতে পারত।
আফড়া বিলপাড়ের মৎস্য খামারি কাদের আলী বলেন, তাদের বাড়ির পাশে বিল ছিল। জন্মের পর থেকেই বিল দেখছি। ২০-২২ বছর আগে সারা বছর ধরে বাড়ির সবাই বিল থেকে মাছ ধরত। শীত মৌসুমে শত শত মানুষ পলো, জাল, ডালা, খুচন নিয়ে মাছ ধরতে নেমে যেত। কেউ কেউ খালি হাতে মাছ ধরত। এখন ওই বিল শুকিয়ে যায়। চেলা, পুঁটি, টাকি, খলিশা ছাড়া কোনো মাছ নেই।
পাবনার সুজানগর উপজেলার তালিমনগর গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, দুই দশক আগেও পদ্মা নদী সংযুক্ত এলাকার আত্রাই ও বাদাই নদীতে দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের ইলিশ পাওয়া যেত। পাওয়া যেত ১২ থেকে ১৪ কেজি ওজনের বোয়াল, পাঙ্গাশ, বাঘাইড়, কাতল ও আইড় মাছ। এমন কোনো মাছ ছিল না যা এ অঞ্চলের নদী-বিলে পাওয়া যেত না। এলাকার গাজনার বিলে জাল দিয়ে ৮ কেজি ওজনের কালবাউশ মাছ ধরেছি।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি উদ্যোগে নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, জলাশয় ও প্লাবন ভূমি পুনঃখননের মাধ্যমে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো হলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।


আরো সংবাদ



premium cement