২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কামাল ইউসুফের অবর্তমানে কে হচ্ছেন ফরিদপুরে বিএনপির কাণ্ডারি

-

স্বাধীনতার আগে ফরিদপুরের রাজনীতির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক ছিলেন প্রজাবান্ধব ও কৃষকবান্ধব জমিদার ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া ও তার পরিবারের সদস্যরা। মোহন মিয়ার বড় ভাই আব্দআল্লাহ জহির উদ্দিন লাল মিয়াও ছিলেন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী। তবে তৃণমূল থেকে মানুষকে রাজনীতিসচেতন করে তোলার ক্ষেত্রে মোহন মিয়ার সমকক্ষ ছিলেন না কেউই। ব্রিটিশ আমলে কৃষক নেতা হিসেবে তিনি অর্জন করেছিলেন উপমহাদেশব্যাপী খ্যাতি। প্রথমে মুসলিম লীগ, পরে শেরেবাংলার কৃষক শ্রমিক প্রজা পার্টি, তার পরে আবারো মুসলিম লীগের হয়ে ফরিদপুরের রাজনীতিকে শক্ত হাতে ধরে রেখেছিলেন তিনি। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো স্বাধীনতার আগে সারা পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ব্যাপক জোয়ার সৃষ্টি হলেও মোহন মিয়ার জনপ্রিয়তার কারণে ফরিদপুর সদর আসনে আওয়ামী লীগ তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বহু কষ্টে জিতলেও ভোটের ব্যবধান ছিল তেমন বেশি নয়। বৃহত্তর ফরিদপুরের (তখন ফরিদপুর জেলা) সন্তান হয়েও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদর আসনে আওয়ামী লীগের তেমন একটা ভোট বাড়াতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের বছরেই মৃত্যু হয় মোহন মিয়ার। মোহন মিয়ার মৃত্যুতে ফরিদপুরের রাজনীতিতে সৃষ্টি হয় অপূরণীয় শূন্যতা। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তার সন্তান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে জেলার রাজনীতিতে আবারো প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বৃহত্তর ফরিদপুরের প্রধান আসনটিতে বিএনপির জোয়ার সৃষ্টি হয় এ সময়ে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, ডাকসুর সাবেক জিএস এবং পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমান বিএনপিতে যোগ দেয়ায় ফরিদপুরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে বিএনপির রাজনীতি। দূরদর্শী জিয়াউর রহমান ফরিদপুরকে বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলতে বেছে নেন মোহন মিয়ার পরিবারের কাউকে।
চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ রাজনীতিতে এসেই ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর সদর আসনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার নির্বাচিত হলে তিনি কামাল ইউসুফকে প্রতিমন্ত্রী করেন। পরিচ্ছন্ন রাজনীতির কারণে দলমত নির্বিশেষে সবাই তাকে মূল্যায়ন করা শুরু করেন। এরপর আসে সামরিক শাসক এরশাদের সময়কাল। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় ফরিদপুরের ধানের শীষের ভোটাররা নৌকা ঠেকানোর লক্ষ্যে অনেকেই এরশাদের জাতীয় পার্টির প্রার্থী ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান মহাব্বতজান চৌধুরীকে লাঙল মার্কায় ভোট দেন। জিতে যায় লাঙল। নব্বইয়ের গণ আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদের পতন ঘটলে একানব্বইয়ের অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন কামাল ইবনে ইউসুফ। খালেদা জিয়ার সরকারে পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। ছিয়ানব্বইয়ের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এলেও ফরিদপুর সদর আসনে কামাল ইউসুফ ঠিকই নির্বাচিত হন। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনে আরো বেশি ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়ে চারদলীয় জোট সরকারের খাদ্য, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘সংস্কারবাদীর’ তকমা লাগায় তিনি মনোনয়নবঞ্চিত হন। চারদলীয় জোট থেকে মনোনয়ন পান জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন কামাল ইউসুফ। তিনি বিপুল ভোট পাওয়ায় মাঝখান দিয়ে জিতে যান আওয়ামী লীগ প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। বিএনপির ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ায় ’৭৩ সালের পর এ আসনে প্রথমবারের মতো পরাজিত হয় ধানের শীষ। এরপর থেকে গোটা ফরিদপুর জেলায় বিএনপিকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন কামাল ইউসুফ। ঢাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য বাদ দিয়ে দিনের পর দিন ফরিদপুরে পড়ে থেকে দলের কাজ করায় আর্থিকভাবেও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হন তিনি। তার পরের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী ইতিহাস সবারই জানা। সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কামাল ইউসুফ জামানত হারিয়েছেন এমনটাও দেখতে হয়েছে ফরিদপুর তথা দেশবাসীকে। এখন পরিচ্ছন্ন ইমেজের এই জননেতার অবর্তমানে ফরিদপুরে বিএনপির রাজনীতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব কার হাতে যাচ্ছে-এটিই এখন স্থানীয় রাজনৈতিক মহলে মূল আলোচ্য বিষয়।
কামাল ইবনে ইউসুফের অবর্তমানে এখন তাদের ময়েজ মঞ্জিল থেকে বিএনপির রাজনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারই বড় মেয়ে চৌধুরী নায়াব ইবনে ইউসুফ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি বাবার পাশাপাশি দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহ করেছিলেন এবং ওই সময়ে একটি রাজনৈতিক মামলায় জেল খেটে তিনি ময়েজ মঞ্জিলের প্রথম নারীবন্দী হিসেবে ব্যাপক আলোচনায় আসেন। সদ্য সমাপ্ত ফরিদপুর পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোট পেয়েছেন। এখন এলাকায় তিনি নিয়মিতভাবে সময় দিচ্ছেন এবং তৃণমূলে সংযোগ করে চলেছেন।
ফরিদপুর জেলা বিএনপির সর্বশেষ কমিটির সভাপতি ও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা জহিরুল হক শাহজাদা মিয়া বলেন, সাবেক মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমানের পর চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মৃত্যুতে আমরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছি। এ অঞ্চলে তাদের সমকক্ষ রাজনীতিবিদ আর নেই। তিনি বলেন, কামাল ইউসুফের রাজনীতির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল পরিচ্ছন্ন রাজনীতি। সাধারণ মানুষের জন্য তিনি কাজ করেছেন। সেই পথ ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন তার মেয়ে চৌধুরী নায়াব ইউসুফ। তিনি মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তবে আশার কথা হলো এই চরম বৈরী পরিবেশেও বিএনপির তৃণমূল ঐক্যবদ্ধ আছে। এই ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে সাথে নিয়ে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতিমুক্ত নেতাকর্মীদের নিয়ে বিএনপি এগিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (ফরিদপুর বিভাগ) শামা ওবায়েদ ইসলাম বলেন, প্রবীণ নেতা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের চলে যাওয়ার পর তার পরিবারের সদস্যরা এলাকায় কাজ করছেন। এখানে রাজনীতির মেরুকরণের বিষয় নয় বরং যারা দলের জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করবেন তারাই ভবিষ্যতে দলের নেতৃত্ব দেবেন। করোনার কারণে আমাদের সাংগঠনিক তৎপরতা বন্ধ ছিল, এখন আবার শুরু হয়েছে। শিগগিরই জেলা কমিটি ও মহানগর কমিটি হবে। তিনি বলেন, বিগত ১২ বছর ধরে বিএনপি বিরোধী দলে থাকায় অনেক নেতাকর্মী জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। এখনো অনেকের ঘাড়ে মামলা ঝুলছে। দলের ত্যাগী ও নিবেদিতদের নিয়েই কমিটি করে দলকে গতিশীল করা হবে।
বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল বলেন, কামাল ইউসুফের মৃত্যুতে আমাদের রাজনীতিতে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে আমরা আমাদের আরেক প্রবীণ নেতা কে এম ওবায়দুর রহমানকে হারিয়েছি। কামাল ইবনে ইউসুফের এলাকায় তার মেয়ে নায়াব ইবনে ইউসুফ কাজ করছেন। রাজনীতির মাঠে তিনি যত বিচরণ করবেন ততই অভিজ্ঞ হয়ে উঠবেন। তিনি বলেন, বিএনপি যেহেতু গণমানুষের দল তাই নতুন প্রজন্ম থেকেই সময়ের প্রয়োজনে তরুণ নেতৃত্ব গড়ে উঠছে।
যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি মাহবুবুল হাসান ভুঁইয়া পিংকু বলেন, ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ ফরিদপুরে বিএনপিকে প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তবে তাকে ব্যবহার করে অনেক সময় অযোগ্যরাও দলের পদ-পদবি পেয়েছেন। যারা শুধুমাত্র বিএনপি ও সহযোগী সংগঠন করার অপরাধে জেল-জুলুম হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন, যারা মাঠে ময়দানে থেকে কাজ করেছেন তাদেরকে নেতৃত্বে আনতে হবে।
ফরিদপুর জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি আফজাল হোসেন খান পলাশ বলেন, ফরিদপুরে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা চরম বৈরিতার মধ্যেও দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় রয়েছেন। তৃণমূলই দলের শক্তি। এই তৃণমূলের সমর্থনেই দলে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। আগামীতেও হবে।
এ ব্যাপারে মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী নায়াব ইউসুফ বলেন, পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যকে ধারণ করেই জনগণের কথা বলার জন্য রাজনীতির মাঠে কাজ করছি। শহীদ জিয়ার আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করার জন্য দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের প্রতি অনুরোধ করব তারা যেন মিলেমিশে কাজ করেন।


আরো সংবাদ



premium cement