২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পদ্মার বুকে ঘোড়ার গাড়ি

-

প্রমত্তা পদ্মার বুকে চলছে ঘোড়ার গাড়ি আর অটোরিকশা। পলি-বালু পড়ে ভরাট হয়ে পদ্মার তলদেশ ওপরে উঠে আসায় নদীর বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য বিশাল বিশাল চর ও ডুবোচর। সেই সাথে পদ্মা সংযুক্ত ৮৫টি নদ-নদী প্রায় পানি শূন্য হয়ে পড়ছে। এতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের শিল্প, নৌ-যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, জীববৈচিত্র্য ও কৃষি খাত হুমকীর মুখে পড়েছে।
ভারত-বাংলাদেশ ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তির পর পদ্মা নদীর বুকে চুক্তি মাফিক পানি আসেনি। পাবনা হাইড্রোলজি অফিস চুক্তির পর থেকে পানি প্রবাহের কোনো তথ্য সাংবাদিকদের দিচ্ছে না। জিজ্ঞেস করলে বলা হয়, যৌথ নদী কমিশন দিতে পারবে। পদ্মা নদীর কোনো কোনো স্থানে পায়ে হেঁটে ও মেঠো পথে ঘোড়ার গাড়িতে চলছে নদী পারাপার। পদ্মা পাড়ে এখন গাঙচিল, বেলেহাঁস আর ধবল বক দেখা যায় না। পর্যাপ্ত পানি না থাকায় প্রায় মাছ শূন্য বিশাল পদ্মা।
পদ্মায় পর্যাপ্ত পানি না থাকায় এর প্রধান শাখা নদী বড়াল, আত্রাই ও গড়াই প্রায় পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। কুষ্টিয়ার কয়ায় গড়াই নদীর ওপর নির্মিত গড়াই রেল ও রুমী ব্রিজের নিচে ধু ধু বালুচর। জিকে প্রজেক্ট কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পদ্মা, মধুমতি, নবগঙ্গা, কাজলা, মাথাভাঙ্গা, গড়াই, আত্রাই, চিকনাই, হিনসা, কুমার, সাগরখালি, কপোতাক্ষ, চন্দনাসহ পদ্মার ৮৫টি শাখা-প্রশাখা নদীর বুকে জেগে উঠেছে চরের পর চর। কোনো কোনো স্থানে বালু স্থায়ী মৃত্তিকায় রূপ নেয়ায় চলছে ফসলের আবাদ। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ ব্রিজের নিচে খাসজমিতে কৃষক চিনা বাদাম, বাঙ্গি, তরমুজ, টমেটো, আখসহ নানা রকম রবিশস্য আবাদ করেছে।
আন্তর্জাতিক নদী পদ্মার (গঙ্গা) উজানে বাঁধ দিয়েছে ভারত। ফারাক্কা ব্যারাজ দিয়ে ভাগিরথী নদীর মাধ্যমে পানির প্রবাহ ঘুরিয়ে নিয়েছে তারা। ফারাক্কার উজান পানিতে ভরপুর। ভাটির বাংলাদেশে পানি সঙ্কট ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। প্রমত্তা পদ্মার সাথে সংযুক্ত প্রধান শাখা আত্রাই, গড়াইসহ অসংখ্য নদ-নদীতে পানির টান পড়েছে। এর সুদূর প্রসারি প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলে নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। সেই সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে আর্সেনিকের মাত্রা। সেচ মৌসুমে ফারাক্কার উজান থেকে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করা হয়ে থাকে। এর প্রভাবে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ ব্যাপকভাবে কমে যায়। পদ্মা সংযুক্ত বরেন্দ্র অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত মহানন্দা, আত্রাই, বারনই, শিব, রানী ও ছোট যমুনাসহ ১২টি নদী ও ২০টি খালে এর প্রভাব পড়েছে। পলি ও বালু জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় এসব নদী-খাল এখন মৃতপ্রায়। ফলে এ অঞ্চলের সেচব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, শুধু ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প-কারখানা সবকিছুতে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। মিঠাপানি ছাড়া কৃষিকাজ ও কোনো ধরনের শিল্প-কারখানা চলতে পারে না। ফারাক্কার কারণে যশোর-খুলনা অঞ্চলে মিঠাপানির প্রবাহ কমে গেছে। ফারাক্কার কারণে পদ্মার তলদেশ ওপরে উঠে এসেছে। শুষ্ক মৌসুমে এখন পদ্মায় ইলিশ পাওয়া যায় না বললেই চলে। ইলিশ মাছ আসার জন্য যে পরিমাণ পানির প্রবাহ থাকার কথা সেটি না থাকায় এখন আর পদ্মায় ইলিশ আসে না। আগে পদ্মায় দুই শতাধিক প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ি ছিল। সেগুলোর অধিকাংশই এখন বিলুপ্তির পথে। পানি স্বল্পতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে মরুকরণ স্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পতিত হয়েছে অনেক আগেই।
এ দিকে তিস্তা নদীতে পানি না থাকায় ব্রহ্মপুত্র নদেও পানির টান পড়ায় যমুনা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। পাবনার নগরবাড়ী, বেড়া-নাকালিয়ায় যমুনা নদীর বুকজুড়ে অসংখ্য চর। বেড়ার নিকটবর্তী শাহজাদপুরের বাঘাবাড়ি ব্রিজের নিচে বড়াল নদীতে চর পড়েছে। যমুনা নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় জ্বালানি তেল ও অন্যান্য পণ্যবাহী জাহাজ অর্ধেক লোড নিয়ে বাঘাবাড়ী বন্দরে ভিড়ছে।
জানা যায়, হুগলিতে প্রবাহ আনতে গিয়ে পদ্মাকে রুগ্ন করা হয়েছে। যশোর-কুষ্টিয়ার নদীগুলো পদ্মার সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে। নদী কিশেষজ্ঞরা বলেন, পানি প্রবাহের মাত্রা ৪০ হাজার কিউসেক হলে নদীতে পলি জমতে পারে না। তলদেশও ভরাট হয় না। প্রবাহ কম বলে পদ্মার বুকে মাইলের পর মাইল চর জেগে উঠছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নদী বিশেষজ্ঞ কামরুন নেছা জানান, বাংলাদেশের পদ্মার যে বিপুল আয়তন তাতে স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টির কথা উঠতো না। কিন্তু ভারত নেপালের কোশি থেকে শুরু করে ফারাক্কা পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথে পানি প্রত্যাহারের যে একতফা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেÑ তাতে বাংলাদেশের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে।
পানি বিশেষজ্ঞদের অভিমত, উজানে ভারতের নদী কেন্দ্রিক পরিকল্পনার কারণে পলি পড়ে পদ্মা নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আর এর প্রভাবে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে পদ্মা সংযুক্ত প্রায় ৮৫টি নদী পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। পানির এই সঙ্কট কাটাতে নদীগুলো খননের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ ও রাজবাড়ীর পাংশায় গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের বিকল্প নেই বলে তারা জানিয়েছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement