২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে চলনবিল অঞ্চলের নদ-নদী-খাল

-

চলনবিল অঞ্চলের নদ-নদী, খাল-বিল দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে চলন্তবিল খ্যাত ‘চলনবিল’ দিন দিন আকারে ছোট হচ্ছে। নাব্যতাসঙ্কটে সেচকাজ যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি বিলুপ্ত হচ্ছে দেশী মাছের বিভিন্ন প্রজাতি। এর প্রভাব পড়ছে ব্যবসাবাণিজ্যেও।
জানা যায়, দীর্ঘ দিন কোনো খননকাজ হয়নি চলনবিলে। আত্রাই রিভার ড্রেজিংয়ের আওতায় কিছু নদীপথ খনন করা হলেও তা অপরিকল্পিত হওয়ায় সুফল বয়ে আনছে না। অনেক স্থানে নদীর তলদেশ থেকে কাটা মাটি অন্যত্র সরিয়ে না নিয়ে নদীবক্ষে রাখায় বর্ষা মৌসুমে সেসব মাটি আবার নদীতে যাচ্ছে। ফলে চলনবিল এলাকার খাল-বিল, নদী-নালা হারাচ্ছে স্বকীয়তা। বর্ষার পানি নদ-নদী হয়ে বিল থেকে নেমে যাওয়ার পর চলনবিলের মাঠগুলোতে এখন চলছে বিভিন্ন ফসলের আবাদ। খেশারি, সরিষা, গম, বোরো ধান, মসুর, রসুন এখন এ এলাকার প্রধান ফসল।
বিলের সাথে নদ-নদীর সংযোগ খালগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে আরো দ্রুত। চলতি মৌসুমে অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি সময়ে বেশির ভাগ নদ-নদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় অনেক নৌরুট বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো এখনো সচল আছে অল্প কিছু দিন পর সেগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। বর্তমানে কিছু মাছ পাওয়া গেলেও খুব শিগগিরই পানি শুকিয়ে যাবে। তা ছাড়া জলপথে পণ্য পরিবহনে খরচ কম হলেও নাব্যতাসঙ্কটের কারণে বছরের বেশির ভাগ সময় বেশি ব্যয়ে সড়কপথে ব্যবসায়ীদের পণ্য পরিবহন করতে হয়।
অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদ রচিত চলনবিলের ইতিকথা গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, জলপাইগুড়ির পাহাড় থেকে উৎপন্ন হওয়া আত্রাই ও গুড় নদী রাজশাহীতে এসে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর একটি শাখা কয়রাবাড়ি, নন্দনালী ও আত্রাই হয়ে আত্রাই ঘাটের এক মাইল নিম্ন থেকে ‘গুড়’ নামে সিংড়া, একান্ন বিঘা, যোগেন্দ্রনগর ও কালাকান্দরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁচকৈড় ত্রিমোহনায় নন্দ কুজার সাথে মিশেছে। এদের মিলিত স্রোত গুমানী নামে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে নূরনগরে বড়াল নদীর সাথে মিশেছে। ১৭৮৭ সালে তিস্তার সাথে আত্রাই নদীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জলপাইগুড়ির উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, নিমগাছী, তাড়াশ, চাটমোহরের হান্ডিয়াল হয়ে অষ্টমনিষার কাছে বড়াল নদীতে মিশেছে। ১৩০৪ সালে ভূমিকম্পে নদীটির কয়েকটি জায়গা মরে যায়। করতোয়ার নিম্নাংশ আত্রাই ও ফুলঝোড় নামে পরিচিত। বড়াল নদী পদ্মার চারঘাট মোহনা থেকে নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম হয়ে চাটমোহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নূরনগরে গুমানীর সাথে মিশে বড়াল নামেই ভাঙ্গুড়া ফরিদপুর বাঘাবাড়ি হয়ে হুরাসাগরের সাথে মিশে নাকালিয়া এলাকায় গিয়ে যমুনার সাথে মিশেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বীতীয়ার্ধের মাঝামাঝিতে ও নদীটি স্রোতস্বিনী থাকলেও একেবারে শেষের দিকে রাজশাহী থেকে নূরনগর পর্যন্ত নদীটির অনেক স্থানে ক্রসবাঁধ দেয়ায় এ নদীটি এখন মৃতাবস্থায় পড়ে আছে।
দক্ষিণ চলনবিলের বড়াইগ্রামের চিনাডাঙ্গা বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাটমোহরের মূলগ্রাম ফৈলজানা হয়ে ফরিদপুরের ডেমরার কাছে চিকনাই নদী বড়াল নদীতে মিশেছে। ডেমরা এলাকায় স্লøুইসগেট থাকায় ফরিদপুর থেকে নদীটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বর্ষা মৌসুমে মাস চারেক এ নদীতে পানি থাকলেও বাকি ৮ মাস পানিশূন্য থাকে নদীটি। এগুলো ছাড়া ও বানগঙ্গা, তুলশী নদী, ভাদাই নদী, মরা আত্রাই নদীর অবস্থা অত্যন্ত করুণ।
এ নদীগুলো ছাড়াও নবীর হাজীর জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লাহ খাল, নিমাইচড়া-বেশানী খাল, বেশানী-গুমানী খাল, উলিপুর-মাগুড়া খাল, দোবিলা খাল, কিশোরখালী খাল, বেহুলার খাঁড়ি, বাঁকাইখাঁড়ি, গাড়াবাড়ি-ছারুখালী খাল, জনিগাছার জোলা, খলিশাগাড়ি বিল, ধলাইর বিল, ছয়আনির বিল, বাঁইরার বিল, সাধুগাড়ী বিল, মহিষা হালটসহ চলনবিলাঞ্চলের অন্যান্য নদী, শাখা নদী, খাল, বিল, খাঁড়ি প্রায় শুকিয়ে গেছে।
চাটমোহর অনার্স কলেজের ভূগোল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান পরিবেশবিদ ড. এস এম মুক্তিমাহমুদ জানান, ভৌগোলিকভাবে এ এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো নদীর জীবন চক্রের শেষপর্যায়ে অর্থাৎ বার্ধক্য অবস্থায় পরিণত হয়েছে। লক্ষণীয় যে, চলনবিল এলাকার নদীর তলদেশের ঢালের পরিমাণ কম, নদীর প্রবাহমান পানির পরিমাণ কম, স্রোতের বেগও কম। উৎসস্থান থেকে নদীগুলোর দূরত্ব অধিক হওয়ায়, পানির সাথে প্রবাহিত মৃত্তিকাকণা, বালুকণা, নুড়িকণা এবং অন্যান্য ময়লা-আবর্জনার পরিমাণ বেশি ও নদীর তলদেশে তা সঞ্চয়নের পরিমাণও অধিক হওয়ায় ক্রমেই নদী উপত্যকার পানি ধারণক্ষমতা কমে আসছে।
চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটি ও বড়াল নদী রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান জানান, নদ-নদী, খাল-বিল চলনবিলের প্রাণ। এগুলো রক্ষা করতে না পারলে সময়ের ব্যবধানে চলনবিল স্বকীয়তা হারাবে। আমরা দীর্ঘ দিন ধরে এ এলাকার নদ-নদী রক্ষায় আন্দোলন করে আসছি। প্রাণ ফেরাতে দ্রুত নদ-নদী সঠিক নিয়মে খননের দাবি জানান তিনি।


আরো সংবাদ



premium cement