ফুল ভালোবাসে না এমন মানুষ প্রাণী জগতে পাওয়া কঠিন। আর ফুল চাষে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার গল্প এখন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে মহামারী করোনাভাইরাসের থাবায়। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার ধল্লা ইউনিয়নের ফুলের সুবাসে মুখরিত এক গ্রাম ফোর্ডনগর। তবে এই প্রজন্ম ফোর্ডনগর নয়, গোলাপ নগর নামেই বেশি চেনে গ্রামটিকে। গোলাপ নগরের ঘরের গৃহিণীরা আজ গোলাপের রানীতে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ কৃষি পরিবার অন্যান্য ফসল কম চাষ করে গোলাপ চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। অনেক ক্ষেতমজুর ও তরুণ তাদের বেকারত্ব ঘোচাতে বাহারি রঙের ফুষ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছে। তাদের সেই সাফল্যের কথা আজ আর অজানা নয়। সেই স্বাবলম্বীদের মুখের হাসি আজ বিষাদে পরিণত হয়েছে বৈশি^ক মহামারী করোনার কারণে।
সফল ফুলচাষি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ফুলকে ঘিরেই আমাদের সব কিছু। অথচ ফুল বিক্রি করতে পারছি না। ফুল গাছে শুকিয়ে যাচ্ছে। গাছ বাঁচিয়ে রাখার জন্য ফুল ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছি। শ্রমিকদের টাকাও দিতে পারছি না। সরকারি সহযোগিতা ছাড়া আর ঘুরে দাঁড়াতে পারব না। আরেক ফুলচাষি ইসহাক আলী বলেন, আমি ছয় বছরের জন্য আড়াই লাখ টাকা দিয়ে পাঁচ বিঘা জমি বর্গা নিয়েছি। ফুল চাষে প্রচুর খরচ ও পরিশ্রম। আমি, আমার মা ও স্ত্রী-কন্যা সারাদিন পরিশ্রম করছি। ফুলচাষে পরিশ্রম অনেক। প্রতিনিয়ত ফুলগাছ ছেঁটে দিতে হয়। একটাই সুবিধা, তা হলো একবার জমিতে গাছ হয়ে উঠলে ২০ বছরের মধ্যে আর রোপণ করতে হয় না। শুধু নিয়মিত সার-কীটনাশক, পানি ও ছেঁটে দিতে হবে। প্রতিবছর পানি দেয়া, নতুন শ্রমিক নিয়োগ, নিরানি ও ছাঁটাইতে লক্ষাধিক টাকা খরচ করে নিজেদের পরিশ্রম বাদে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক টাকা রোজগার করতাম। ফুলের চাহিদাও ছিলো প্রচুর। ঢাকা, গাজীপুর ও মুন্সীগঞ্জ এমনকি চট্টগ্রাম থেকেও ফুলের অর্ডার আসত। তিন-চারজনের হাত বদলে দুই টাকার গোলাপ ১০-২০ টাকাও বিক্রি হতো। কিন্তু কী দিয়ে যে কী হয়ে গেল, এখন কেউ ফুল কেনে না। ঘরের সঞ্চয় কয়দিন বসে খাওয়া যায়। এক মাস মোটামুটি চলতে পেরেছি। এখন তো দেয়ালে পিঠ লেগে গেল, আর পারছি না।
কৃষাণী সালেহা বেগম বলেন, বছরে কয়েকটি অনুষ্ঠানে ফুল বেশি বিক্রি হয়, এবার সব সর্বনাশ। শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও পয়লা বৈশাখে সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রি হয়। মনের ক্ষোভে এখন আর জমিতে যাই না, অন্য ফসলও হবে না। ফুলগুলো পচে জমি নষ্ট হয়ে গেছে। সর্বনাশা করোনায় গোলাপ বাগান এখন জঙ্গলের বাগানে পরিণত হয়েছে। টিভিতে শুনি সরকার রিলিফ দেয়, আমরা এখনো কিছুই পাইনি।
খানপাড়া চর ফোর্ডনগরের কৃষক খোরশেদ আলম বলেন, সাধারণত আমরা জমিতে যে ফসলে লাভ পাই ওই দিকেই ঝুঁকে পড়ি। সেই দিক থেকে এখন চর ফোর্ডনগরে বেশির ভাগ জমিতেই ফুল চাষ করা হয়। এখানে গোলাপ, রজনীগন্ধা ও পাতাবাহারের চাষ বেশি হয়। ফুলগুলো জমিতেই ঝরে পড়েছে। কেনার লোক নেই, এমনকি গরুতেও খায় না।
সিঙ্গাইর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ারা খাতুন বলেন, এ অঞ্চলের ফুলচাষিদের মাথায় হাত। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মহামারী করোনাকালে ফোর্ডনগরের ফুলচাষিদের জন্য বিনা সুদে স্বল্পমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক কৃষিবিদ আশরাফ উজ্জামান বলেন, চাষিরা বিভিন্ন দিবস সামনে রেখে ফুল চাষ করেন। তবে সারা বছরই ফুলের চাহিদা থাকে। মার্চ-এপ্রিল মাসে চাহিদা বাড়ে। ফুলচাষ করে জেলার অনেক চাষি স্বাবলম্বী হয়েছে। কিন্তু করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব চাষিকে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা