৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


এরশাদকে পল্লী নিবাসে দাফনের দাবি

এরশাদকে পল্লী নিবাসে সমাহিত করার দাবি জানিয়েছেন রংপুরের নেতাকর্মীরা - ছবি : নয়া দিগন্ত

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে শোক নেমে এসেছে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চল। মঙ্গলবার তার লাশ আসবে রংপুরে। বাদ জোহর কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে অনুষ্ঠিত হবে জানাযা। জানাযা শেষে তাকে তার ওছিয়তকৃত স্থান রংপুরের পল্লী নিবাসে দাফন করার দাবি তুলেছেন রংপুরের জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।

এরশাদের মৃত্যুর খবরে প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাসহ নেতাকর্মীরা জড়ো হয়েছেন রংপুরের সেন্ট্রাল রোডস্থ জাতীয় পার্টি কার্যালয়ে। এভাবে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার বিভিন্ন উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কার্যালয়ে জড়ো হয়েছেন অশ্রুসিক্ত নেতাকর্মীরা।

এরই মধ্যে আজ রোববার বেলা সোয়া ১১টায় রংপুর সেন্ট্রাল রোডস্থ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে করে প্রেসিডিয়াম সদস্য রংপুর মহানগর সভাপতি ও সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা জানিয়েছেন, “আমাদের এতিম করে দিয়ে আমাদের ‘রাজনৈতিক পিতা’ চির বিদায় নিয়েছেন। আমাদের মুখের আর ভাষা নেই। মঙ্গলবার স্যারের লাশ আসবে রংপুরে। তার জানাযা নামাজ বাদ জোহর রংপুর কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য সকল ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমাদের রাজনৈতিক পিতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এমপি মহোদয়কে তার ওছিয়তকৃত স্থান পল্লী নিবাসেই তাকে দাফন করতে হবে। অসুস্থ হওয়ার কিছুদিন আগে তিনি পার্টির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সাথে আলাপচারিতায় তার অন্তিম সমাধি রংপুরের পল্লী নিবাসে করার জন্য ওছিয়ত করে যান। সেজন্য তিনি একটি একটি সমাধি কাম কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য ডিজাইন প্লানিংও করেছিলেন। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার কারণে সেই প্লানিং তিনি জনসমক্ষে বলে যেতে পারেননি। সে কারণে আমরা জাতীয় পার্টি রংপুর বিভাগ, জেলা, মহানগরসহ সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠন এবং রংপুর বিভাগবাসীর পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টির মাননীয় চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এমপির সমাধি তার ওছিয়তকৃত স্থানে করার আকুল আবেদন জানাচ্ছি। মাননীয় চেয়ারম্যানের সমাধিকে আকড়ে ধরেই আমরা তার জীবন দর্শন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাই।”

এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রংপুর জেলা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং এরশাদের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত শাফিউল ইসলাম শাফী নয়া দিগন্তকে জানান, ‘স্যারের বাড়ির পাশেই আমার বাড়ি। গত রমজান মাসে শেষের দিকে এরশাদ স্যার আমাকে ঢাকায় জরুরী ভিত্তিতে ডেকে নিয়ে যান। সেখানে তিনি মারা গেলে নির্মাণাধীন পল্লী নিবাসেই সমাধিস্থ করার ওছিয়ত এবং একটি কমপ্লেক্স করার কথা বলেন। স্যারের শেষ ইচ্ছা জানতে পেরে আমি সমাধি কাম কমপ্লেক্সের জন্য স্যারের বাড়ির পূর্ব পাশের আমার ১৮ শতক জমি স্যারকে দিতে চাই। তখন তিনি খুশি হয়ে পল্লী নিবাস ও আমার জমিসহ একটি প্লান করে নিয়ে আসার কথা বলেন। আমি স্যারের নির্দেশের দুই দিন পর আমি রংপুর এসে সার্ভে করে স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে একটি প্রাথমিক সাইট প্লান করে ঢাকায় স্যারের প্রেসিডেন্ট পার্কে দুপুরে যাই। ওই সাইট প্লানের মধ্যে পল্লী নিবাসের নির্মানাধীন নতুন ভবনের পেছনের খালি জায়গার মধ্যস্থলে সমাধি, পূর্ব দিকে আমার জমিতে মসজিদ ও মাদরাসা কমপ্লেক্স এবং নতুন ভবনটি এরিখ এরশাদের বসবাসের জন্য নির্ধারণ করা হয়। স্যার সাইট প্লানটি দেখে উপস্থিত প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর (অব.) খালেদ আখতার, প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীর, কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক মুন্সি আব্দুল বারী, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন, ব্যক্তিগত কর্মচারী বাদশা, আব্দুস ছাত্তার, আব্দুল ওয়াহাবের সামনে একাধিকবার হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে বলেন হবে। এরপর তিনি সাইট প্লানটি ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীরকে ফাইলিং করতে বলেন। পরবর্তীতে চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে এসে জাহাঙ্গীর সাহেব সেটি ফাইলিং করেন। এবং আমার আর স্যারের জমির মাঝে থাকা দেয়ালটি ভেঙ্গে দিয়ে কাজ শুরু করার জন্য ২০ লাখ টাকার চেক দেয়ার কথা বলেন। স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এসে বিষয়টি আমি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের মহোদয়ও অবহিত করি। এসময় স্যার আমাকে বিষয়টি চুড়ান্ত করার জন্য ২৮ জুন রংপুরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। আমরা তার আসার অপেক্ষায় ছিলাম। এরই মধ্যে তিনি ২৬ জুন অসুস্থ হয়ে ভর্তি হন হাসপাতালে। আমিসহ রংপুরের আপামর জনসাধারণের দাবি স্যারের ওছিয়তকৃত স্থানেই স্যারকে দাফন করতে হবে।’

ওছিয়তের সময় রাজধানীর প্রেসিডেন্ট পার্কে উপস্থিত জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক এরশাদের আরেক ঘনিষ্টজন রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক মুন্সি আব্দুল বারী নয়া দিগন্তকে জানান, ‘আমার উপস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট পার্কে স্যার পল্লী নিবাসে তার কবর দেয়ার জন্য ওছিয়ত করেছেন। আমাকে বলেছেন, আমার কবর পল্লী নিবাসেই যেন দেয়া হয়। তিনি আমাকেও এও বলেছেন, রংপুরের মাটিতেই যেন আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ হয়, আমাকে রংপুরে পল্লী নিবাসেই কবর দেয়ার ব্যবস্থা করবে। আমি সারা জীবন যেন রংপুরের মানুষের কাছে থাকতে পারি। এসময় তার ভাতিজা প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর (অব) খালেদ আখতার, প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীর, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর, কর্মচারী ছাত্তার, ওয়াহাব, বাদশাসহ সবাই জানে। স্যার এজন্য প্লান তৈরি করে কাজ শুরু করার জন্য টাকা দেয়ারও কথা বলেন। এজন্য তিনি ২৮ জুন রংপুর আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের কপাল খারাপ। তার আগেই তিনি পৃথিবী থেকে চলে গেলেন। আমরা চাই স্যারের ওছিয়তকৃত স্থানেই স্যারের সমাধি হোক।’

রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সহ সভাপতি এরশাদ পরিবারের ঘনিষ্টজন সাবেক কাউন্সিলর আজমল হোসেন লেবু নয়া দিগন্তকে জানান, ‘তিনি বিভিন্ন সময়ে রংপুরে আলাপচারিতায় তার সমাধি রংপুরে করার কথা বলেছিলেন। এমনকি তার মা মারা যাওয়ার পর তিনি তাকে কবর দিয়ে বলেছিলেন, মায়ের কবরের পাশে ফাঁকা জায়গা রাখিও। পরবর্তীতে তিনি পল্লী নিবাসেই তার সমাধির জন্য ওছিয়ত করে গেছেন। তার সেই ইচ্ছা অনুযায়ী আমরা রংপুরেই তার সমাধি চাই।’

রংপুর সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা জাতীয় পার্টির সদস্য সচিব মাসুদার রহমান মিলন নয়া দিগন্তকে জানান, ‘আমরা স্যারের সমাধি রংপুরে চাই। এটা রংপুরের প্রতিটি নেতাকর্মীসহ সব শ্রেনী পেশার মানুষের দাবি। কারণ রংপুরে স্যারকে সমাহিত করা না হলে তার কবরের পাশে গিয়ে দোয়া করার কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার জীবন দর্শন নিয়ে সেভাবে কেউ কথাও বলবে না। রংপুরে স্যারকে ঘিরে জীবদ্দশাতে যেমন ভালোবাসা বিদ্যমান। তার অবর্তমানেও তার সমাধিকে ঘিরেও সেই ভালোবাসা বিদ্যমান থাকবে।’

রংপুর জেলা যুব সংহতির সাধারণ সম্পাদক হাসানুজ্জামান নাজিম নয়া দিগন্তকে জানান, ‘স্যারের সাথে ছিলাম। তিনি আমাদের মাঝে নেই। প্রতিদিন তার কবর জিয়ারত করতে পারি, সেজন্য তার ওছিয়তকৃত পল্লী নিবাসেই স্যারের সমাধি চাই। প্রতিটি নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ এটা চাই।’

জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও রংপুর জেলা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী আব্দুর রাজ্জাক নয়া দিগন্তকে জানান, ‘স্যারের সমাধি রংপুরের পল্লী নিবাসেই দিতে হবে। এটা আমাদের রংপুর অঞ্চলের প্রতিটি সাধারণ মানুষের দাবি। তিনি ওছিয়ত করে গেছেন পল্লী নিবাসে থাকবেন। সেখানেই তাকে দাফন করতে হবে।’

রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির নয়া দিগন্তকে জানান, ‘আমাদের রাজনৈতিক পিতা পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। রংপুরেই তাকে দাফন করতে হবে। আমরা প্রতি মুহূর্তে আমাদের পিতার সাথে থাকতে চাই।’

এ ব্যপারে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এসএম ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীর নয়া দিগন্তকে জানান, ‘স্যারের ওছিয়কৃত স্থান রংপুর পল্লী নিবাসেই স্যারকে দাফন করতে হবে। কারণ তিনি রংপুরের মাটি ও মানুষের মনের মানুষ। রংপুরের মানুষ তাঁর ভক্ত-অনুরক্ত। পল্লী নিবাসে তাকে দাফন করা হলে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তার কবর জিয়ারত করতে পারবেন। রংপুরে থেকেই তিনি যেহেতু জাতীয় ও বিশ্বনেতা। সেকারণে তাকে ঢাকাতে দাফন করা হলে তিনি জাতীয় নেতার মর্যাদা পাবেন-এটা ভুল ধারণা।’

যুক্তি তুলে ধরে জাতীয় পার্টির এই নীতির্নিধারক জানান, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় হয়েছে। তাতে কি তিনি জাতীয় নেতার মর্যাদা পাচ্ছেন না। দেশে বিদেশে বঙ্গবন্ধু অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি। সেকারণে জাতীয় নেতা হিসেবে ঢাকায় এরশাদকে দাফন করতে হবে এই আইডিয়া ঠিক নয়। রংপুরের মানুষ স্যারকে যেভাবে ভালোবেসেছে তা ইতিহাসে বিরল। তাকে তার ওছিয়তকৃত স্থানেই সমাহিত করা হলে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক দর্শন আরও বিকশিত হবে। পাশাপাশি তিনি পল্লীবন্ধু হিসেবে দেশ-বিদেশে সমাদৃত হবেন।’

এ ব্যাপারে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা নয়া দিগন্তকে জানান, ‘স্যারকে রংপুরে দাফন করার ব্যপারে রংপুরের প্রতিটি মানুষ একমত। আমিও তাদের অনুভূতির সাথে একমত পোষণ করছি। আর যেহেতু পল্লী নিবাসটি স্যার এরিখ এরশাদকে দিয়ে গেছেন সেহেতু তাকে পল্লী নিবাসে দাফন করা হলে এরিখ সবচেয়ে সম্মানিত হবে। রংপুরের মানুষের অনুভূতিকে এরিখ সম্মান জানাবে।’

গত ২৬ জুন জ্ঞান হারিয়ে রাজধানীর সিএমএইচে ভর্তি হন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আজ রোববার পৌণে আটটায় সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

প্রসঙ্গত, এরশাদের পারিবারিক নিবাস রংপুর শহরের সেনপাড়ায় স্কাইভিউতে হলেও তিনি নিজে জমি ক্রয় করে রংপুর শহরের দর্শনায় মহাসড়কের পাশে দেড় একর পল্লী নিবাস নামে তার নিজস্ব আবাসন তৈরি করেন। রংপুরে সফরে আসলে তিনি সেখান থেকেই রাত যাপনসহ সকল রাজনৈতিক, সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। গত বছর অক্টোবর মাসে পল্লী নিবাসের পুরোনো স্থাপনা ভেঙ্গে একটি আধুনিক বাড়ি নির্মানও শুরু করেন তিনি। বাড়িটির নির্মাণ কাজ প্রায় সমাপ্তির পথে। পল্লী নিবাসের পাশেই তিনি পিতার নামে মকবুল হোসেন মেমোরিয়াল ডায়াবোটিকস হাসপাতাল ও ডায়াগোলোস্টিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে স্বল্পমুল্যে অসহায় মানুষের স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি জায়গাটি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার সন্তান এরিখ এরশাদের নামে বন্দোবস্ত করে দেন।


আরো সংবাদ



premium cement