০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`


যে মোজেজা আমাদের রক্ষা করতে পারে

- ফাইল ছবি

বহু বছর আগে ডক্টর আগা ইফতেখার হুসাইনের ‘কৌমুঁ কী শেকাস্ত ও যাওয়াল কে আসবাব কা মুতালাআ’ (জাতির উত্থান-পতনের কারণ অধ্যয়ন) চোখে পড়েছিল। ডক্টর হুসাইন উর্দু, ফারসি, ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় বেশ দক্ষ ছিলেন। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দর্শন পড়েন এবং ফ্রান্স থেকে পিএইচডি করেছেন। তিনি বহু বছর ধরে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান অধ্যয়ন ও গবেষণার পর জাতির উত্থান-পতনের কারণের ওপর লেখা গ্রন্থটি জেনারেল জিয়াউল হকের মার্শাল ল’য়ের সময় লিখেছিলেন। আহমদ নাদিম কাসেমি মজলিসে তারাক্কিয়ে আদাব, লাহোরের তত্ত্বাবধানে এ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এটা সেই সময়ের কথা, যখন পাকিস্তানে স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে আগা সাহেব বলেছেন, কোনো জাতির আসল শক্তি তার সমরাস্ত্র বা সম্পদের প্রাচুর্য নয়, বরং তাদের আসল শক্তি চারিত্র্যিক মর্যাদা ও স্বাধীন চিন্তা। যে জাতি তার উন্নত চারিত্রিক মর্যাদা হারিয়ে ফেলে, সে জাতি স্বকীয়তা থেকে বঞ্চিত হয়। তারা অন্য জাতির মুখাপেক্ষী হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়।

এ গ্রন্থে আগা সাহেব ‘কুরআন ও বিবেক’ নামের অধ্যায়ে কুরআন পাকের সূরা আর-রাদের ওই আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন না করে।’ আগা সাহেব লিখেছেন, যে যুগে কুরআন নাজিল হয়েছে, সেটা ছিল ‘জোর যার মুল্লুক তার’-এর যুগ। হাজার হাজার বছর ধরে ধর্মীয় নেতারা মানুষকে এ কথা বুঝিয়েছেন- মানুষ বা জাতির উত্থান-পতন দেবতাদের হাতে, মানুষের হাতে নয়। কুরআন বলছে, জীবন-মরণ তো আল্লাহর হাতে, তবে জাতির ভবিষ্যৎ তাদের হাতে। উত্তম চরিত্রের অধিকারী জাতির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, আর মন্দ চরিত্রের অধিকারী জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

ড. ইফতেখার হুসাইনের গ্রন্থ মূলত একটি সতর্কসঙ্কেত। কেননা জেনারেল জিয়াউল হক ইসলামের নামে জাতির কাছে যে ওয়াদা করে যাচ্ছিলেন, তা পূর্ণ করা হচ্ছিল না। রাজনৈতিক দলগুলোকে দুর্বল করার জন্য বনেদি ও ভুঁঁইফোড় গ্র“পসহ সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোর তত্ত্বাবধান করা হচ্ছিল, যারা একে অন্যের বিরুদ্ধে আরোপ করছিল কুফরের ফতোয়া। আগা সাহেব তার গ্রন্থে লিখেছেন, ইমাম আবু হানিফা রহ:, ইমাম মালেক রহ:, ইমাম শাফেয়ি রহ:, ইমাম হাম্বল রহ: ও ইমাম জাফর সাদেক রহ: নিজ নিজ কিয়াস মোতাবেক ফিকাহর মাসয়ালাগুলোতে মতামত দিয়েছেন, যাতে পারস্পরিক মতভেদ ছিল। অথচ তারা সবাই একই কুরআনের অনুসারী ছিলেন এবং একে অন্যকে অনেক শ্রদ্ধা করতেন। আগা সাহেব তার গ্রন্থের মাধ্যমে জাতিকে সতর্ক করেছেন, সাম্প্রদায়িক ও ভুঁঁইফোড় গ্র“প থেকে দূরে থাকো, নতুবা ধ্বংস হয়ে যাবে।

এর কয়েক বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। কয়েকজন পাকিস্তানি বাহাদুর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কৃতিত্ব নেয়া শুরু করেন। তারা বলেছিলেন, যদি পাকিস্তান রাষ্ট্র আমেরিকার সিআইএকে সহায়তা না করত, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙত না। সম্প্রতি আবার ড. আগা ইফতেখার হুসাইনের গ্রন্থটি গভীর ধ্যানের সাথে পড়লাম। কেননা তিনি কান্ট, গাজ্জালি, ইবনে খালদুন, হেগেল, কার্লমার্কস ও টয়েনবি থেকে ইকবাল পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসবিদ ও দার্শনিকদের দর্শনকে সামনে রেখে জাতির উত্থান-পতনের যে কারণ বর্ণনা করেছেন, তা সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছিল। তাদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র ছিল; কিন্তু স্বাধীন চিন্তা ছিল না। এ গ্রন্থটি দ্বিতীয়বার অধ্যয়নে জানতে পারলাম, কুরআন এমন এক মোজেজা, যা শুধু দৈনন্দিন জীবনের চারিত্র্যিক শিক্ষাই প্রদান করে না, বরং আমাদের জাতির উত্থান-পতনের ইতিহাস ও কারণও বর্ণনা করে।

পরমাণুবিজ্ঞানী সুলতান বশীর মাহমুদ কর্তৃক লিখিত ‘কুরআনে হাকিম কি সায়েন্সি তাফসির’-এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার কুরআনের গাণিতিক তথ্য সম্বন্ধে কিছুটা জ্ঞান লাভ করেছি। কুরআনে দুনিয়া শব্দ ১১৫ বার এসেছে, আর আখেরাত শব্দও এসেছে ১১৫ বার। শয়তানের উল্লেখ হয়েছে ৮৮ বার, আর ফেরেশতার আলোচনাও এসেছে ৮৮ বার। মৃত্যুর উল্লেখ হয়েছে ১৪৫ বার, আর জীবনের আলোচনাও এসেছে ১৪৫ বার। কুফরের আলোচনা হয়েছে ২৫ বার, আর ঈমানের আলোচনাও এসেছে ২৫ বার। মাসের আলোচনা ১২ বার এবং দিনের আলোচনা ৩৬৫ বার এসেছে।

প্রফেসর ড. ফজলে করীমের গ্রন্থ ‘কুরআন কে জাদিদ সায়েন্সি এনকেশাফাত’ ও ‘কুরআনে হাকিম কে মোজেজাত’ পড়ে অনুভব করলাম, যদি দ্বীনি মাদরাসাগুলোর ছাত্ররা দ্বীন শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান পড়া শুরু করে এবং বিজ্ঞানের ছাত্ররা দ্বীন পড়া শুরু করে দেয়, তাহলে কুরআনের মাঝে নিহিত এমন অনেক রহস্য আমাদের বুঝে আসবে, যার দিকে প্রফেসর ড. ফজলে করীম ইঙ্গিত দিয়েছেন।

কুরআন আমাদের ভালো কাজের শিক্ষা দেয়, ন্যায়পরায়ণতার কথা বলে। সাথে সাথে এ কথাও বলে যে, আল্লাহর পথে খরচ করো, আর এতিম অসহায়দের দেখভাল করো। কুরআন মানবিক সাম্যের দিকে নিয়ে যায় এবং সুদকে আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বলে অভিহিত করে। সম্ভবত এ জন্যই ‘সোশালিজমের জনক’ শেখ মুহাম্মদ রশীদ তার ‘ইসলাম কা মাআশি নেযাম আওর তাহরিকে পাকিস্তান’ গ্রন্থে আল্লামা ইকবালের এ কবিতা উল্লেখ করেছেন- ইনসান কি হুস নে জিনহেঁ রাখা থা ছুপা কার/ খুলতে নযর আতে হেঁ বেতাদরিজ ওহ আসরার/ কুরআন মেঁ হো গোতাযান অ্যায় মারদে মুসলমান/ আল্লাহ কারে তুঝ কো আতা জিদ্দাত কেরদার- অর্থাৎ, মানুষের উচ্চাকাক্সক্ষা যা লুকিয়ে রেখেছিল, ধীরে ধীরে সে রহস্যের জট খুলতে দেখা যাচ্ছে। হে মুসলমান, তুমি কুরআনে নিমগ্ন হও, আল্লাহ তোমায় নতুন কীর্তি দান করবেন।

ড. আগা ইফতেখার হুসাইন ইতিহাস ও দর্শনের শিক্ষক ছিলেন। প্রফেসর ড. ফজলে করীম লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিক্যাল টেকনোলজি পড়াতেন এবং শেখ মুহাম্মদ রশীদ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জগতের সাথে যুক্ত ছিলেন। এ তিনজনের গ্রন্থে বারবার আল্লামা ইকবালের উল্লেখ পাওয়া যায়। কেননা ইকবাল মুসলমানদের কুরআনে নিমগ্ন হয়ে নতুন কীর্তি সৃষ্টির পয়গাম দিয়েছেন। আমার মতো পাপী মানুষ রমজান মাসে কুরআনের খুব কাছে যায়। এ রমজানে খাজা আব্দুল ওয়াহিদের ‘মাওযূআতে কুরআন আওর ইনসানি জিন্দেগি’ আমার পড়ার সুযোগ হলো, যা ইসলামাবাদের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র প্রকাশ করেছে। গ্রন্থটিতে আমাদের সামাজিক জীবন থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির কারণগুলোর ব্যাপারে কুরআনি শিক্ষাকে একত্র করা হয়েছে। এ গ্রন্থ পড়ে আমি ইফতেখার হুসাইনের গ্রন্থ আরো একবার পড়ার তাগিদ অনুভব করি। মনে হলো, এটি ১৯৭৯ সালের পাকিস্তানের ব্যাপারে নয়, ২০১৯ সালের পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটেই রচিত হয়েছে।

আজ পাকিস্তান রাষ্ট্রের পারমাণবিক শক্তিকে ডলারের সামনে অসহায় দেখা যাচ্ছে, কেননা স্বাধীন চিন্তা শঙ্কাগ্রস্ত এবং চারিত্র্যিক মর্যাদা নাজুক পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। যে নিজেকে ক্ষমতাধর মনে করে এবং সামনে এসে সরকারের সহায়তা ছাড়াই উত্থান-পতনে ব্যস্ত থাকে, তারও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর সামনে মাথা নোয়ানো ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। তবে আমি নিরাশ নই। আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে কুরআন রূপে যে উপঢৌকন দিয়েছেন, তা শুধুই একটি মোজেজা নয়; বরং এর ভেতরেও অনেক মোজেজা লুকিয়ে রয়েছে। আমাদের শাসকেরা এ কুরআনের আয়াত তো অবশ্যই শুনিয়ে থাকেন, তবে তার ওপর আমল করেন না। যেদিন কুরআনের আয়াতের ওপর আমল করে আমরা সবাই নিজেদের বদলানোর প্রস্তুতি নেবো, সেদিন আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবেন। পতন থেকে আইএমএফ নয়, বরং আমাদের রাসূল সা:-এর মোজেজা আমাদের বাঁচাতে পারে; যার নাম কুরআন।

হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)
পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২৩ মে ২০১৯ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement