০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`


দলটি মরিয়া প্রমাণ করিল...

-

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এবারের নির্বাচন প্রমাণ করেছে, খালেদা জিয়ার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। দলীয় সরকারের অধীনে দেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। তিনি বলেছেন, ‘নজিরবিহীন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও ভোট ডাকাতির নির্বাচনের ফলাফল পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করছি।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘জীবিত ও মৃত’-এর একটি বিখ্যাত উক্তি- ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে (আগের বারে) মরে নাই’, তেমন ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপিকে আওয়ামী সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েই প্রমাণ করতে হলো, দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারে না। যে আশঙ্কায় বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে যেতে ভয় পেয়েছিল; কূলকিনারাহীন বিএনপির জন্য এবারকার নির্বাচনে আরো ভয়াবহ ‘সুনামি’ হয়ে ফিরে এলো। অর্থাৎ বিএনপি এবার মরিয়া প্রমাণ করিল ‘২০১৪-এর নির্বাচনেও তারা মরিত’।

রাজনীতিতে দেশপ্রেমিক লড়াকু সৈনিক দরকার। সুবিধাবাদী কিছু লোক নিয়ে রাজনীতি চলে না। ড. কামাল হোসেন ও মির্জা ফখরুল ইসলাম ভোট বিপ্লব ও কেন্দ্র পাহারার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাস্তবে তাদের কথার প্রতিফলন মাঠপর্যায়ে দেখা যায়নি। নির্বাচন কোনো যেনতেন খেলা নয়। দূরদর্শী কৌশল, অর্থ আর পেশিশক্তির খেলা। রাজনৈতিক চালে জটিল আর কুটিলতা থাকলেও বাইরে থাকতে হয় নিখুঁত পরিকল্পনা, পরিপক্ব প্রদর্শন; থাকবে সুনিপুণ আয়োজন। কিছু দিন ভিডিও বার্তা দেয়া ও ঘরের মধ্যে বসে লিখিত ভাষণ দিয়ে রাজনীতি চলে না।

ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের সারা দেশের ভোট পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘স্বৈরাচারী এরশাদের আমলেও এ রকম নির্বাচন হয়নি। বিরোধী দলের এজেন্ট দূরের কথা, ভোটারদেরও কেন্দ্রে যেতে দেয়া হয়নি। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এটি দেখতে হবে, ভাবতেও কষ্ট হয়। সারা দেশে ক্ষমতাসীন দল ত্রাস সৃষ্টি করেছে, দেশের মালিকানা হাতছাড়া হয়ে গেছে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয়বার জয়ের কারণে দায়িত্বও শতগুণ বেড়েছে। এই নির্বাচন আওয়ামী লীগ তথা প্রধানমন্ত্রীকে এক কঠিন পরীক্ষা, দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। দেশের প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেল। টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা একটি দলের নেতাকর্মীর মধ্যে অহঙ্কার, দম্ভ, হামবড়া ভাব আসাই স্বাভাবিক।

নেতাকর্মীরা জনগণকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পারেন। অনেকেই মনে করতে পারেন ক্ষমতা মানে সব কিছু আওয়ামী লীগের দখলে থাকবে।
বিগত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ যেমন অনেক ভালো কাজ করেছে, তেমনি অনেক বিষয়ে সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে। তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই এ সমালোচনার ইস্যুগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতের অনিয়ম দূর করতে হবে। গুম-খুনের অভিযোগের ব্যাপারে সহিষ্ণুতার নীতিতে আসতে হবে। আওয়ামী লীগকে দুর্নীতি বন্ধে কঠোর হতে হবে। এমনকি নিজের দলের কাউকে ছাড় দেয়া যাবে না। প্রধানমন্ত্রীকে সুশাসনের ব্যাপারে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে এ নিশ্চয়তা দিতে হবে, অন্তত রাজনৈতিক সহিংসতায় মানুষ মরবে না, আর কোনো মায়ের বুক খালি হবে না। চাকরির পরীক্ষায় দলীয় পরিচয় চলবে না। গ্রামগঞ্জে, পাড়া-মহল্লায়, পাতিনেতা, কুটিনেতা পরিচয়ে দৌরাত্ম্য ও চাঁদাবাজি চলবে না।

প্রকৃতপক্ষে ২৮৮ আসন নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়নি। সরকার হিসেবে শক্তিশালী হয়েছে মাত্র। আর এতে জিতেছে সরকার, হেরেছে বাংলাদেশ, পরাজিত হয়েছে জনগণ। এই জয় কতখানি গৌরবের?

নৌকা এবং ধানের শীষের ভোটের পার্থক্য বিশ্বাসযোগ্য কি? ডিজিটাল যুগে মানুষের চোখ-কান খোলা রয়েছে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও খাজানা যাদের হাতে ছিল; পরাজয়ের ভয় কেন তাদের থাকবে? কেন একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে ব্যর্থ তারা? সুষ্ঠু ভোট হলে কী এমন ক্ষতি হতো!

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ভারত, নেপাল, সার্ক ও ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) নির্বাচনী পর্যবেক্ষকেরা। তাদের মতে, শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে ভোট শেষ হয়েছে। সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন ও ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অতীতের চেয়ে অনেকাংশে ভালো, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। বিদেশী পর্যবেক্ষকেরা সরকারি দলকে সন্তুষ্ট করতে পারবেন, ভোটারদের নয়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, ‘ভোট নিয়ে তিনি তৃপ্ত-সন্তুষ্ট। ভোটে কোনো অনিয়ম হয়নি। ভোটে তারা লজ্জিত নন, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে।’ এ ছাড়াও ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে।’ সিইসির কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চান, কেন্দ্রে কেন ধানের শীষের কোনো এজেন্ট নেই? জবাবে সিইসি বলেন, ‘তারা (ধানের শীষের এজেন্ট) না এলে তিনি কী করতে পারেন?’ প্রধান নির্বাচন কমিশনার যদিও বলেছেন, ‘ধানের শীষের এজেন্টরা কেন্দ্রে না এলে কী করার? তারা কেন্দ্রে কেন আসেননি বা কেন কোনো এজেন্ট নেই, সেটি প্রার্থীর নির্ধারিত এজেন্টরাই বলতে পারবেন।’ দায়িত্বশীল পদে থেকে এই যুক্তি নিজের দায়িত্বকে অস্বীকার কারা ছাড়া আর কিছু নয়।

শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া সরকার কী পরিমাণ জবাবদিহিহীন চলতে পারে, তা চিন্তা করা যায় না। একক ক্ষমতার বলে সরকারি দল সব কিছু ইচ্ছেমতো করে যাবে, যেটা গণতান্ত্রিক দেশে মোটেই হওয়া উচিত নয়। গণতন্ত্রে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা দরকার। দুর্বল বিরোধী দল গণতন্ত্র বিকাশের অন্তরায়।
abunoman1972@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement