২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক প্রভাব

সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই

-

দেশের ব্যাংক খাতে নাজুক পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ ‘রাজনৈতিক বিবেচনা’ নামের এক অদৃশ্য ভূত। গত প্রায় দুই যুগ ধরে ব্যাংক খাতের ঘাড়ে এই ভূত যেন সিন্দবাদের মতোই চেপে বসে আছে। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বারবার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে রাজনৈতিক বিবেচনা সরিয়ে রাখতে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি।
একটি সহযোগী দৈনিকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এখনো সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকিং বিষয়ে অভিজ্ঞতা না থাকলেও শুধু তদবির ও লবিংয়ের জোরে অনেকে পরিচালক হয়ে পর্ষদে বসে যাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিচালকেরা ব্যাংকগুলোকে পেশাদারিত্বের সাথে বা প্রতিযোগিতামূলক পরিচালনা করতে পারছেন না। সামাল দিতে পারছেন না প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক মহলের চাপ। এতে ঘটছে জাল-জালিয়াতির ঘটনা। আবার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ পর্ষদের কাছে জাল-জালিয়াতির তথ্য আড়াল করলেও অনেকে অনভিজ্ঞতার কারণে তা যথাসময়ে শনাক্ত করে প্রতিকার করতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয় অনিয়ম ও দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। চরম আর্থিক দৈন্যদশায় পড়েছে প্রায় সব ব্যাংক।
খবরে বলা হয়, রাজনৈতিক বিবেচনায় যারা পরিচালক হয়ে পর্ষদে বসছেন, তাদের মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন অনভিজ্ঞ বর্তমান ও সাবেক আমলা, রাজনৈতিক ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, শিক্ষক এবং স্বল্পসংখ্যক ব্যাংকার। বিধান অনুযায়ী, ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা বার্ষিক সাধারণ সভার মাধ্যমে পরিচালক নিয়োগ দেয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে সে বিধান অনুসরণ করা হয় না। বেসিক ব্যাংকে নানা অনিয়ম, সোনালী ব্যাংক, হলমার্ক ও জনতা ব্যাংকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের জালিয়াতির ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেছেন, ‘ব্যাংকের পরিচালক কে হবেন, তা চেয়ারম্যান হয়েও আমি জানতাম না। একদিন বোর্ড সভা করছি। এর মধ্যে এক ব্যক্তি একটি চিঠি নিয়ে এসে বলে, ‘আমি ব্যাংকের পরিচালক।’ এমন হলে পরিচালকেরাই বা কী করবে? ব্যাংকিং খাতের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে রাজনৈতিক প্রভাব কতটা গভীরে প্রোথিত হয়েছে এ বক্তব্যে তা স্পষ্ট।
এ দিকে, গত বুধবার জনতা ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘যারা বোঝে না, তাদের ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে রাখব না, এটা খেলার জায়গা নয়... একজন একজন করে দেখে দেখে ইন্টারভিউ নিয়ে ব্যাংকের পর্ষদে পাঠাব। অভিজ্ঞতা ছাড়া কোনো পরিচালক নিয়োগ দেয়া হবে না।’
অর্থমন্ত্রী এর আগেও খেলাপি ঋণ আদায়সহ অর্থনীতির বিভিন্ন ইস্যুতে দৃশ্যত ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কতটা সফল হবেন, সেটি দেখার জন্য জাতিকে আরো অপেক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বিভিন্ন সময় এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ব্যাংকগুলোতে অভিজ্ঞ ও দক্ষ পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিতে হবে; তাহলে ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে চলতে পারে। বর্তমানে যেভাবে পর্ষদ নিয়োগ করা হয় তাতে শুধু আইনগত বাধ্যবাধকতা পূরণ করা হচ্ছে। বাস্তবতা অনুসরণ করা হয় না।
কয়েক মাস আগে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে এক মূল্যায়নে উল্লেখ করেছে, দেশের ব্যাংক খাত নষ্ট রাজনীতির শিকার। একে সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু তারা আমানতকারীদের পরিবর্তে নষ্ট ও ভ্রষ্ট লোকের স্বার্থ রক্ষা করছেন। ব্যাংকিং বিভাগের একজন সাবেক সচিব নির্বাচনের আগে খেলাপি ঋণ আদায়ে চাপাচাপি করার বিপক্ষে লিখিত মতামত রেখে গেছেন। এ অবস্থা পুরো অর্থনীতিকে গ্রাস করে ফেলছে। ভালো ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা এগোতে পারছেন না।
রাজনীতির প্রভাব কিভাবে পুরো ব্যাংকিং খাতকে গ্রাস করে ফেলেছে এবং তার কুফল কিভাবে জাতীয় অর্থনীতিকে বিপন্ন করে তুলছে, এরই কিছু নমুনা এখানে তুলে ধরা হলো। আমরা আশা করতে চাই, জাতীয় স্বার্থে ব্যাংকসহ সার্বিক অর্থনীতির খাতে শ্ঙ্খৃলা ফিরিয়ে আনতে সরকার রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার থেকে বিরত হবে এবং অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন নিশ্চিত করার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।


আরো সংবাদ



premium cement