২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


খেলাপি ঋণ লাগামহীন

প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা

-

খেলাপি ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তথ্য অনুযায়ী, দেশে খেলাপি ঋণের বর্তমান পরিমাণ এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। দীর্ঘ দিন ধরে আদায় করতে না পারায় ব্যাংকগুলোর অবলুপ্ত করা ঋণের পরিমাণ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। একটি সহযোগী দৈনিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে চার গুণের বেশি।
অর্থাৎ শিল্প-বাণিজ্য-ব্যবসার সাথে জড়িত একশ্রেণীর প্রভাবশালী মানুষের কাছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেয়াটাই যেন দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রবণতার কারণে ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি ধস নামছে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতি। ‘ঋণের টাকায় ঘি খাওয়া’র এই প্রবণতা একদিনে হয়নি। ঋণ আদায়ে আইনের দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এটিকে একধরনের জাতীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ঋণগ্রহীতারা আদালতে মামলা করে ঋণ আদায়ে ব্যাংকের উদ্যোগ স্থগিত করে দেন। প্রভাব খাটিয়ে ঋণের পুনঃতফসিল করিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান। কেউ কেউ দেশ ছেড়েই পালিয়ে গেছেন। ফলে প্রতিদিন বাড়ছে খেলাপির পরিমাণ।
ঋণখেলাপি হওয়ার পেছনে শুধু ঋণগ্রহীতারাই এককভাবে দায়ী নন; ব্যাংকগুলোও দায়ী। কারণ অনেক সময় ঋণ দিতে তার বিপরীতে কোনো সম্পদ বন্ধক রাখার নিয়ম মানা হয় না অথবা বন্ধকী সম্পত্তির কাগজপত্র পরীক্ষা করা হয় না। ভুয়া নামে ঋণ দেয়ার অভিযোগও আছে। এতে করে সত্যিকারের বিনিয়োগকারীরা বঞ্চিত হন।
কথা উঠেছে যে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের যোগসাজশেই বেশির ভাগ অনিয়ম হয়ে থাকে। সেই সাথে আছে রাজনৈতিক প্রভাব ও পৃষ্ঠপোষকতা। গত কয়েক বছরে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক, ফারমার্স, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের ঋণ-জালিয়াতির কথা এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য।
একটি সহযোগী দৈনিকের প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনা এবং ব্যাংকগুলোর অনিয়ম দূর করার উপায় নিয়ে বিশিষ্ট ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য ও পরামর্শ তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, খেলাপি ঋণ কমাতে হলে সবার আগে পুনঃতফসিলীকরণ বন্ধ করতে হবে। শুধু ‘মেরিট’ রয়েছে এ ধরনের কেসই পুনঃতফসিল হতে পারে। ঋণখেলাপির মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। করপোরেট গ্যারান্টির নামে যেসব অনিয়ম হচ্ছে সেগুলো বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেছেন, ঋণ-সংক্রান্ত রিট নিষ্পত্তির জন্য সময় বেঁধে দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই নিষ্পত্তি করতে হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বৃহৎ ঋণখেলাপিদের ধরতে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে সব ধরনের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেছেন, খেলাপি ঋণ কমাতে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এ জন্য ব্যাংকিং খাতকে পুরোপুরি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদের মেয়াদ কমিয়ে আনতে হবে। তারা জবাবদিহির ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন।
নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে ১৭ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে, কোনো ঋণগ্রহীতা খেলাপি হওয়ার পর আদালতে রিট করতে চাইলে তাকে নিজ ঋণের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ আদায় করতে এবং এ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকাতে একটি লিগ্যাল অ্যাকশন টিম গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ-তদারকি ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করার নির্দেশও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
আমাদের বিশ্বাস, উন্নয়নের অঙ্গীকার করে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন সরকার এ বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে এবং অর্থনীতির অবাধ বিকাশে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement