১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরাইলের জবাব পর্যালোচনা করছে হামাস

-

- নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে হামলায় শিশুসহ নিহত ১৫
- যুদ্ধের প্রতিবাদকারী নারী অধ্যাপকের সাথে বর্বরতা মার্কিন পুলিশের

গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি এবং বন্দী বিনিময়ের জন্য একটি নতুন প্রস্তাব প্রকাশ করেছে ইসরাইল। ওই প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখছে হামাস। গাজায় যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল হামাস। জবাবে পাল্টা একটি প্রস্তাব দিয়েছে ইসরাইল। হামাসের মুখপাত্র খলিল আল হাইয়া গতকাল শনিবার কাতার থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আলজাজিরা, রয়টার্স ও সিএনএন।
হামাসের রাজনৈতিক শাখার উপপ্রধান খলিল আল-হাইয়া এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে শনিবার বলেন, ‘হামাস আজ আমাদের অবস্থানের বিষয়ে ইহুদি আধিপত্যবাদীদের আনুষ্ঠানিক সাড়ার একটি সঙ্কেত গ্রহণ করেছে। হামাসের পক্ষ থেকে মিসর ও কাতারের মধ্যস্থতাকারীদের এ বিষয়ে ১৩ এপ্রিল তথ্য সরবরাহ করা হয়েছিল।’ খলিল আল-হাইয়া আরো বলেন, ‘হামাস এখন এই প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখবে। পর্যালোচনা শেষে হামাস এ বিষয়ে তার সাড়া দেবে।’
জানা গেছে, নতুন প্রস্তাবে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়নি। তবে হামাসের কাছে ২০ জনেরও বেশি ইসরাইলি বন্দীকে মুক্তি দেয়ার দাবি করা হয়েছে। এর আগে ৪০ জন বন্দীর মুক্তি দাবি করা হয়েছিল। এই প্রস্তাবে গাজায় কয়েক সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি এবং এই সময়ের মধ্যে ছিটমহল থেকে ইসরাইলি বাহিনী প্রত্যাহার করার কথা বলা হয়েছে। তবে ইসরাইলি বন্দীর বিনিময়ে কতজন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেয়া হবে তা পরে নির্ধারণ করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নতুন এই প্রস্তাবের অধীনে পরে ইসরাইল গাজায় সামরিক অভিযান পুনরায় শুরু করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হবে না। এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক গ্যারান্টিরও প্রয়োজন হবে না।

হামাস এর আগে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিল তবে তা প্রত্যাখ্যান করেছিল ইসরাইল। কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতা-দূতিয়ালিতে গত ২৫ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অস্থায়ী বিরতি ঘোষণা করেছিল হামাস-আইডিএফ। সেই বিরতির সময় নিজেদের কব্জায় থাকা বন্দীদের মধ্যে ১০৮ জন বন্দীকে মুক্তি দিয়েছিল হামাস। অন্য দিকে দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী ফিলিস্তিনিদের মধ্যে থেকে ১৫০ জনকে কারাগার থেকে ছেড়ে দিয়েছিল ইসরাইলও। ওই বিরতি শেষ হওয়ার পর গাজায় দ্বিতীয় দফা যুদ্ধবিরতির জন্য কাজ করছিল মধ্যস্থতাকারী তিন দেশ। চলতি বছর রমজান মাস থেকে তা শুরু হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু মূলত ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর আপত্তির কারণে তা আর হয়নি। ফলে হামাসের কব্জায় থাকা বাকি ১৩২ জন বন্দীর ভাগ্য কী ঘটেছে, এখনো অজানা।

কাতার ও মিসরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অবশিষ্ট বন্দীদের মুক্তির জন্য প্রথম দফা বিরতির পর দ্বিতীয়বার যুদ্ধবিরতির জন্য একাধিকবার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে হামাস ও ইসরাইলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার কাছে। কিন্তু প্রতিটি প্রস্তাবে হামাস স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং গাজা উপত্যকা থেকে ইসরাইলি সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে এবং এই দাবির কারণে সেসব প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি ইসরাইল।
দুই পক্ষের মতানৈক্যের কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসন এবং বন্দীদের মুক্তির পথ তৈরি করতে বৃহস্পতিবার ইসরাইল সফরে যায় মিসরের একটি সরকারি প্রতিনিধিদল। ওই দিনই হামাসের কব্জায় থাকা বন্দীদের মুক্তির আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেয় যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ ১৭টি দেশ।

হামাসের সিনিয়র নেতারা গত ১২ বছর ধরে কাতারে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। সম্প্রতি কাতার ইঙ্গিত দিয়েছে, যদি গাজায় যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে হামাসের ভূমিকা ইতিবাচক না হয় তাহলে কাতার ছাড়তে হবে হামাস নেতাদের। বৃহস্পতিবার ১৭টি দেশের চিঠি প্রসঙ্গে প্রাথমিক এক প্রতিক্রিয়ায় হামাস নেতারা বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক চাপের কাছে তারা মাথা নত করবেন না।
তবে কয়েক ঘণ্টা পরই তারা ফের বলেন, ‘ফিলিস্তিনের জনগণের আকাক্সক্ষা ও অধিকারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো প্রস্তাবকে হামাস স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।’ মিসরের প্রতিনিধিদলের এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ১৩ এপ্রিল পাঠানো প্রস্তাবে ৩৩ জন বন্দীকে মুক্তি দিতে সম্মতি জানিয়েছে হামাস।

রাফায় লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না ইসরাইল : হামাস
এ দিকে হামাসের সিনিয়র নেতা গাজী হামাদ বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, দক্ষিণ গাজার রাফা শহরে অভিযানের মাধ্যমে ইসরাইল কোনো লক্ষ্যই অর্জন করতে পারবে না। তারা হামাসকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হবে এবং বন্দীদেরও মুক্ত করতে পারবে না। ২৫ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার হামাদ কাতার থেকে ফোনে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ইসরাইল রাফায় প্রবেশ করে সামরিক অভিযান চালাতে পারে, কিন্তু তারা যা চায় তা অর্জন করতে পারবে না।’ হামাদ আরো বলেছেন, ‘ইসরাইল গাজা উপত্যকায় প্রায় সাত মাস কাটিয়েছে। অবরুদ্ধ এই ছিটমহলের সমস্ত অঞ্চলে তারা হামলা করেছে এবং অনেক ধ্বংস করেছে। তবে এখনো পর্যন্ত হামাসকে নির্মূল করা বা বন্দীদের মুক্ত করতে পারেনি। এগুলোই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল। অথচ তারা মূল লক্ষ্যগুলোর কিছুই অর্জন করতে পারেনি।’

আন্তর্জাতিক ক্ষোভ এবং উদ্বেগ সত্ত্বেও ইসরাইল রাফাতে পরিকল্পিত সামরিক অভিযান চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শহরটিতে বর্তমানে ১৫ লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি বাস করছে। গাজার অন্যান্য এলাকা থেকে ইসরাইলি হামলার কবল থেকে বাঁচার জন্য এই ফিলিস্তিনিরা রাফায় আশ্রয় নিয়েছিল। এ রকম অবস্থায় রাফায় সামরিক অভিযান চালালে বিপুল সংখ্যক বেসামরিক হতাহতের আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া ইসরাইলের প্রধান মিত্র এবং অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও রাফাতে সৈন্য পাঠানোর বিরুদ্ধে ইসরাইলকে সতর্ক করেছে। হামাদ বলেছেন, ‘আমরা সঙ্ঘাতের সাথে জড়িত সব পক্ষের সাথে কথা বলেছি। রাফা আক্রমণের ভয়াবহতা উল্লেখ করেছি। ইসরাইল অতিরিক্ত গণহত্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’

নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে হামলা : মধ্য গাজার নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি বোমা হামলায় নারী ও শিশুসহ ১৫ জন নিহত হয়েছে। শনিবার সকালে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দু’টি পৃথক বোমা তারা নিহত হন। ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফার বরাতে আলজাজিরা এই তথ্য জানিয়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরাইলি হামলায় শেষ ২৪ ঘণ্টায় ৩২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৬৯ জন। সেই সাথে গাজায় মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার ৩৮৮ জন। আর আহত হয়েছেন ৭৭ হাজার ৪৩৭ জন।
পশ্চিম তীরে গ্রেফতার ২০ : পশ্চিম তীর থেকে অন্তত ২০ জন ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করেছে ইসরাইলি বাহিনী। গতকাল শনিবার তাদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ফিলিস্তিনি বন্দী সোসাইটি। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা এ খবর জানিয়েছে। ফিলিস্তিনি বন্দী সোসাইটি জানিয়েছে, পশ্চিম তীর থেকে অন্তত ২০ জন ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করেছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। এদের মধ্যে শিশু ও সাবেক কারাবন্দীও রয়েছেন। গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের পর থেকেই পশ্চিম তীরের বাসিন্দাদের গ্রেফতার করছে ইসরাইলি বাহিনী। পর্যবেক্ষণকারীরা জানিয়েছেন, ইসরাইলি আগ্রাসনের সাত মাসে অন্তত আট হাজার ৪৮০ জন ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করে ইসরাইলে নিয়ে গেছে দেশটির সামরিক বাহিনী।

অধ্যাপককে মাটিতে ফেলে গ্রেফতার : যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গাজা যুদ্ধবিরোধী ফিলিস্তিনপন্থী প্রতিবাদ আরো জোরদার হওয়ার মধ্যে এক মার্কিন অধ্যাপক পুলিশ কর্তৃক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। এই নারী অধ্যাপককে মাটিতে উপুড় করে ফেলে তার হাত পিছমোড়া করে হ্যান্ড কাফ পরিয়েছে পুলিশ। সিএনএনের সাংবাদিকদের রেকর্ড করা এক ভিডিওতে দেখা গেছে, আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনপন্থী প্রতিবাদ চলার সময় পুলিশ কর্মকর্তারা এক বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীকে মাটিতে ফেলে জোরজবরদস্তি গ্রেফতার করার চেষ্টা করছে, এ সময় ওই শিক্ষার্থীকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলতে বলতে সেদিকে এগিয়ে যান অধ্যাপক ক্যারোলাইন ফলিন। তিনি পুলিশ সদস্যদের ওই শিক্ষার্থীকে ‘ছেড়ে দিতে’ বলতে থাকলে পাশ থেকে আরেক পুলিশ কর্মকর্তা এসে তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে ল্যাং দিয়ে মাটিতে ফেলে দেন। আরো এক পুলিশ কর্মকর্তা এতে যোগ দিয়ে ফলিনকে মাটিতে ঠেসে ধরতে সহকর্মীকে সাহায্য করেন। এই দুই পুলিশ কর্মকর্তা অধ্যাপক ফলিনের হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলেন। এ সময় ফলিন বারবার বলছিলেন, ‘আমি একজন অধ্যাপক।’

যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ফিলিস্তিনপন্থী এই প্রতিবাদ প্রথমে শুরু হয় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, তা এখনো শিক্ষার্থীদের এই প্রতিবাদ আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে আছে। বুধবার ও বৃহস্পতিবার ভোররাত পর্যন্ত লস অ্যাঞ্জেলেস, বোস্টন ও টেক্সাসের অস্টিনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে দুই শতাধিক প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে ফের প্রতিবাদ শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারপরও বিক্ষোভ থামছে না। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে চোখ, ত্বকে জ্বালা ধরানো রাসায়নিক পদার্থ ও টেইজার ব্যবহার করেছে পুলিশ। যুক্তরাষ্ট্রের বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, প্রতিবাদের মাধ্যমে তারা গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল