১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিজরি
`

যুক্তরাষ্ট্র যে কারণে চাঁদে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটাতে চেয়েছিল

যুক্তরাষ্ট্র যে কারণে চাঁদে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটাতে চেয়েছিল। - ছবি : সংগৃহীত

১৯৫০-এর দশকে ইউএসএসআর বা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন মহাকাশ জয়ের দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা এক অদ্ভূত পরিকল্পনা করেছিলেন। সেটি হচ্ছে, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভয় দেখানোর জন্য চন্দ্রপৃষ্ঠে পরমাণু হামলা।

এরপরে ১৯৬৯ সালে মহাকাশচারী নিল আর্মস্ট্রং যখন চন্দ্রপৃষ্ঠে তার পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছিলেন তা নিঃসন্দেহে ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটি।

কিন্তু যে চাঁদে আর্মস্ট্রং পা রেখেছিলেন সেখানে যদি বিশালাকার গর্ত আর পরমাণু বোমার বিষাক্ততায় পরিপূর্ণ থাকত, তাহলে কেমন হতো?

চাঁদ নিয়ে গবেষণার ‘লুনার রিসার্চ ফ্লাইট-ভলিউম ১’ প্রথমবার পড়তে গেলে মনে হবে যে এটি একেবারেই আমলাতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ। যে ধরনের কাগজপত্র সাধারণত সহজেই নজর এড়িয়ে যায়। আর এটাই ছিল সম্ভবত মূল উদ্দেশ্য।

তবে যাই হোক মলাটের দিকে নজর দিলে তা একটু আলাদাই মনে হয়।

এর কেন্দ্রের দিকে একটি ঢালের চিত্র খচিত। যাতে একটি পরমাণু, একটি বোমা ও একটি মাশরুমের মতো মেঘের প্রতীক রয়েছে। এটি আসলে নিউ মেক্সিকোতে অবস্থিত কির্টল্যান্ড বিমান ঘাটিতে থাকা বিমান বাহিনীর বিশেষ অস্ত্রগার কেন্দ্রের প্রতীক। ওই ঘাটিটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

একদম নিচের দিকে লেখকের নাম উল্লেখ রয়েছে- এল রেইফেল বা লেনার্ড রেইফেল। যিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত পারমাণবিক পদার্থবিদ। তিনি কাজ করতেন এনরিকো ফার্মির সাথে। এনরিকো ফার্মি ছিলেন বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক রিঅ্যাকটর বা পারমাণবিক চুল্লীর নির্মাতা। যাকে ‘পারমাণবিক বোমার স্থপতি’ বলা হয়।

প্রজেক্ট এওয়ানওয়াননাইন বা এ১১৯ নামে পরিচিত ওই প্রকল্পটি ছিল চন্দ্রপৃষ্ঠে হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণের একটি অতি-গোপনীয় প্রস্তাব। ১৯৪৫ সালে হিরোশিমায় যে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছিল, হাইড্রোজেন বোমা তার চেয়ে আরো অনেক বেশি বিধ্বংসী। একই সাথে এটি ছিল ওই সময়ে নকশা করা পারমাণবিক বোমার মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক সংযোজন।

বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ‘দ্রুত বাস্তবায়নের’ নির্দেশ পাওয়া ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিকল্পনার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অংশ হিসেবে ১৯৫৮ থেকে ১৯৫৯ সালের মধ্যে রেইফেল অনেকগুলো প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন।

অবিশ্বাস্যভাবে একজন বিজ্ঞানী ভয়ঙ্কর পরিকল্পনাটি অনুমোদন করেছিলেন। তিনি হচ্ছেন ভবিষ্যতের স্বপ্নদর্শী হিসেবে পরিচিত কার্ল সেগান। বাস্তবে ওই প্রকল্পের অস্তিত্ব জানা যায় ১৯৯০ এর দশকে। কারণ, সেগান একটি অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়ে করা তার আবেদনে এর উল্লেখ করেছিলেন।

যদিও এটি চাঁদ সম্পর্কিত কিছু প্রাথমিক বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, কিন্তু প্রজেক্ট এ১১৯-এর মূল উদ্দেশ্য ছিল শক্তি প্রদর্শন। বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটার কথা ছিল টার্মিনেটর লাইন নামে একটি রেখায়। রেখাটি চাঁদের আলোকিত ও অন্ধকার অংশের সীমান্ত রেখা।

এর উদ্দেশ্য ছিল আলোর উজ্জ্বল ঝলকানি তৈরি করা যেন যে কেউ খালি চোখে এটি দেখতে পারে, বিশেষ করে ক্রেমলিন থেকে। বায়ুমণ্ডল না থাকার মানে হচ্ছে, সেখানে কোনো মাশরুমের মতো মেঘ তৈরি হবে না।

এ ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা প্রস্তাবের একটি মাত্র বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা রয়েছে এবং এটির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির কারণ নিরাপত্তাহীনতা ও হতাশার মধ্যে নিহিত।

১৯৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ু যুদ্ধে জয় পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও জনপ্রিয় মতবাদগুলোর মধ্যে প্রচলিত ছিল যে পরমাণু অস্ত্রাগার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, বিশেষ করে অস্ত্রের উন্নয়ন, সংখ্যা, পারমাণবিক বোম্বার ও পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রে।

১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবার হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। তিন বছর পর সোভিয়েতরা তাদের নিজস্ব বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ওয়াশিংটনের তাক লাগিয়ে দেয়। ১৯৫৭ সালে তারা আরো একধাপ এগিয়ে যায়, স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপণ করে মহাকাশ জয়ের দৌড়ে নেতৃস্থানে চলে যায়। স্পুটনিক-১ ছিল কক্ষপথে পাঠানো বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের করে স্পুটনিকের উৎক্ষেপণ এবং ‘কৃত্রিম চন্দ্র’ উৎক্ষেপণের মার্কিন নিজস্ব প্রচেষ্টা বিশালাকার বিস্ফোরণের মাধ্যমে ব্যর্থ হওয়া- কোনটিই স্বস্তিদায়ক ছিল না। ভ্যানগার্ড নামে তাদের প্রথম রকেটটি যেভাবে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল, তার চিত্র ধারণ করে পুরো বিশ্বে দেখানো হয়েছিল। ওই সময় ব্রিটিশ একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল- ‘ভ্যানগার্ড ব্যর্থ হয়েছে... প্রকৃতপক্ষেই একটি বড় ধাক্কা... মর্যাদা আর প্রোপাগান্ডার দুনিয়ায়...’।

ওই সময় হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগামী শিশুদের বিখ্যাত ‘ডাক অ্যান্ড কাভার’ নামে তথ্যচিত্র দেখানো হতো, যেখানে বার্ট নামে একটি অ্যানিমেটেড কচ্ছপ চরিত্র শিশুদের শেখাতো যে পারমাণবিক হামলা হলে কী করতে হবে।

ওই বছরের পরের দিকে, একজন জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রগুলো (দ্য ডেইল টাইমস, নিউ ফিলাডেলফিয়া, ওহাইয়ো) প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে বলা হয় যে ‘সোভিয়েতরা ৭ নভেম্বর তাদের বিপ্লবের বর্ষপূর্তীতে চাঁদে হাইড্রোজেন বোমা নিক্ষেপ করবে।’ এরপরের প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, ‘সোভিয়েতরা সম্ভবত এরইমধ্যে আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশীর ওপর পরমাণু অস্ত্র-সমৃদ্ধ রকেট নিক্ষেপের পরিকল্পনা করছে।’

স্নায়ুযুদ্ধ সম্পর্কিত গুজবগুলোর মতোই ওই প্রতিবেদনের উৎস পাওয়াটা সম্ভব ছিল না।

আশ্চর্য্যজনকভাবে এ ভয় সোভিয়েতদেরকে তাদের পরিকল্পনা তৈরি করতে উৎসাহিত করে। কোডনেমড ইফোর নামে তাদের একটি পরিকল্পনা হুবহু মার্কিনিদের নকল করে তৈরি করা হয়েছিল এবং পরে অবশ্য সোভিয়েতরা আশঙ্কা থেকে তা নাকোচও করেছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল যে উৎক্ষেপণ ব্যর্থ হলে বোমা সোভিয়েত মাটিতেই আঘাত হানবে। এ আশঙ্কার বর্ণনা তারা ‘অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত আন্তর্জাতিক ঘটনা’ হিসেবে প্রকাশ করেছিল।

তারা হয়ত খুব সাধারণভাবেই অনুধাবন করেছিল যে চাঁদে অবতরণ করা এর চেয়ে বড় পুরস্কার হয়ে উঠবে।

কিন্তু প্রজেক্ট এ১১৯ কাজ করেছিল।

২০০০ সালে রেইফেল এ বিষয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি নিশ্চিত করেন, এটা ‘প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব’ ছিল এবং পৃথিবী থেকেই বিস্ফোরণটি দেখা যেত।

বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ সত্ত্বেও চাঁদের পরিবেশের আদি অবস্থা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর মাথাব্যথা ছিল না।

বিজ্ঞান ও পরমাণু বিষয়ক ইতিহাসবিদ অ্যালেক্স ওয়েলারস্টেইন বলেন, ‘প্রজেক্ট এ১১৯ ছিল ওই সময় স্পুটনিকের বিপরীতে ভেসে বেড়ানো অনেকগুলো পরিকল্পনার একটি। এসব পরিকল্পনার মধ্যে ছিল স্পুটনিক গুলি করে নামানো, যা ছিল খুবই বিরক্তিকর। এগুলোকে স্টান্ট হিসেবে দেখা হতো, যা মানুষকে মুগ্ধ করার জন্য নকশা করা হয়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘পরে তারা নিজেদের স্যাটেলাইট পাঠিয়েছিল, যদিও এটা বেশ সময় নিয়েছিল, কিন্তু তারা ওই প্রকল্প যেকোনোভাবেই হোক না কেন গুরুত্ব সহকারে চালিয়ে যাচ্ছিল, অন্তত ১৯৫০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত।’

অ্যালেক্স ওয়েলারস্টেইন বলেন, ‘তখন এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মনোজগতের বেশ আকর্ষণীয় চিন্তা। এ তাড়না তাদেরকে এমন একটি প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করেছিল, যা থেকে খুব প্রশংসনীয় কিছু তৈরি হয়েছিল। আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ও ভয়ঙ্কর- দুটি ধারণা পরস্পরের খুব কাছাকাছি ছিল।’

তবে তিনি এটা নিশ্চিত নন যে কমিউনিস্ট বিরোধী চিন্তা-চেতনা পারমাণবিক পদার্থবিদকে এ প্রকল্পে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলে কি-না।

তিনি বলেন, ‘এসব পদে যারা থাকেন, তারা সম্ভবত অনেক ক্ষেত্রে নিজ থেকেই যোগ দেন। এ ধরনের কাজ করতে তাদের কোনো আপত্তি থাকে না। স্নায়ুযুদ্ধে অনেক বিজ্ঞানীই এ ধরনের কাজ করেছেন। তারা বলতেন যে পদার্থবিদ্যাকে অনেক বেশি রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে।’

ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে এ ধরনের আরো আত্ম-উপলব্ধি পাওয়া যায়।

মহাশূণ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ব্লেডিন বাওয়েন বলেন, ‘’প্রজেক্ট এ১১৯ আমার কাছে দ্য সিম্পসনের ওই ঘটনার মতো মনে হয়, যখন লিসা তার দেয়ালে নেলসনের ‘নিউ দ্য হোয়েলসের পোস্টার’ দেখতে পান এবং তিনি বলেন, ‘বেশ, তোমাকেও কিছু একটা তৈরি করতে হবে।’’

ব্লেডিন বাওয়েন বলেন, ‘এগুলো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ছিল, কিন্তু স্পেস কমিউনিটি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর তারা এ বিষয়ে কোনো তহবিল বা মনোযোগ পাননি। এটা ছিল ৫০-এর দশকের শেষের দিক ও ৬০-এর দশকের শুরুর দিকের মহাকাশ নিয়ে বিপুল আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার আগে কেউ জানত না যে মহাকাশযুগ আসলে কোন দিকে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘ওই চন্দ্র হিস্টেরিয়ার মতো পরিস্থিতি যদি আবার তৈরি হতে থাকে, তাহলে তা আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত আইনের পরিপন্থী হবে বলে বিশ্বের প্রায় সব দেশই সম্মত হয়েছে। আমি শুনেছি যে বিভিন্ন জায়গা এবং পেন্টাগন থেকে এ ধরনের আওয়াজ আসছে যে চাঁদের পরিবেশ পর্যবেক্ষনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ বাহিনীর মিশনের দিকে নজর রয়েছে।’

এর চেয়ে অদ্ভূত কোনো চিন্তা যদি যুক্তরাষ্ট্রে স্থান না পায় তার মানে এই নয় তা চীনের মতো আরো দূরবর্তী কোনো দেশ গিয়ে স্থান পাবে না।

ব্লেডিন বাওয়েন আরো বলেন, ‘আমি অবাক হবো না যদি চীনের কোনো একটি সম্প্রদায় এ ধরনের কোনো চিন্তা বাস্তবায়ন করতে চায় কারণ তারা মনে করে যে চাঁদ ঠান্ডা এবং তারা সামরিক বাহিনীতে কাজ করে।’

প্রজেক্ট এ১১৯-এর বেশিরভাগ বর্ণনা এখনো রহস্য ঘেরা। এর অনেক অংশই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।

এর মূল্য শিক্ষা হচ্ছে, আসলে কোনো গবেষণাপত্রকে আগে না পড়ে ঢালাওভাবে তাকে আমলাতান্ত্রিক নাম দিয়ে অভিহিত করা উচিত নয়।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement