৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


অসুস্থ রাজনীতির যত অনুষঙ্গ

অসুস্থ রাজনীতির যত অনুষঙ্গ - নয়া দিগন্ত

নিরবচ্ছিন্নভাবে অঘটন, অপহরণ, শৃঙ্খলাভঙ্গ, সীমাহীন বৈষম্য সেই সাথে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা জঙ্গিদের আস্তানা। এ বিষয়গুলোর হঠাৎ এমন ‘মাশরুম গ্রোথ’কে বিজ্ঞজন বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা বলে মানতে রাজি নন। তাদের ধারণা, পর্দার অন্তরাল থেকে সুতোর টানে পুতুল নাচ শুরু হয়েছে। আবার কোনো চিন্তকদের অনুমান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর ‘চৌকস’ সদস্যরা এখন দেশে চলমান ‘রাজনৈতিক যুদ্ধে’ প্রভাবশালী মহলের অগ্রবর্তী বাহিনীর ‘যোদ্ধা’ হিসেবে এতটাই ব্যস্ত-সমস্ত তাদের আর ঘাড় ফেরানোর অবকাশ নেই। সে জন্য অন্যদিকে কিভাবে মন দেবে। ফলে শহর, বন্দর, নগর তথা গোটা দেশের শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব একপাশে ফেলে রেখে তারা যুদ্ধে মন দিয়েছেন। সে কারণে সমাজে দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য সীমা ছাড়িয়েছে। এসব অঘটন এখন হয়তো অতীতের সব নজিরকে মøান করে দিতে পার । এর তুলনাটা এমনো হতে পারে- কোথাও কখন কোনো স্থানে বায়ুশূন্য হয়ে পড়লে চতুরপাশ থেকে প্রবল গতিবেগ নিয়ে হাওয়া ছুটে আসে। বায়ুশূন্যতা দূর করতে এবং প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়। সব ওলটপালট করে ফেলে। এভাবে সমাজের যদি সামগ্রিক শৃঙ্খলার শূন্যতা সৃষ্টি হয় সে ক্ষেত্রে বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা-অনিয়ম ও অনাচার বিস্তৃতি লাভ করতেই থাকবে। সমাজ চিন্তকদের এমন ধারণা অমূলক নয়। তারা মনে করেন, চলমান অসুস্থ রাজনীতির সাথে এর একটি গভীর সংযোগ রয়েছে। কেননা, সমাজ থেকে শৃঙ্খলা উধাও হলে সে সুযোগে দুর্বৃত্তরা ছুটে আসে। হাতে ওজিএল নিয়ে এবং দৌরাত্ম্যের রাজত্ব কায়েম হয়।

সমাজচিন্তকদের এমন ধারণাও অমূলক নয়। তারা মনে করেন, হালের রাজনীতি এখন অসুস্থ। তারা আরো মনে করেন, উপরোক্ত অপশক্তির অসুস্থ রাজনীতির সাথে একটা গভীর সংযোগ রয়েছে। মানুষ অসুস্থ হলে যেমন নানা সমস্যায়-দুর্বলতা দেহে বাসা বাঁধে। নানা অসুখ-বিসুখ তখন দেহে হিতচিন্তাও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বাংলাদেশের রুগ্ণ রাজনীতির ফল এসব। রাষ্ট্রযন্ত্রে এসব ফাঁকফোকর প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয়েছে। সেই ফাঁকফোকর দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের দেহ থেকে যেমন সারনির্যাস বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার সেই পথ দিয়েই ঢুকছে যত হলাহল। সমাজে প্রতিটি মানুষ সেটি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। যেসব বিশেষণমূলক শব্দাবলি দিয়ে এ নিবন্ধের সূচনা। সেগুলো ‘ওযো’ গুণ অসামান্য। কিন্তু সেই শব্দাবলির প্রতিটির ব্যাখ্যা বা তা নিয়ে কথা বললে বহু সময় ও স্পেসের প্রয়োজন, দুটিরই অভাব রয়েছে। আমাদের পাঠকরা বিজ্ঞ। যেসব শব্দ নিয়ে নীরব থাকব তার ব্যাখ্যা অবশ্যই তারা নিজেদের জ্ঞান গরিমা দিয়ে সেগুলোর ভেদ করতে সক্ষম হবেন, আমাদের বিশ্বাস।

এখন সেই বিশেষণমূলক শব্দগুলোর কয়েকটি নিয়ে কথা বলতে চাই। উপরে বলা হয়েছে বিশৃঙ্খলার কথা। সেই শৃঙ্খলা সব বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণে সমাজে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের চেষ্টা হচ্ছে। স¤প্রতি তার চিত্র দেখতে পাওয়া গেছে। দৈনিক নয়া দিগন্তের স¤প্রতি প্রকাশিত একটি খবরে। নয়া দিগন্তের দ্বিতীয় শীর্ষ খবর হিসেবে সেটি প্রকাশিত হয়েছে। সে খবরে চিত্রটি হচ্ছে, এমন-

ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার আজিমনগর ইউপির সীমার মধ্যে দুই গ্রামবাসীর ভেতর রক্তক্ষয়ী এক সংঘর্ষ ঘটেছে। ওই সংঘর্ষের সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয়টি হচ্ছে, ব্যান্ড বাজিয়ে দুই গ্রামবাসী পরস্পর ওই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। শুধু ব্যান্ড বাজানো নয়। মাইকে ঘোষণা দিয়ে তারা একে অপরকে মোকাবেলা করার জন্য আমন্ত্রণ জানায় দেশী অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে। এই ঘটনাটির ব্যাখ্যা হয়তো এমন হতে পারে। প্রচলিত সালিসি ব্যবস্থা বিচার নিষ্পত্তির প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে। দেশের আইন ও অস্ত্র উভয়ই তারা হাতে তুলে নিয়েছিল। ভ্রাতৃঘাতী এই লড়াইয়ে। সুবিচার পাওয়ার আস্থাহীনতা আজ আর ফরিদপুরের ভাঙ্গাতে শুধু নয়; বরং খুঁজতে হবে দেশের কোন প্রান্তে এখন সালিস দরবার নিয়ে মানুষের আস্থা অটুট আছে। কোথাও সেই আস্থাকে এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। আস্থাহীন সমাজ জীবন। হাল ভাঙা তরীর মতো এখন একই অবস্থানে ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কেউ কি এখন এই আস্থা পোষণ করতে পারেন। সে দুর্বৃত্তদের হাতে অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে পরে। তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবে না।

একেবারে হালে এমন বহু ঘটনাই ঘটছে। এমন বাস্তবতা দেশের নাগরিকদের মনে উদ্বেগ ও চিত্তচাঞ্চল্য সৃষ্টি করছে। সমাজের এমন সব অসুখ দূর করা যাবে কিভাবে। কথায় আছে সরিষার ভেতর ভূত থাকলে সেই সরিষা দিয়ে ভূত তাড়ানো যায় না। মানুষ এখন তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা কাকে বা কোথায় শোনাবে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের একটি গান আছে, আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল/কেহ শুধাইলনা মোরে। মানুষের এখন এমনই অবস্থা। তার শোক-দুঃখের সব কথা অব্যক্ত থেকে যাচ্ছে। এই মনোবেদন আজ উপেক্ষিত হতে পারে। কিন্তু একদিন সেটি বজ্রনিনাদে অনেকের মাথার ওপর আছড়ে পড়তে পারে। এসব কোনো আশঙ্কা নয়। অতীতে বহুবার এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে।

অপহরণ শব্দটি সূচনাতে সন্নিবেশিত রয়েছে। গত ২৯ আগস্ট দু’টি জাতীয় দৈনিকে অপহরণের দু’টি ঘটনার খবর রয়েছে। অপহরণের যে খবরটি প্রথমে উল্লেখ করা হচ্ছে সেটি গাজীপুর থেকে সাত মাসের এক শিশু অপহৃত হয়। মাত্র ৭ ঘণ্টার মধ্যে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় দূর বগুড়া শহরে। শিশুটিকে পুলিশ উদ্ধার করেছে ত্বরিত গতিতে। নিশ্চয়ই বিষয়টি প্রশংসনীয়। কিন্তু মধ্যবয়সী সুখরঞ্জন বালিকে অপহরণ করা হয়েছিল। নাকি তিনি পালিয়ে ভারতে কারাগারে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেটি আল্লাহ ভালো জানেন। তাছাড়া সব জানাটাও ঠিক নয়। এটি আজকের সমাজবাস্তবতা বলে দিচ্ছে। সব জানলে বিপদ হবে। আর প্রকাশ করলে আরো বড় বিপদের কারণ ঘটবে। দ্বিতীয় ঘটনা হচ্ছে, ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে ১৬ বছরের এক কিশোরকে তার এক বন্ধু তাকে চট্টগ্রামে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। সে বন্ধুটির অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। বন্ধুকে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করাই ছিল সেই ‘বন্ধুটি’র উদ্দেশ্য। কিন্তু সেই কিশোরের কাছে যখন মনে হলো এটি ঝুঁকিপূর্ণ তখন সে বন্ধুকে খুন করাকে সহজ বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেটি করেও ফেলল। কথা হচ্ছে, আমাদের সমাজ আজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। একটি ১৬ বছরের কিশোর এমন ভয়ঙ্কর একটি সিদ্ধান্ত নিতে সে কোনো দ্বিধা করেনি। প্রতিদিনই প্রায় শোনা যায়, কিশোর গ্যাংদের হরেক যত অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী। এ নিয়ে যাদের ভীতসন্ত্রস্ত হওয়া ও প্রতিবিধান করার কথা তাদের ভাবার সময় নেই। যাক না সমাজ রসাতলে, ব্যক্তি হিসেবে আমার তাতে ক্ষতি কতটুকু।

বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে বৈষম্যের কথা উল্লেখ রয়েছে। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছে সম্ভবত এসব কিছু নয়। যেমন অতি স¤প্রতি সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়। অথচ দেশে কোটি কোটি মানুষের জীবন এখন অর্থকষ্টে ওষ্ঠাগত। তাদের কথা কেউ ভাবছে না। তেলে মাথায় তেল দেয়ার মতো বিষয়টি। এমন পদক্ষেপের পেছনে কেউ কেউ রাজনীতির গন্ধ খুঁজে পাচ্ছেন। সম্মুখে নির্বাচনের সময় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভূমিকা যাতে সরকারের জন্য ইতিবাচক হয়। দলীয় স্বার্থে দেশের জনসাধারণকে বঞ্চিত করা কি নীতি-নৈতিকতার পরিপন্থী নয়! অবশ্য এমন বোধ তখন জাগতে পারে যখন এসবের মূল্য বুঝতে চেষ্টা করা হয়।

সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সরকারের প্রতিপক্ষদের ‘শায়েস্তা’ করতেই নাকে পুলিশ সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে বেশির ভাগ ফৌজদারি মামলার বিচারকার্যক্রম বাধাগ্রস্ত ও কখনো কখনো দুর্বল হয়ে পড়ে। এখন বিরোধী শিবিরের নেতাদের ফাঁসাতে যেসব ফৌজদারি মামলা হচ্ছে। তাতে বাধা হচ্ছে সাক্ষীদের নিয়ে। এসব সাক্ষীর অনেকে মামলায় হাজিরা দিতে আসতে চাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে তাদের বাধ্য করার ব্যবস্থা হিসেবে নির্দেশ জারি করা হয়েছে। জানি না এমন বাধ্যতামূলক নির্দেশ কোনো অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে কি না। এটি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সদস্যদেরই মূলত হেনস্তা করার একটি প্রয়াস। এসব দেশের রাজনীতিতে প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি করবে। অসুস্থ রাজনীতির অনুষঙ্গ হিসেবে বিষয়গুলো বিবেচিত হতে বাধ্য। স্মরণ করা যেতে পারে, দেশের এখন যত সঙ্কট রয়েছে তার মধ্যে মানুষের অধিকারসমূহ সব চেয়ে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এমন অধিকারগুলো সর্বজনীন হলেও তার প্রতি প্রশাসনের নির্লিপ্ততা অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে।

ndigantababar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
বরিশালে আইএইচটির ২ ছাত্রকে তুলে নিয়ে ছাত্রলীগের মারধর খালে পাওয়া ‘টর্পেডো’টি বাংলাদেশের নয় : ওসি হেলাল উদ্দিন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী ট্রাস্টের মহিলা মাহফিল অনুষ্ঠিত বগুড়ায় বসতবাড়িতে পটকা তৈরির কারখানা বিস্ফোরণে আহত ৪ কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অভিযানে আটক ৩ জামালপুরে সেচ পাম্পে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট কৃষকের মৃত্যু রাজশাহীর পদ্মায় ডুবে তাবলিগ জামাতের সদস্যের মৃত্যু খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু জবি শিক্ষককে হেনস্তা সতর্ক করেই দায় সেরেছে প্রশাসন আল্লামা জুলকারনাইনের ইন্তেকাল

সকল