১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলকদ ১৪৪৫
`


মানসিক স্বাস্থ্যপরিষেবা, বাস্তবতার নিরিখে

মানসিক স্বাস্থ্যপরিষেবা, বাস্তবতার নিরিখে - ফাইল ছবি

ইদানীং পত্রপত্রিকায় প্রায়ই সচিত্র প্রতিবেদন দেখা যায়, ছেলে বা মেয়েকে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখে মা-বাবা বাইরে গেছেন কাজে। বেঁধে রাখার কারণ তারা মানসিকভাবে অসুস্থ। এটি সামগ্রিক চিত্রের ছিটেফোঁটা মাত্র। সামগ্রিক চিত্রটি আরো ভয়াবহ, আরো লোমহর্ষক। ১৫ এপ্রিল ২০২২ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণাপত্রে (Mental health Atlas Country profile 2020 Bangladesh) জানানো হয়েছে, সারা দেশে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ২৭০ জন, মনোরোগ নার্স-৭০০, মনোবিজ্ঞানী ৫৬৫ জন। মানসিক রোগ সম্পর্কিত জনশক্তি এক হাজার ৭১০ জন। পক্ষান্তরে মানসিক রোগে ভোগেন পূর্ণবয়স্ক জনসংখ্যার ১৮.৭ শতাংশ, ৭-১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে এর প্রার্দুভাব দেখা যায়। ষাটোর্র্ধ্ব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মানসিক রোগের প্রাবল্য অন্যদের তুলনায় বেশি। ষাটোর্র্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে ২০.২ শতাংশ, ৫০-৫৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে ১৯.৪ শতাংশ, ৪০-৪৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, ৩০-৩৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে ১১.৫ শতাংশ, ১৮-২৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে ১১শতাংশ ব্যক্তি কোনো না কোনো ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে সামগ্রিকভাবে চিকিৎসার সুযোগ পান ৭.৭ শতাংশ।

বর্তমানে স্বাস্থ্য বাজেটের ০.৫ শতাংশ মানসিক রোগের জন্য ব্যয়িত হয়। সারা দেশের বিশাল সংখ্যক মানসিক রোগীর দেখভালের জন্য রয়েছে দু’টি হাসপাতাল এবং সাধারণ হাসপাতালের সাথে ৫৬টি ইউনিট। এর মধ্যে পাবনা মানসিক হাসপাতাল নিজেই অব্যবস্থার শিকার। প্রতি এক লাখ মানসিক রোগীর জন্য রয়েছেন ১.১৭ জন চিকিৎসক। বিশেষজ্ঞ সঙ্কটের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে রয়েছে চিকিৎসা সঙ্কট। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে এক কোটি ৭৭ লাখ মানসিক রোগী রয়েছে। ক্রমেই এ সংখ্যা বাড়ছে। অথচ এ ব্যাপারে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিমালায় যথাযথ কর্মকৌশলের অভাব রয়েছে। অভাব রয়েছে এ সমস্যা মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা ও জনশক্তির তৈরির পরিকল্পনার। ২০১৮-১৯ সালের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়ষ্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১৭ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে মানসিক সমস্যার ভুগছেন। জরিপে জানা গেছে, ১৮ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ চিকিৎসা নেয় না। এ ব্যাপারে তাদের অভিভাবকরা খুব একটা সচেতন বলে প্রতীয়মান হয়নি।

এসব শিশু-কিশোরের বেশির ভাগেরই সমস্যার পেছনে রয়েছে ইন্টারনেটের ভূমিকা। ইন্টারনেটকে পুরোপুরি দায়ী করে ২৬.১ শতাংশ ছাত্র। ৫১.৮ শতাংশ শিক্ষার্থী মোটামুটিভাবে দায়ী করে ইন্টারনেটকে। এক হাজার ৭৭৩ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে জরিপের ফলাফল এটি। ২১.৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রী নিজেকে অন্যদের থেকে অযোগ্য মনে করে সামাজিক মাধ্যমে ভূমিকার ক্ষেত্রে; যা তাদেরকে বিষণ্ণতায় ভোগায়- এমনকি কেউ কেউ আত্মহত্যার পথেও পা বাড়ায়। কিশোর-কিশোরীদের অবারিত জীবনাচার, পারিবারিক জীবনে অশান্তি-কলহ মানসিক রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর ভেতর মানিয়ে চলার অভাব, উচ্ছৃঙ্খল জীবন স্বামী-স্ত্রীকে যেমন মানসকিভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে, তেমনি সন্তানদের মধ্যেও এর বিরূপ প্রভাব ফেলে। সামাজিক অস্থিরতা, বিচারহীনতা- দুর্নীতি সাধারণ মানুষের জীবনবোধের ওপর আঘাত করে সুগম করে মানসিক রোগের পথ। আর্থিক অসচ্ছলতা মানসিক রোগ সৃষ্টির আরেকটি বড় কারণ। করোনার প্রভাব মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। শিক্ষাঙ্গনে নৈতিকতা, চারিত্রিক শুদ্ধতা- এসবের অভাব ছাত্রছাত্রীদের মন ও মানসিকতার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে। পরিণতিতে তুচ্ছ কারণে বিবাদ, মারামারি, খুনোখুনি এখন প্রাত্যহিক ঘটনা। ক্রমবর্ধমান আত্মহত্যার ঘটনা এরই প্রতিফলন। সর্বনাশা এ অবস্থার মোকাবেলায় প্রয়োজন সার্বিক ব্যবস্থাপনা। এ ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ, শিক্ষাঙ্গন ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমন্বিত কর্মকৌশল প্রয়োজন। নৈতিক শিক্ষা, ইন্টারনেটের অপব্যবহার রোধ, নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতাসহ পরিপূর্ণ জবাবদিহির ব্যবস্থা রোধ করতে পারে এই বিধ্বংসী প্রবণতা।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যপরিষেবা কার্যক্রমে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা একীভূত করা প্রয়োজন। প্রয়োজন প্রতি হাসপাতালে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বহির্বিভাগ এবং মনোবিজ্ঞান পরিষেবা ব্যবস্থা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যতিক্রমী আচরণসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় মনো সহায়তার ব্যবস্থা এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বয়ঃসন্ধিক্ষণে কিশোর-কিশোরীদের মনে সামাজিক পরিবেশ, পারিবারিক জীবনাচার, দুর্নীতি, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, খুন-খারাবি, ছিনতাই, রাজনৈতিক অসহনশীলতা প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে। পরিণতিতে মানসিক বৈকল্যের শিকার হয় তারা। সাধারণ জনগণ তো বটেই, চিকিৎসক সমাজের অনেকেই এ ব্যাপারে সচেতন নন। সার্বিক সচেতনতা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সুদূর পরাহত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের সাহায্য করলে আমরা এ সমস্যার ব্যাপারে এগিয়ে আসব- এসব অসার চিন্তাবিলাসের সময় এখন নয়। এক কোটিরও বেশি মানসিক রোগীর ব্যাপারে নিজস্ব অর্থায়নে নিজস্ব কর্মযজ্ঞ শুরু করা প্রয়োজন।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ২০১৯ সালের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ওপর পরিচালিত জরিপের আলোকে তৈরি পরামর্শ এখনো অন্তর্ভুক্তি লাভ করেনি আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্যপরিষেবা অভিযোজনে। এর প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে গিয়ে যে স্বাস্থ্য পরিষেবা তা অপূর্ণই থেকে যাবে। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে এ ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষই পারে দেশ জাতিকে এগিয়ে নিতে। জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ অসুস্থ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে স্মার্ট জাতি গঠন কোনোক্রমেই সম্ভব নয়, এটি আমাদের সবারই বোঝা প্রয়োজন।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement