০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নজিরবিহীন দুর্নীতির মহারাজার আত্মকথা

লেখক গোলাম মাওলা রনি - ছবি : নয়া দিগন্ত

সাধারণ আমজনতা আমাকে দুর্নীতির মহারাজা বলে থাকেন। তাত্ত্বিকরা বলেন, আমি নাকি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দুর্নীতির বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। যারা শিল্প সাহিত্য নিয়ে মেতে থাকেন তারা- মোজার্ট-বিটোফেন-রবিশঙ্করের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতে শুনতে বলেন, আমি নাকি দুর্নীতিকে রীতিমতো শিল্পের মর্যাদা দিয়েছি। কিছু বোকা মানুষ বলে থাকেন- আমি হলাম দুর্নীতির মহাসাগরের নীল তিমি। আমাকে নিয়ে কেউ কবিতা রচনায় হাত দিয়েছে। আবার কেউবা চলচ্চিত্র-নাটক-যাত্রাপালা তৈরির চিন্তা করছে। লোকজনের আদিখ্যেতা দেখে আমার শরীর রি রি করছে। মেজাজ নষ্ট হচ্ছে। তারপরও জনস্বার্থে আজকের আত্মকথা লিখতে বসেছি। আজ আমি আপনাদেরকে অকপটে জানাব, কিভাবে আমি আজকের অবস্থানে পৌঁছালাম।

আলোচনার শুরুতেই আমি প্রকৃতিকে ধন্যবাদ দিতে চাই। এখানে প্রকৃতির পরিবর্তে আমি আল্লাহ শব্দটি ব্যবহার করতে পারতাম। কিন্তু জীবনের বেশির ভাগ সময় আমি আল্লাহ খোদার তোয়াক্কা করিনি। ধর্ম-কর্ম নীতি-নৈতিকতা আমি লাঠি-গুলি-বন্দুকের কাছে বন্ধক রেখেছিলাম। ভোগ-বিলাস, জুলুম-অত্যাচার-দুর্বৃত্তপনা ও অহঙ্কার প্রদর্শনের আগে-পরে আমার মনে কোনোকালে খোদাভীতি কাজ করেনি। কিন্তু হাল আমলে নানা রকম বালা-মুসিবত, ঝক্কি ঝামেলার কবলে পড়ে আমার বারবার মনে হচ্ছে- বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, যিনি চূড়ান্ত বিচারের মালিক। সুতরাং আজকের আত্মকথনে আমি রাতারাতি আল্লাহর নাম নিয়ে তাকে ধন্যবাদ দেয়ার সাহস পাচ্ছি না। কারণ তিনি আমাকে যা দিয়েছিলেন তা যদি আমি আল্লাহর ওয়াস্তে ব্যবহার করতাম তবে একজন ভালো মানুষরূপে সম্মান ও মর্যাদার সাথে কবরে যাওয়ার সুযোগ পেতাম। কিন্তু আমি তা না করে কিভাবে আল্লাহর নাফরমানি করেছি, সে কথা বলেই আত্মকথন শুরু করতে চাই।

জন্মগতভাবে আমি দুটো জিনিস পেয়েছিলাম। প্রথমটি হলো- আমার বুদ্ধিমত্তা এবং দ্বিতীয়টি হলো- আমার সুন্দর অবয়ব, অর্থাৎ সুন্দর চেহারা সুরত। আমার চেহারা সুরতের কারণে আমি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকতাম। বিষয়টি আমি নেতিবাচক অর্থে গ্রহণ করতে থাকি। নিজের শারীরিক সৌন্দর্যের জন্য আমার মধ্যে এক ধরনের অহঙ্কার তৈরি হয়। দ্বিতীয়, যারা আমাকে ভালোবাসত আমি তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য শুরু করি। তৃতীয়ত, আমি আমাকে ভালোবাসা মানুষগুলোর দুর্বলতার আশ্রয় নিয়ে প্রতারণা বিশ্বাসভঙ্গ এবং ঠকবাজি শুরু করি। এতে করে আমার চরিত্রের কতগুলো মৌলিক অসঙ্গতি শুরু হয়ে যায়। প্রথমত, আমার যৌনজীবন রীতিমতো অনাচার, ব্যভিচার ও বিকৃত আচরণে রূপ নেয়।

দ্বিতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদে আমার সাথে কারোরই বন্ধুত্ব তৈরি হয়নি। আমার এই অভ্যাসের কারণে রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়পরিজন ও বৈবাহিক সূত্রে প্রাপ্ত আত্মীয়দের কাছ থেকে মানসিক-সামাজিক এবং নৈতিকভাবে ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকি। আমার বুদ্ধিমত্তার ওপরও আমি জুলুম করতে শুরু করি। প্রথম দিকে ভালো ভালো চিন্তা করতাম। অনেক ভালো কাজও করেছি। কিন্তু বিকৃত যৌনাচারের জন্য আমার বুদ্ধিতে বিভ্রাট শুরু হয়। লোভ-লালসা-কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার শয়তানি বুদ্ধি আমাকে প্রতি মুহূর্তে প্ররোচিত করতে থাকে। আমার চোখ-মন ও মস্তিষ্কের ওপর জাহেলিয়াতের পর্দা তৈরি হয়ে যায়। ফলে আমার মধ্যে দ্বৈতসত্তা প্রবল হয়ে ওঠে। ভালো কাজের ধারাবাহিকতা যেমন রক্ষা করতে ব্যর্থ হই, আবার একটানা মন্দ কর্ম করতে গিয়েও ক্লান্তি অনুভব করি। এ অবস্থায় অর্থ-ক্ষমতা ও নারীর চিরন্তন লোভ আমাকে গ্রাস করে। ফলে আমার সম্পূর্ণ বুদ্ধিমত্তার ওপর ভয়াবহ জুলুম চালিয়ে আমি কোনোরকম বাছবিচার না করে গোপনে-প্রকাশ্যে একের পর এক অন্যায়-দুর্নীতি-পাপাচার ও অনাচারে মেতে ওঠি।

আমার উল্লিখিত বিবর্তনের কারণে অচিরেই আমি জমানার সবচেয়ে সফল দুর্নীতিবাজ, যেনাকার, জুয়াড়ি, মদ্যপ, চরিত্রহীন লোকজনের সান্নিধ্য পেয়ে শয়তানি রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে পড়ি। মন্দ লোকের সংস্পর্শ যে ইবলিশের চেয়েও ভয়াবহ, তা আমি এখন বুঝতে পারলেও সময়মতো আন্দাজ করতে পারেনি। আমার দুর্নীতি-চরিত্রহীনতা সবসময়ই সীমিত ছিল। কিন্তু চরিত্রহীন লোকদের কবলে পড়ে আমি লজ্জা-শরম হারিয়ে ফেলি। গোপন কর্মগুলো প্রকাশ্যে করতে থাকি। সেসব কর্মে কৌশলী এবং হিসেবি হওয়া দরকার ছিল, সেসব কর্ম প্রকাশ্যে করতে গিয়ে আমার মধ্যকার কাণ্ডজ্ঞান, ভালো-মন্দ পার্থক্য করার ক্ষমতা এবং মায়া-মমতা রহিত হয়ে যায়। ফলে আমার স্ত্রী-সন্তান-সন্ততি ও পিতা-মাতা, ভাইবোনদের সাথে নিদারুণ দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়।

যেহেতু আমি কোনো সাধারণ দুর্নীতিবাজ ছিলাম না, সেহেতু আমাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর ক্ষমতা কারো প্রতি ছিল না। আমি অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা ও ক্ষমতার দাপটের সাথে রাষ্ট্রক্ষমতা-অন্ধকার জগতের কারসাজি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিপক্ষকে নির্মূলের যে কৌশল অবলম্বন করেছিলাম যা স্বল্পমেয়াদে আমাকে কী কী সুবিধা দিয়েছিল এবং দীর্ঘমেয়াদে কী কী বিপত্তি সৃষ্টি করেছে, তা সবিস্তারে এমনভাবে বর্ণনা করব যেন অনাগত দিনে আমার পথে পা বাড়ানোর আগে যে কেউ অন্তত ১০০বার চিন্তা করতে পারেন।

আলোচনার শুরুতেই আমার সুবিধাগুলো সম্পর্কে বলে নিই। আমি অনায়াসে প্রচুর অর্থ হস্তগত করেছি। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দখল করেছি। সোনা-দানা-হীরা-জহরত দেশ-বিদেশে জমা করেছি। গাড়ি বাড়ি পোশাক পরিচ্ছদ খেয়ালখুশিমতো ক্রয় করেছি। আমার মন্দ নফস বা রিপু যেসব কামনা-বাসনার জন্য আমাকে উত্তেজিত করেছে তা আমি বিনা বাধায় হাসিল করেছি। পদ-পদবি অর্জন ও শত্রুদেরকে দমন করার ক্ষেত্রে আমার সফলতা শতভাগ। আবার নিজের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা নির্বুদ্ধিতা মধ্যবিত্ত মনমানসিকতা ইত্যাদিকে মাটিচাপা দিয়ে অভিজাত ধনিক সম্প্রদায় এবং জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতদের নির্বিচারে অপমান করে ইচ্ছেমতো মনের ঝাল মিটিয়েছি। অত্যাচারের পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করেছি, যৌনতার আদিরস নির্বিচারে আস্বাদন করেছি, লোক ঠকানোর উল্লাসে নৃত্য করেছি এবং নির্বিচারে দুর্নীতি করার নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কার এবং তা প্রয়োগ করে হিমালয়সম অবৈধ সম্পদের পাহাড় তৈরি করেছি।

উল্লিখিত কর্ম করতে গিয়ে আমি কোনো বাধার সম্মুখীন হইনি। আমার মন্দকর্মের সহচররা আমাকে এতটা উজ্জীবিত রাখত যে, অনুশোচনা করা, বিকল্প চিন্তা অথবা আমাকে নিয়ে লোকজন কী ভাবছে অথবা অনাগত দিনে আমার ভাগ্যে কী ঘটতে পারে- ওসব অলক্ষুণে চিন্তা করার সময় আমার ছিল না। বরং আমার মনে হয়েছে- আমি সঠিক কাজ করছি, এটাই হওয়া উচিত এবং আমার বাকি জীবন এভাবেই কাটবে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে আমার জীবনে শেষপর্যন্ত কি সব বিপত্তি ঘটছে, তা সংক্ষেপে বলে আজকের নিবন্ধ শেষ করব।

আমার জীবনের ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটেছিল আমার অসুখী দাম্পত্যের মাধ্যমে। একটি হানিট্র্যাপে আটক হয়ে যাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলাম তার কারণেই আমার পরবর্তী প্রজন্ম বখে যায়- নিকটাত্মীয়রা দূরে চলে যায় এবং আমার জীবনে বিকৃত যৌনাচার ভর করে। পরে কিছু অসৎ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়ে আমি আমোদ-প্রমোদে জড়াই এবং এই চক্রটি আমাকে ব্যবহার করে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য রচনা করে যার একটি অংশ আমিও লাভ করি। অন্যদিকে, আমার কুকর্মের খবর বহুগুণ বর্ধিত হয়ে আমার নিয়োগকর্তার কানে পৌঁছায়, যার কারণে আমার পেশাগত জীবন নিজের অজান্তে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়।

আজ আমার দুর্বিষহ সময়ে আমি ভাবার সময় পাচ্ছি কেন এমনটি হলো। আমার মতো অনেকেই অপকর্ম করেছে কিন্তু কেউই তো আমার মতো ধরা খায়নি। উল্টো অনেকের তকদির খুলে গেছে। নিত্যনতুন পদ-পদবি ও পদোন্নতি ছাড়াও দশহাতে দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। তারা কেউই তো মালিকের বিরাগভাজন হয়নি। তবে আমার কেন এত দুর্গতি? এসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমার প্রথমেই যেটি মনে হয়েছে, সেটি হলো- আমার পদ-পদবিটি ছিল চাকরের। কিন্তু আমি সর্বদাই নিজেকে মালিকের মতো সর্বময় ক্ষমতাধর মনে করতাম। মালিক তার অনেক যোগ্য চাকরকে বাদ দিয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন কিছু দুষ্কর্ম করার জন্য। এগুলো করার পর আমার অহমিকা বেড়ে যায়। আমার মনে হতে থাকে- আমার কোনো বিকল্প নেই। আমি যদি কাজগুলো না করতাম তবে মালিকের অস্তিত্ব থাকত না। আমার এতসব চিন্তার কারণে আমার মধ্যে একটা মালিক মালিক ভাব এসে যায় এবং পরবর্তী ধাপে আমার মনে হতে থাকে, আমার কারণে মালিক তার গদিতে বসে আছে। সুতরাং আমি হলাম প্রকৃত মালিক আর আমার কুকর্ম দ্বারা যার গদির সুরক্ষা হয়েছে, তিনি হলেন ডামি মালিক। আমার এই বিবর্তনের ভাবভঙ্গি সম্ভবত মালিকের নজর এড়ায়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে- আমি নিয়তির খপ্পরে পড়ে গেছি।

আমার দুঃসময় তখনই শুরু হলো যখন মালিক আমার গদিতে অন্য একজনকে বসতে দিলেন। আমার পোশাক খুলে নেয়া হলো এবং আমাকে পত্রপাঠ বিদায় দেয়া হলো। এ অবস্থায় আমার সঙ্গী-সাথীরা ছেড়ে গেল। আমার দুর্নীতির অর্থবিত্ত আমার বোঝাতে রূপান্তরিত হলো। পরিবারের লোকজন দাঁত বের করে দিবানিশি টিটকারি শুরু করে দিলো। আমার শয্যাসঙ্গিনীরা সবাই পালিয়ে গেল, আমার শরীরে বহুগামিতাজনিত কিন্তু জটিল রোগ ধরা পড়ল; যার কারণে সামাজিক মেলামেশা দুরূহ হয়ে পড়ল। আমার দৈনন্দিন জীবনে বিভীষিকা নেমে এলো এবং প্রতিটি মুহূর্তকে জাহান্নামের আগুন বলে মনে হতে থাকল। আমি যখন বেঁচে থাকার আগ্রহ হারাতে বসলাম এবং সমাজ সংসারকে বীভৎস ও স্বার্থপর মনে করতে থাকলাম ঠিক তখনই আমার বিরুদ্ধে পরোয়ানা এসে গেল। আমার কুকর্মের বিচারের জন্য যখন হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর তোড়জোড় চলছিল ঠিক তখনই আজকের আত্মকথা লেখার ধারণা মাথায় আসে- যেন আমার মতো অন্য কেউ একই ভুল না করে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement