২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


টিউলিপ কাহিনী ডাহা মিথ্যা

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী। -

আমি মেইন স্ট্রিম সাংবাদিকতা শুরু করি তিপান্ন বছর আগে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তখন শেখ মুজিব যেটা বলতেন সেটাই ছিল সাংবাদিকতার নীতিমালা। প্রতিদিন সন্ধ্যার মধ্যে পিআইডি থেকে (প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট) একটা লিখিত ব্রিফিং দেয়া হতো। যেমন এই সংবাদটা গুরুত্ব দিয়ে ছাপতে হবে। এই সংবাদটা ছাপার দরকার নেই। এই সংবাদটা কিল। এ রকম একটা বিধিনিষেধের সময় আমি সাংবাদিকতায় ঢুকেছিলাম ১৯৭২ সালে। তখন নিউজ এডিটর, শিফট ইনচার্জদের জন্য অফিসে ঢুকেই পিআইডি থেকে পাঠানো নিউজ ব্রিফিং পড়া ছিল বাধ্যতামূলক। সাব এডিটররাও এসবের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিতেন। চোখ বুলিয়ে নিতে ভুল করায় চাকরি হারিয়েছিলেন, বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার সাব এডিটর গোলাম রাব্বানি। তা নিয়ে সাংবাদিক ইউনিয়ন অনেক আন্দোলন করেছে। কিন্তু গোলাম রাব্বানি চাকরি ফিরে পাননি। তখন প্রেস ক্লাবের সেমিনার কক্ষগুলোতে সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়নের কথা আড়ে-ঠারে বলা গেলেও ছাপা যেতো না। এডিটিংও ছিল অনেক সহজ। বুঝতে পারছ না? পরদিন পুলিশ বা আওয়ামী মাস্তানদের হাতে হেনস্তা হওয়ার চাইতে নিউজটা না ছাপা নিরাপদ। তৎকালে আমাদের সাংবাদিক শিক্ষা গুরুরাও এই পরিস্থিতি মেনে নিয়েছিলেন। মেনে না নিয়ে যাবেন কোথায়!

এখনকার পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। এখন কিছু সাংবাদিককে সরকার প্লট দিয়ে টাকা দিয়ে বিদেশে সফরসঙ্গী করে বাগে আনে। সব পাঠকই নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী থেকে সরকারের মন্ত্রীরা যে প্রেস ব্রিফিং করেন, তাতে অন-উল্লেখযোগ্য ভিন্ন মতের সংবাদপত্রকে ডাকা হয় না, ইলেকট্রনিক মিডিয়াকেও না। ফলে সেখানে থাকেন শুধু ‘আমরা আর মামুরা।’ সেই সভার ভেতরকার একজন আমাকে জানিয়েছিলেন যে, আসলে আমরা যে প্রশ্ন করি সে প্রশ্ন আমাদের নয়। আমাদের হাতে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি বা অন্য দায়িত্ববান কর্মকর্তা ছোট কাগজের টুকরায় প্রশ্নটা লিখে দেন। আমরা শুধুমাত্র আবৃত্তি করি। তারপর প্রধানমন্ত্রী বিস্তারিতভাবে খুঁটিনাটিসহ সে প্রশ্নের জবাব দেন। সেসব জবাব থাকে নির্ভুল এবং সঠিক তথ্যভিত্তিক। তার যদি কোনো ব্যতিক্রম হয় তাহলে বোঝা যাবে ওইটুকু প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের ভুল।

যাই হোক, এখন চলছে নতুন যুগ। সরকার সাংবাদিক নামে কিছু ফেউ আমদানি করেছে। এদের কাজই হচ্ছে সরকারের সকল বক্তব্য নানা রঙ মাখিয়ে সমর্থন করে যাওয়া। এই যেমন সরকার না হক একটি চাল চেলে দিয়েছে। আর কিছু সাংবাদিক পত্র-পত্রিকা নয় টেলিভিশন বা ইউটিউবে বিএনপিকে দারুণ ঝেড়ে দিয়েছেন, এখনও দিচ্ছেন। কিন্তু রাজা যে ন্যাংটা একথা কেউ বলছেন না। ঘটনাটিকে সামান্য বললে ভুল হবে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুকাল আগে এক বক্তব্য দিয়েছিলেন যে, খালেদা জিয়া সরকার এতই সঙ্কীর্ণ মানসিকতার যে তারা হল্যান্ড থেকে টিউলিপ কম্পিউটার আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। হাসিনা সরকার তাদের কাছ থেকে স্কুলছাত্রদের প্রযুক্তি জ্ঞান বাড়ানোর জন্য দশ হাজার সেট টিউলিপ ল্যাপটপ আমদানির চুক্তি বাতিল করে দিয়েছে। হল্যান্ডের জাতীয় ফুল টিউলিপ। তার নামানুসারে বহু রকমের বহু কোম্পানির নামের সাথে টিউলিপ যুক্ত আছে। যেমন ইন্দোনেশিয়ার বাটিক। সেখানকার বাটিক এতই জনপ্রিয় যে তাদের একটি এয়ারলাইন্সের নামও বাটিক। বাংলাদেশের একটি বিমানের নামও রজনীগন্ধা। এই বাটিক অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘নিপুণ’ তাদের দু’জন শ্রমিককে ইন্দোনেশিয়ায় পাঠিয়েছিল বাটিক প্রশিক্ষণের জন্য। তারা ছ’মাস ঘুরে বাটিক রহস্যের কোনো কিনারা করতে পারেননি। টিউলিপও হল্যান্ডের এমন একটি অনন্য ফুল।

সেই নামেই কম্পিউটার কোম্পানি। শেখ হাসিনা বিএনপি যে কত সঙ্কীর্ণ মনের, তার প্রমাণ তুলে ধরতে ডাচ টিউলিপ কোম্পানির কম্পিউটার কেনার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমার ছোট বোন রেহানার মেয়ের নাম টিউলিপ বলে হল্যান্ড থেকে ১০ হাজার কম্পিউটার কেনেননি খালেদা জিয়া। ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি সকালে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমপ্লেক্স উদ্বোধনকালে তিনি একথা বলেন।

তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে এসে এই খাতের উন্নয়নে নতুন নীতিমালা গ্রহণ করে। সফটওয়ার, ডাটা এন্ট্রি, ডাটা প্রসেসিং উন্নয়নে আইসিটি ডিফেন্স ও হাইটেক পার্ক গঠনের উদ্যোগ নেয়। চুক্তি অনুযায়ী কথা ছিল দশ হাজারের মধ্যে পাঁচ হাজার কম্পিউটার বাংলাদেশ টাকা দিয়ে কিনবে। আর বাকি পাঁচ হাজার নেদারল্যান্ডস সরকার অনুদান হিসেবে দেবে। কিন্তু খালেদা জিয়া সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই চুক্তি বাতিল করে। সরকারের তরফ থেকে প্রচার করা হতে থাকে যে, যেহেতু শেখ রেহানার মেয়ের নাম, টিউলিপ, সুতরাং টিউলিপ নামের কোনো কম্পিউটার কেনা যাবে না। এটা নাকি বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য। কিন্তু এরকম বক্তব্যের কোনো প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি।
কিন্তু ২০১৯ সালে ৩ ডিসেম্বর এ অভিযোগের জবাব দেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে সরকার জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতে চায় বলে রিজভী উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, নেদারল্যান্ডসের টিউলিপ কম্পিউটার আমদানির চুক্তি বাতিল সম্পর্কে শেখ হাসিনা আবারও মিথ্যা গালগল্প ফেঁদেছেন। আমাদের প্রশ্ন, শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপের নামের সাথে কোম্পানির নামের মিল থাকার কারণে বেগম খালেদা জিয়া চুক্তি বাতিল করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই গালগল্পের সূত্র কী?

রিজভী বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা কুৎসা রটনা করে ওই কল্পিত কাহিনী বারবার প্রচার করে সেটিকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। আসলে টিউলিপ কোম্পানির সাথে করা চুক্তিটি ছিল দুর্নীতি ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তির একটি খারাপ নজির। তিনি বলেন, তিন করণে বিএনপি টিউলিপের সাথে চুক্তি বাতিল করেছিল। এক, আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের তুলনায় দ্বিগুণ মূল্যে কম্পিউটার কেনার চুক্তি হয়েছিল। চুক্তি বাতিলের পর বিএনপি সরকার অন্যান্য দেশ থেকে টিউলিপের চুক্তির প্রায় অর্ধেক দামে কম্পিউটার আমদানি করে। দুই, চুক্তির শর্তাবলির সবই ছিল কোম্পানির পক্ষে এবং বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে। তিন, চুক্তির শর্তানুযায়ী নেদারল্যান্ডস অনুদানের প্রায় পঞ্চাশ কোটি টাকা বাংলাদেশকে দেয়নি।

ওই চুক্তি বাতিলের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডসের অভ্যন্তরীণ রায় অনুযায়ী এবং পরবর্তীতে জরুরি অবস্থার সরকার কেউই কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি। তিনি বলেন, চুক্তি বাতিলের পর সিদ্ধান্ত ছিল আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আইনি লড়াই ছেড়ে দিয়ে টিউলিপ কোম্পানিকে রাষ্ট্রীয় অর্থে ক্ষতিপূরণ দেয়। অথচ নেদারল্যান্ডস সরকারের কাছ থেকে একটি টাকাও পায়নি বাংলাদেশ, একটি কম্পিউটারও নয়।

শেখ হাসিনা সরকার টিউলিপকে অযৌক্তিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে রাষ্ট্রের অর্থ ক্ষতি করার দায় এড়াতে পারে না। ২০১১ সালে নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আলী সরকার ওই কোম্পানির লোকদের দুই মিলিয়ন ডলার বা ২৩ কোটি টাকা কঠোর গোপনীয়তার সাথে পৌঁছে দেন। জরিমানার নগদ টাকা ছাড়াও মামলা চালানোর খরচ ও অ্যাটর্নি জেনারেলসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার নেদারল্যান্ডস সফরে সরকারি তহবিল থেকে খরচ হয়েছে আরো প্রায় ২২ কোটি টাকা। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের ইআরডি সচিব এবং বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান ওই শাসনকালের শেষের দিকে এক শুক্রবার ছুটির দিনে অত্যন্ত গোপনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মতামত উপেক্ষা করে মারাত্মক গলদপূর্ণ চুক্তিটি করেন। চুক্তি অনুযায়ী দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অনুদান হিসেবে নেদারল্যান্ডস সরকারের দেয়ার কথা ছিল পঞ্চাশ কোটি টাকা। আর বাকি পঞ্চাশ কোটি টাকা দেয়ার কথা ছিল বাংলাদেশ সরকারের। কিন্তু ডাচ সরকার তার এক টাকাও দেয়নি।

এ বিবৃতি থেকেও বোঝা যায় যে টিউলিপের কম্পিউটার কেনা নিয়ে কী ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। শেখ রেহানার মেয়ের নামের সাথে ডাচ টিউলিপ কোম্পানির কম্পিউটার কেন বাতিলের কোনো সম্পর্ক নেই। অভিযোগটি ডাহা মিথ্যা।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement