০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ওদের মানবাধিকার থাকতে নেই

ওদের মানবাধিকার থাকতে নেই। - ছবি : সংগৃহীত

সাম্প্রতিককালে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে বেশ কিছু হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। সেই সাথে আমাদের সন্তানতুল্য ছাত্রদের দিয়ে অপরাধমূলক ঘটনাও ঘটেছে। পত্র-পত্রিকার এ খবরগুলো পুরো জাতিকে লজ্জিত করার পাশাপাশি আতঙ্কিতও করে তুলছে। পিতামাতা কী আশা নিয়ে সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন, আর সোনার সন্তানরা সেখানে গিয়ে কী করছে? অর্থাৎ মানুষ গড়ার আঙিনায় গিয়ে এসব মেধাবী ছেলেমেয়ে কি অন্ধকার জগতে হারিয়ে যাচ্ছে?

দেশের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হওয়ার পরিবর্তে আমাদের ক্যাম্পাসগুলো কি অভিভাবকদের জন্য ভয়াবহ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে? নিরীহ ছাত্ররা ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের স্বার্থের বলি হচ্ছে। এ অবস্থাটি জাতির জন্য আশনি সঙ্কেত! আমাদের এখনই ভাবতে হবে, সন্তানদের কিভাবে এমন অপরাধবৃত্ত থেকে বের করে আনা যায়।

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের নিরীহ ছাত্র আবরার ফাহাদকে ‘শিবির’ সন্দেহে সারারাত নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। পরে ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার নিম্নআদালতে ছাত্রলীগের ২০ জন নেতাকর্মীর মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু এই বিচারের কোনো প্রভাবই ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গত ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ বর্ষের চার ছাত্রকে সারারাত নির্যাতন করা হয়। ‘ছাত্রশিবির’ সন্দেহে তাদেরকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা নির্যাতন করলে সাকিব ও জাহিদ গুরুতর আহত হন। পরে পুলিশ ও শিক্ষকরা তাদেরকে হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করান। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদেরকে আইসিইউতে গিয়েও মেরে ফেলার হুমকি দেন। গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের এক ছাত্র কৃষ্ণ রায়কে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম ইসলাম ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো: সোলাইমানসহ ছাত্রলীগের সাত-আটজন নেতাকর্মী মারধর করে রুম থেকে বের করে দেয়। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম ইসলাম বলেন, ‘তোকে মেরে শিবির বলে চালিয়ে দেবো’। কিন্তু কৃষ্ণ রায় নিজেকে হিন্দু বলে জানালে নাঈম বলেন, ‘তাহলে তোকে মেরে ফেললেও কেউ কিছু বলতে পারবে না।’ (প্রথম আলো, ১৫ ফেব্রুয়ারি-২০২৩)

ওই ঘটনাগুলো মনে হয় এ দেশে ‘ছাত্রশিবির’ করলে একজন ছাত্রকে নির্যাতন করা যায়, এমনকি মেরেও ফেলা যায়! আমরা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দেখেছিলাম প্রকাশ্যে দিবালোকে একজন শিবিরকর্মীকে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করে তার উপর বীরদর্পে খুনিদের উল্লাসের নৃত্য করতে। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর দেখেছি, শাঁখারীবাজারের দর্জি বিশ্বজিৎকেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা শিবির সন্দেহে কুপিয়ে হত্যা করেছিল। ছাত্রশিবির কি এ দেশে কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন? আমাদের সংবিধানের ৩৮ ধারা তো নাগরিকদের সংগঠন করার স্বাধীনতা দিয়েছে। আর ৩১ ধারায় সুস্পষ্টভাবে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে- ‘...বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’ তাহলে প্রশ্ন জাগে, এই ছাত্রদের কে শিখিয়েছে বা উৎসাহিত করছে সংবিধান লঙ্ঘন করতে? কেনইবা তারা এ ধরনের আইন হাতে তুলে নিয়ে ‘শিবির’ সন্দেহে ছাত্রদেরকে হত্যার মতো অপরাধ ঘটাচ্ছে? বর্তমান ছাত্রশিবিরের ছেলেরা তো স্বাধীনতার পর জন্ম নেয়া এ দেশেরই নাগরিক। তাদের স্বাধীনতাবিরোধী তকমা দিয়ে নির্যাতন করা হয়। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজকের কেউ কি স্বাধীনতাবিরোধী হতে পারে? বা আজকের আধুনিক বাস্তবতায় কেউ কি পাকিস্তানপন্থী হতে পারে? তাহলে কি বলা যায়, এটি আদর্শিকভাবে মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে শিবিরকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কোণঠাসা করার চেষ্টা! আগের সরকারগুলো ছাত্রশিবিরের ওপর খড়গহস্ত হলেও গত ২০০৯ সাল থেকে এর ব্যাপকতা বেড়েছে। ২০১৩ সালের দিকে এই ছাত্র সংগঠনের ছেলেরা বিভিন্নভাবে দেশব্যাপী ব্যাপক নির্যাতন এবং কোথাও কোথাও হত্যার শিকার হয়েছে। তৎকালীন সরকারবিরোধী আন্দোলনে একটি বড় শক্তি হিসেবে ছাত্রশিবির মাঠে-ময়দানে তাদের শক্তি প্রদর্শন করেছে। তখন বেশ কিছু সহিংসতার ঘটনা দ্বিপক্ষীয়ভাবে ঘটেছে। শিবিরের ছাত্ররা কেউ ফেরেশতা নয়। তারা মানুষ। ফলে তারাও ভুল-ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়। রাজপথের সরকারবিরোধী আন্দোলনে সহিংসতা এ দেশের বাস্তবতা। কাজেই সেই আন্দোলনে শিবিরের বেশ কিছু ভুল-ত্রুটিও ছিল, ছিল কিছু শক্তি প্রদর্শনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। এ জন্য আইন-আদালত রয়েছে। দেশের সংবিধান, আইন-আদালত অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করে। কিন্তু শিবিরের সবাই অপরাধ করেছে বা পুরো ছাত্রশিবিরই অপরাধী, এমনটি কিছুতেই হতে পারে না। অথচ লোকে বলে, ব্যক্তিগতভাবে ইসলামী ছাত্রশিবিরের একজন কর্মী অত্যন্ত বিনয়ী, নম্র-ভদ্র ও পরোপকারী ছাত্র। এরা পড়ালেখার পাশাপাশি আশেপাশের ছাত্রদেরও ধার্মিক হওয়ার জন্য, ভালো মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার জন্য দাওয়াত দেয়। তাদের অনেককেই সমাজের মানুষজন চরিত্রবান ছাত্র হিসেবেই দেখে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। অন্য দিকে শিক্ষাঙ্গনে কোনো অপরাধের সাথে এদের সংশ্লিষ্টতার কথা জানা যায় না। সিট দখল, সিট বাণিজ্য, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও মারামারি, খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, অপহরণ বাণিজ্য, ইভটিজিং, ধর্ষণ, টেন্ডারবাণিজ্য, নিয়োগবাণিজ্য, শিক্ষককে মারধর ও লাঞ্ছিত করা, নকল বা নকলে সহযোগিতা, ক্যান্টিনে মাগনা খাওয়া, অস্ত্রবাজি, বোমাবাজি ইত্যাদি কোনো ধরনের অপরাধের সাথে শিবিরের ছেলেরা জড়িত নয়। শিবিরকর্মীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো প্রমাণিত অভিযোগের রেকর্ডও নেই। অভিযোগ অনেক হয়েছে, অনেকেই মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে বা দায় চাপিয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও অভিযোগ ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু প্রমাণিত কোনো অভিযোগের খবর পাওয়া খুবই দুষ্কর! থাকলে দু-একটা থাকতেও পারে। কোনো মানুষই তো ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তবে ঢালাওভাবে কোনোক্রমেই ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে এসব অপরাধের অভিযোগ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এরপরও দেশের একটি মহল মোটামুটি অন্ধভাবেই বিশ্বাস করেন বা প্রচার করেন যে, ছাত্রশিবির অনেক অপরাধের সাথে জড়িত। তারা এসব বিশ্বাস বা প্রচার করতেই পারেন। এটি মূলত তাদের আদর্শিক দৈন্য কিংবা দ্বন্দ্বের কারণেই করে থাকেন। তারা শিবিরকে সহ্য করতে পারেন না বা নির্মূল করে ফেলতে চান। তারা যদি নিরপেক্ষ মন দিয়ে ছাত্রশিবিরকে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করেন তবে তাদের সন্দেহ বা বিশ্বাস ভুল প্রমাণিত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

দুঃখজনকভাবে অনেক জ্ঞানী-গুণী বলে পরিচিত ব্যক্তিরাও শুধু দর্শনগত কারণেই এমন নেতিবাচক ধারণা পোষণ ও প্রচার করেন। অথচ দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের বাইরে যেসব ছাত্র সব ধরনের অপরাধের সাথে প্রমাণিতভাবে জড়িত এবং প্রতিদিনই গণমাধ্যমে এসব বিষয়ে সংবাদ আসছে সেসব অপরাধী তাদের কাছে সোনার ছেলে হিসেবেই স্বীকৃতি পাচ্ছে। ফলে প্রকৃত অপরাধীরা বিচারের বাইরে থাকছে, বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং যাকে যখন প্রয়োজন ‘ছাত্রশিবির’ ট্যাগ দিয়ে নির্যাতন চালিয়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের হাতে দিচ্ছে; আর কর্তৃপক্ষ তাদেরকে তুলে দিচ্ছেন পুলিশের হাতে। কত যোগ্য ও পারঙ্গম কর্তৃপক্ষ! কত ‘মহান’ তারা! নির্যাতনের শিকার নিরীহ ছাত্রটিকে ‘শিবির’ সন্দেহে পুলিশে তুলে দিচ্ছেন আর নির্যাতনকারীকে সোনার ছেলেটি বলে বাহবা দিচ্ছেন!

সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে ভয়াবহ মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে! প্রথম বর্ষে ক্লাস শুরুর মাত্র সাত দিনের মাথায় ফুলপরী খাতুনকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী ও আরেক নেত্রী তাবাসসুম ইসলাম গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে গণরুমে নিয়ে নির্যাতন করে। মারধর তো করেছেই; সেই সাথে বিবস্ত্র করে ভিডিও করা, অশ্লীল নৃত্যে বাধ্য করা, ময়লা গ্লাস চেটে পরিষ্কার করাসহ অশ্লীল গালগাল করা ইত্যাদিভাবে নিরীহ ছাত্রীটিকে নির্যাতন চালায়। এমনকি ফুলপরীর ভ্যানচালক বাবাকে নিয়েও কটাক্ষ করে তারা। এই বর্বরতা ছেলেদেরকেও ছড়িয়ে গেছে! গত বছরও ঢাকার ইডেন কলেজে ছাত্রলীগ সভানেত্রীর হাতে দু’জন ছাত্রী নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের ওমরগণি কলেজে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করা অবস্থায় এক শিক্ষিকাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন কলেজশাখা ছাত্রলীগের সাবেক একজন নেতা। গত জানুয়ারি মাসে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছে। (প্রথম আলো, ১৭ ফেব্রুয়ারি-২০২৩) এ ছাড়া আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও হলের সিট দখল নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ, শরীয়তপুর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত এক বছরেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ বার ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গত ১ জানুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪০ দিনে ১৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের ২৫টি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে (প্রথম আলো, ১৭ ফেব্রুয়ারি-২০২৩)। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মোহাইমেনুল ইসলাম ওরফে ইমন ও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি রাজীব হোসেন ওরফে নবীন চাঁদপুর থেকে বইমেলায় আসা চার ব্যক্তির কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা ছিনতাই করে (প্রথম আলো, ১৮ ফেব্রুয়ারি-২০২৩)। এর আগে গভীর রাতে ক্যাম্পাস এলাকায় ট্রাক থামিয়ে ১৫ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায়ও একই সংগঠনের দু’জন আটক হয়েছেন বলে জানা যায়। এমনকি ঢাকা জেলা (উত্তর) ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক বাবলী আক্তারের বিরুদ্ধে গরু চুরির মামলায় পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে (নয়া দিগন্ত, ১৫ ফেব্রুয়ারি-২০২৩)। গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগ নেতা পারভেজ আলি হৃদয়কে একজন ছাত্র অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবির অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করে। তবে ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ নেতাকর্মীকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বিভিন্ন অপরাধের কারণে বহিষ্কার করেছে বলে জানা যায় (ডেইলি স্টার, ২২ ফেব্রুয়ারি-২০২৩)।

ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন অপরাধের ফিরিস্তি দেয়ার উদ্দেশ্য ছাত্রলীগের দুর্নাম করা নয়; বরং আমাদের বিবেককে প্রশ্ন করার জন্য যে, আমাদের এসব ছেলেমেয়েরা কেন এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে? ছাত্রলীগ নিশ্চয়ই তাদেরকে অপরাধ করতে বলে না। কিন্তু কেন তারা এসব করছে? এর বড় কারণ হলো- বৃহত্তর রাজনীতিতে ছাত্রদের ব্যবহার করা। ছাত্ররা রাজনীতি করবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করার লক্ষ্যে এবং এর মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব ও আদর্শ শেখার জন্য। কিন্তু তারা আজ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পূর্তকাজের টেন্ডার, হল দখল, সিট বাণিজ্য, ক্যান্টিনের ইজারা ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এসব লাভজনক কাজের খোঁজেই সুযোগসন্ধানীরা বা দুর্বৃত্তরা ছাত্রলীগের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করার প্রয়াস পায়। ক্ষমতার বাইরে থাকলে প্রকৃত ত্যাগী নেতাকর্মী সংগঠনে তৈরি হয়। তারা সততা ও দেশপ্রেমে উদ্দীপিত থাকে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অপরাধীদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। কারণ বৃহত্তর রাজনীতির স্বার্থরক্ষার জন্য এই ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদেরকে আনুকূল্য দেয়ার বিনিময়ে নিজেরা আনুকূল্য প্রাপ্তির আশা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ নিজেরাই বিভিন্ন অনৈতিক কাজ এবং দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে নৈতিক মনোবল হারিয়ে ফেলেন ছাত্রদের অনৈতিক কাজের প্রতিকার করতে। গত কয়েক বছর ধরে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, নিয়োগে অনিয়ম ও আর্থিক অস্বচ্ছতাসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ জানা যাচ্ছে। সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে নিয়োগবাণিজ্যের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, যদিও এখনো প্রমাণিত হয়নি। এ ধরনের অভিযোগ যার বিরুদ্ধে উঠেছে তিনি কিভাবে সানজিদা চৌধুরী বা তাবাসসুম ইসলামকে সাধারণ ছাত্রী নির্যাতন থেকে নিবৃত্ত করবেন? অথচ ফুলপরীকে নির্যাতনের দুই দিন পেরিয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ তো করেইনি; বরং সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীর ফুলপরীর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগটিকেই আমলে নিলেন। অবশ্য উচ্চ আদালতের নির্দেশে বাধ্য হয়েই তারা পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আর এসব সম্ভব হয়েছে ওই ছোট্ট ফুলপরীর সাহসিকতা ও অদম্য আত্মবিশ্বাসের কারণেই।

আমাদের জাতীয় নেতাদেরকে ছাত্র রাজনীতির এই অন্ধকারাচ্ছন্ন বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। ছাত্র সংগঠনের ছাত্রদের দুর্নীতি ও অপরাধে জড়িয়ে পড়া বা অন্য সংগঠনের ছাত্রদের নির্বিচারে নির্যাতনের লাইসেন্স পাওয়া একটি জাতির জন্য নিশ্চয়ই কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। ছাত্রলীগের ছেলেদের মতো ছাত্রশিবিরের ছেলেরাও এই মাটিরই সন্তান। একই সংবিধান তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে বলেছে। কেউ অপরাধ করলে তার ন্যায়বিচার করতে হবে। কিন্তু নিজের ইচ্ছামতো আইন হাতে তুলে নেয়ার অধিকার আমাদের সংবিধান কাউকেই দেয়নি। কাজেই নেতৃত্ব সৃষ্টি ও মূল্যবোধের চর্চার উদ্দেশ্যে পরিচালিত ছাত্ররাজনীতি যদি এ ধরনের বিভীষিকাময় হয় উঠে তবে এই রাজনীতি জাতির ধ্বংস ডেকে আনবে। এ জন্য আমাদের পুরো জাতীয় রাজনীতির সংস্কার দরকার। দরকার সংবিধানের আলোকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং দল, মত, পথ ও ব্যক্তি নির্বিশেষে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email : maksud2648@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
এক মাসে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকার চোরাচালান পণ্য জব্দ চট্টগ্রাম বিমান বন্দর : ৩ কোটি টাকার সৌদি রিয়াল ও ডলার উদ্ধার ‘পাকিস্তানে ৯ মের সহিংসতায় দায়বদ্ধতার স্থান থেকে তিন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা বরখাস্ত করা হয়েছে’ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ বুধবার গাজা-ইসরাইল ক্রসিংয়ে ইসরাইলি বাহিনীর উপর হামাসের হামলা তরুণ্যেই অর্ধশতাধিক ইসলামী সঙ্গীতের রচয়িতা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে কৃষকদের যত ভোগান্তি ইসরাইলের রাফা অভিযান : জার্মানির কড়া প্রতিক্রিয়া চট্টগ্রামে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে একসাথে কাজ করবে সিএমপি ও চসিক রাফায় ইসরাইলি অভিযানে ‘আমি বিরক্ত ও ব্যথিত’ : জাতিসঙ্ঘ প্রধান ৩ দিনের সফরে চট্টগ্রাম বন্দরে তুরস্ক নৌবাহিনীর জাহাজ

সকল