১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে কৃষকদের যত ভোগান্তি

আসন্ন বোরো মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে ১৭ লাখ টন ধান-চাল কিনবে সরকার - সংগৃহীত

আসন্ন বোরো মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে ১৭ লাখ টন ধান-চাল কিনবে সরকার, যার বাজারমূল্য পড়বে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা।

মঙ্গলবার (৭ মে) সচিবালয়ে অনলাইনে এই ধান-চাল কেনার কার্যক্রমের উদ্বোধনের সময় এ কথা জানান খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।

তিনি জানান, এবার ৩২ টাকা কেজি দরে পাঁচ লাখ টন বোরো ধান, ৪৫ টাকা কেজি দরে ১১ লাখ টন সেদ্ধ চাল এবং ৪৪ টাকা কেজি দরে এক লাখ টন আতপ চাল কেনা হবে।

এছাড়া চলতি বছর ৩৪ টাকা কেজি দরে ৫০ হাজার টন গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়েছে।

৭ মে থেকে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ধান, চাল ও গম কেনার এই কার্যক্রম চলবে।

গত বছর ধান, সেদ্ধ চাল ও গমের সংগ্রহমূল্য ছিল যথাক্রমে ৩০ টাকা, ৪৪ টাকা এবং ৩৫ টাকা।

এখন প্রশ্ন হলো কৃষকরা, বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা কি সরকারের বেঁধে দেয়া এই দামে সন্তুষ্ট? কিংবা তারা কি আদৌ এই দামে ফসল বিক্রি করতে পারে?

এ বিষয়টি নিয়ে কয়েকজন ধানচাষীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, নানা কারণে নির্ধারিত মূল্যে সরকারের কাছে ফসল বিক্রি করতে পারে না তারা।

কৃষকরা যা বলছে
কৃষকদের ভাষ্য, সরকারের বেঁধে দেয়া দামে ধান-চাল বিক্রি করতে পারলে তাদের লাভ বেশি হতো। কিন্তু ধান বিক্রি করে সরকার নির্ধারিত এই মূল্য পায় না।

চলতি বছর মোট ছয় বিঘা জমিতে ধান চাষ করেন খুলনার দাকোপ উপজেলার খাটাইল গ্রামের কৃষক রফিক সরদার। সেখান থেকে মোট ১৮০ মণ ধান উৎপাদন করতে পেরেছেন। তবে উৎপাদিত ধানের মোট ১০০ মণ ধান তিনি ইতোমধ্যে স্থানীয় পাইকারদের কাছে ২৭ টাকা দরে বিক্রিও করে দিয়েছেন।

গোলায় থাকা বাকি ৮০ মণ ধানও পাইকারদের কাছে বিক্রি করবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ। কারণ সরকারি কেন্দ্রে বিক্রি করা ঝামেলার। ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করা, টিকিট কাটা… সহজে কোনো কাজ করা যায় না। তারপর ফুড অফিসারের ওইখানে কিছু ঘুসঘাস দিতে হয়।’

তিনি যোগ করেন, ‘ঘুসঘাস না দিলে কয় কি, আপনার এ ধানে পুষ্টি নেই।’

তিনি যে দামে ধান বিক্রি করেছেন সে সম্পর্কে বলেন, ‘তাতে লাভও খুব হয়নি, আবার লসও হয়নি। তাও হয়রানির চাইতে এটা ভালো।’

বছর চারেক আগে একবার সরকারি প্রক্রিয়ায় ধান বিক্রি করেছিলেন উল্লেখ করে রফিক সরদার বলেন, ‘এক বছর ওইভাবে বেচিছি। কিন্তু যে ভোগান্তি খাইছি, তারপর ওটা ছাড়ান দিছি। আর করব না।’

তিনি জানান, তাদের গ্রামে কোনো বিক্রয় কেন্দ্র নেই।

তিনি বলেন, ‘ধান নিয়া আমাদেরকেই উপজেলায় যাইতি হয়। যাওয়ার পর যদি বলে যে পুষ্টি নেই, তাইলে পরে ওই ধান নিয়া ফেরত আসতে হয় আবার।’

এই পুরো প্রক্রিয়াটি যে কৃষকদের জন্য ভোগান্তির, তা ফুটে উঠেছে দিনাজপুরের কোতয়ালি থানার বড়ইল গ্রামের আরেক কৃষক মো: আজিজুল ইসলামের বক্তব্যতেও।

তিনি এ বছর মোট পাঁচ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। তবে খুলনার মতো দিনাজপুরের দিকে এখনো ধান কাটা শুরু হয়নি। সেখানে ধান কাটা শুরু হতে হতে আরো ১৫ দিন লেগে যাবে।

তার আশা, কোনো দুর্যোগ না এলে প্রতি বিঘা জমি থেকে ২৮-৩০ মণ পর্যন্ত ধান হবে এ বছর। তবে তিনি সরকারের কাছে বিক্রি করবেন না বলে জানান।

তিনি বলেন, ‘কৃষকরা কখনো ৩২ টাকা কেজি দরে ধান বিক্রি করতে পারবে না এবং কৃষকরা সরাসরি সরকারকে ধান দিতেও পারে না।’

তার মতে, সরকার যদি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনতে যায়, তাহলে ‘ক্রয়ের সিস্টেম চেঞ্জ করতে হবে’।

তিনি জানান, কৃষকদের বাড়িতে আগের মতো জায়গা না থাকায় ও ঝড়-বৃষ্টির কারণে ধান কাটার পর সেগুলোকে বাড়িতে মজুদ করতে পারে না।

তিনি বলেন, ‘সরকার তো শুকনা ধান নেবে। কিন্তু আমি যে ধানটা শুকাব, শুকাতে গেলে আমার চাটালের দরকার আছে। সময় ও রোদের দরকার আছে। কৃষকদের বাড়িতে এখন আগের মতো খোলান নেই, চাতাল নেই যে ধান কেটে, মাড়াই করে, শুকিয়ে মজুদ করবে। তাই কৃষকরা কাঁচা ধানই রাইসমিলে বিক্রি করে দেয়। কারণ ঝড় বৃষ্টি হতে পারে। বিক্রি হয়ে গেলে কৃষকরা নিশ্চিন্ত হয়ে গেল।’

এছাড়া বিক্রয়কেন্দ্রে ধান পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভোগান্তির কথাও উল্লেখ করেন তিনি। তার ভাষ্য, ‘আমি শুকনা ধান নিয়া গেলাম। আমাদের কাছে তো মেশিন নাই। ওরা ধান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। তারা ১৪ শতাংশ (ময়েশ্চার) শুকনা ধান কিনবে। এখন আমার ধানটা ১৪ শতাংশ শুকনা হলেও অফিসাররা বলবে যে ১৬ শতাংশ শুকনা আছে। অর্থাৎ ধানটা ফেরত দিলো। এটা তো কৃষকের পক্ষে ভোগান্তির।’

এখানে উল্লেখ্য, ধানের আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের মতো থাকলে তা কৃষকদের কাছ থেকে কিনে নেয় সরকার।

দিনাজপুরের এই ধানচাষী মনে করেন, ‘উপজেলায় না, ইউনিয়ন পর্যায়ে যদি ক্রয়কেন্দ্র থাকত, তাহলে কৃষক একদম কুলা দিয়ে ঝেড়ে ১৪ শতাংশ কেন, সাড়ে ১৩ শতাংশ শুকায়ে ভালো ধান দেবে।’

তিনি বলেন, সরকারের কাছে ধান বিক্রির প্রক্রিয়ার মাঝে জটিলতা থাকায় প্রান্তিক চাষীরা মিল মালিক বা হাটে-বাজারের পাইকারদের কাছেই ধান বিক্রি করেন। সরকার যদি সহজ উপায়ে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে, তাহলে কৃষকরা লাভবান ও আগ্রহী হবে। ধানটা একদম শুকায়েই দিতো।

যদিও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যে কৃষকরা সরকারকে ধান দেবেন বলে আবেদন করেছেন তাদের বাড়ি গিয়ে যেন কৃষি কর্মকর্তারা ময়েশ্চার মিটার দিয়ে ধানটা পরীক্ষা করেন।

তিনি বলেন, ‘আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের বেশি থাকলে তাদের বলবেন, আরো শুকিয়ে ১৪ শতাংশে নিয়ে আসেন। যাতে কৃষক হয়রানি না হয়, সে জন্য এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দিয়েছি, আরো ময়েশ্চার মিটার (ধানের আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র) কিনে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে দেয়া জন্য।’

মন্ত্রীর এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ধানচাষী মো: আজিজুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, ‘মন্ত্রী তো ঢাকা থেকে বলেন। তিনি কি জানেন যে ধানটা কিভাবে সংগ্রহ হয় আসলে, ফুড অফিসাররা কিভাবে কিনে। কৃষকদের কাছ থেকে তারা কয় বস্তা কিনে, কিভাবে কিনে, মন্ত্রী তা কখনোই বলতে পারবেন না।’

তিনি বলেন, ‘বাড়ি বাড়ি গিয়ে কৃষি কর্মকর্তাদের ধান পরীক্ষা করার সুযোগ নেই। তারা ধান ক্ষেত দেখতেই আসে না, সেখান কী পরীক্ষা করবে ‘

সরকারের দায়িত্বশীলরা যা বলছেন
ধানের ময়েশ্চার কিভাবে পরীক্ষা করে, সে সম্পর্কে জানতে চাইলে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা অসীম কুমার দাস বলেন, ‘কৃষকরা আমাদের কাছে স্যাম্পল নিয়ে আসে। তবে মাঠ পর্যায়েও উপ-সহকারীদের কাছে মেশিন দেয়া আছে। কোনো কৃষক যদি মনে করেন যে তার সহায়তা লাগবে, তাহলে উপ-সহকারী বাড়িতে গিয়ে পরীক্ষা করে দিয়ে আসেন।’

ধানের ময়েশ্চার পরীক্ষা নিয়ে কৃষকদের এমন অভিযোগ সম্বন্ধে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘গোডাউনে ধান দিতে এসে কোনো কৃষক যেন হয়রানির শিকার না হন, সে জন্য ডিসি ও কর্মকর্তাদের নজর রাখতে বলেছি। যদি সেটা (কৃষককে হয়রানি) করে তবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব। অভিযোগ জানাতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দুটি নম্বর দিয়ে দেয়া হবে। ওই নম্বরে কৃষক বা কোনো ব্যক্তি ফোন করে হয়রানির কথা জানাতে পারবেন।’

তবে সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে, কৃষক আদৌ ওই দামে ধান বিক্রি করতে পারবে কিনা, এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তারা বিক্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসলে এই দাম পাবে। কিন্তু বাইরে অনেকসময় বেশি দাম থাকায় তারা সেখানে ধান বিক্রি করেন।’

এই দামে লাভবান হবে কিনা, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই কৃষকরা লাভবান হবেন। ৩২ টাকা কেজি তো কম না। যেখানে সারে ভর্তুকি দেয়া হয়, বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়া হয়, লাভবান হওয়া উচিত।’

মন্ত্রী জানান, সরকারের মোট ১০টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে যে খাদ্য পরিবীক্ষণ ও বিপণন কমিটি আছে, তারা সবদিক বিবেচনা করে ধান, চাল ও গমের দাম নির্ধারণ করেন।

তিনি বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে উৎপাদন খরচ বলা হয়। সেটি অ্যাসেস করে সব মন্ত্রণালয় মিলে এই দাম নির্ধারণ করেন।’

ইউনিয়ন পর্যায়ে বিক্রয়কেন্দ্র না থাকার ব্যাপারে মন্ত্রীর ভাষ্য, ‘প্রতি ইউনিয়নে আমাদের বিক্রয় কেন্দ্র নেই। আর এটা থাকা সম্ভব না। পৃথিবীর কোনো দেশে নেই।’

বিশ্লেষকরা যা মনে করছেন
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) কোষাধ্যক্ষ ড. মঞ্জুর-ই-খোদা তরফদার মনে করেন, ‘দাম বেশি হয়েছে নাকি কম হয়েছে, সেটার থেকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হলো: যেভাবে নির্ধারণ হওয়া উচিত, সেভাবে হয়নি…(দামের বিষয়ে) কৃষকদের পার্সেপশন জানার জন্য তাদের সাথে কোনোদিনও যোগাযোগ করা হয়নি। একটা অফিস অর্ডার করে দেয়া হলো। দাম নির্ধারিত হয়ে গেল।’

তিনি বলেন, ‘কৃষক ওই দাম (সরকার নির্ধারিত) পাবে, এমন নিশ্চয়তা কম। যে সমস্ত কৃষকের দুরবস্থা, তারা জমিতে ধান থাকতেই তা পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দেয়। আগাম টাকা পেয়ে যাবে, তাই।’

তার মতে, কৃষকের এই দুরবস্থার কারণ, তাদের বাড়িতে ধান রাখার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। গ্রাম বা ইউনিয়ন পর্যায়ে ‘শস্য মজুদকারী কেন্দ্র’ স্থাপন করা দরকার বলেও মনে করেন তিনি। যদিও এ বিষয়টি সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন খাদ্যমন্ত্রী।

ড. মঞ্জুর-ই-খোদা তরফদার বলেন, ‘ইউনিয়ন পর্যায়ে শস্যমজুদকারী কেন্দ্র করলে প্রান্তিক পর্যায়ের চাষীরা সেখানে ধান রাখতে পারবে। তখন আর তারা পাইকার, করপোরেটদের কাছে যাবে না। যারা ১০০ থেকে ২০০ বিঘা নিয়ে মেগা প্রজেক্ট করে, তাদের জন্য শাইলো (শস্যমজুদকারী কেন্দ্র) দরকার নেই। কিন্তু গরিবদেরকে বাঁচানোর জন্য দরকার।’
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement