২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তল্লাশির নামে হয়রানি আইনসিদ্ধ নয়

-

পুলিশকে বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা অন্যতম। দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের ওপর ন্যস্ত। অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অনেক সময় পুলিশ কর্তৃক অপরাধ সংশ্লেষে জড়িত বা সন্দিগ্ধ ব্যক্তির দেহ তল্লাশির আবশ্যকতা দেখা দেয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে মামলা সংশ্লিষ্ট দলিল বা চোরাইমাল বা অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক বা বেআইনি মালামাল উদ্ধারে গৃহ বা কোনো নির্দিষ্ট স্থান তল্লাশির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে অর্থাৎ একজন ব্যক্তির দেহ তল্লাশির সময় পুলিশ কী পদ্ধতি অনুসরণ করবে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪৭-৫৩তে সবিস্তারে উল্লেখ রয়েছে।

একজন ব্যক্তি আমলযোগ্য অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত বা সন্দিগ্ধ হলে পুলিশ গ্রেফতারি পরোয়ানা ব্যতিরেকে তাকে আটক করতে পারে। এরূপ ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকা গৃহে বা স্থানে অবস্থান করছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ উক্ত ব্যক্তির অনুমতিক্রমে তথায় প্রবেশপূর্বক তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। প্রবেশের অনুমতি দেয়া না হলে অথবা অনুমতি প্রদানে বিলম্বের কারণে অভিযুক্ত বা সন্দিগ্ধ ব্যক্তির পলায়নের কারণের উদ্ভব ঘটলে পুলিশ তল্লাশির প্রয়োজনে কোনো বহিঃ বা অভ্যন্তরীণ দরজা বা জানালা ভেঙে প্রবেশ নিশ্চিতের অধিকার রাখে। ওই স্থান একজন পর্দানশীন মহিলার দখলে থাকা অ্যাপার্টমেন্ট হয়ে থাকলে পুলিশ ওই অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশের পূর্বে মহিলাকে নোটিশ প্রদানপূর্বক অন্যত্র সরে গিয়ে তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ প্রদানের জন্য বলতে পারে এবং অতঃপর অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করতে পারে।

পুলিশ নিজেকে বা ওই স্থানে আইনানুগভাবে প্রবেশকৃত ব্যক্তিকে উদ্ধারে বহিঃ বা অভ্যন্তরীণ দরজা বা জানালা ভাঙ্গার ক্ষমতা ভোগ করে। আটককৃত ব্যক্তির পলায়ন রোধে প্রয়োজনাতিরিক্ত বল প্রয়োগ যেন না ঘটে তা নিশ্চিতের দায়িত্ব পুলিশের ওপর বর্তায়। পুলিশ বা কোনো বেসামরিক ব্যক্তি কর্তৃক আটককৃত ব্যক্তির জামিনে মুক্ত হওয়ার অবকাশ না থাকলে অথবা আটক ব্যক্তি জামিন গ্রহণে অপারগ হলে পুলিশ অথবা পুলিশ কর্তৃক পুলিশের হস্তান্তরকৃত কর্মকর্তা তল্লাশিকালীন আটক ব্যক্তির পরিধেয় বস্ত্রাদি ব্যতীত তার নিকট হতে প্রাপ্ত সব দ্রব্যসামগ্রী নিরাপদ হেফাজতে রাখার ব্যবস্থা করতে পারে। কোনো মহিলার দেহ তল্লাশির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে তা শালীনতা ক্ষুণ্ণ না হওয়া সাপেক্ষে অপর একজন মহিলা দ্বারা পরিচালনার বিধান রয়েছে। আটক ব্যক্তির নিকট হতে কোনো বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার হলে তা আদালত বা পুলিশ কর্তৃক পুলিশের হস্তান্তরকৃত কর্মকর্তার সম্মুখে উপস্থাপনের বিধান রয়েছে।

মামলাসংশ্লিষ্ট দলিল বা চোরাইমাল বা অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক বা বেআইনি মালামাল উদ্ধারে গৃহে বা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে তল্লাশির আবশ্যকতা দেখা দিলে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ইস্যুকৃত তল্লাশি পরোয়ানা ব্যতিরেকে পুলিশের প্রবেশাধিকার বারিত। এরূপ তল্লাশি কার্য পরিচালনার পূর্বে পুলিশ কর্তৃক স্থানীয় দুই বা ততোধিক ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিতের বিধান রয়েছে। উপস্থিত ব্যক্তিদের সম্মুখে তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনার পর তল্লাশিকালীন প্রাপ্ত দ্রব্যসামগ্রী জব্দ তালিকায় লিপিবদ্ধকরত তথায় তাদের সাক্ষ্য গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে যদিও আদালতে সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে আদালত কর্তৃক সমনপ্রাপ্ত হওয়া ব্যতিরেকে উপস্থিতি অত্যাবশ্যক নয়।

পুলিশ কর্তৃক অভিযুক্ত বা সন্দিগ্ধ বা আটক ব্যক্তির তল্লাশি মামলার তদন্ত কার্য শুরু হওয়ার পূর্বেই সচরাচর ঘটে থাকে। গৃহ বা কোনো নির্দিষ্ট স্থান তল্লাশির অধিকাংশ ক্ষেত্রেও দেখা যায় তদন্ত কার্য শুরুর পূর্বেই কার্যটি সম্পন্ন হয়ে থাকে। তদন্ত কার্য পরিচালনার দায়িত্ব পুলিশের ওপর ন্যস্ত।

পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত প্রত্যেক ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি। সব সময়ে জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির সাংবিধানিক কর্তব্য। তাছাড়া সংবিধান ও আইন মেনে চলা পুলিশসহ প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে পুলিশের বেতন, ভাতা ও সুযোগসুবিধাদি জনগণ প্রদত্ত রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রক্ষিত করের অর্থ হতে নির্বাহ করা হয়।


থানায় এজাহার বা এফআইআর দায়েরের মাধ্যমে যেসব মামলা রুজু হয় এর তদন্ত ভার পুলিশের ওপর ন্যস্ত। মামলার তদন্তের নিরপেক্ষতার ওপর বিচারের ফলাফল অনেকাংশে নির্ভরশীল। রাষ্ট্রের বেতনভোগ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত পুলিশ কর্তৃক তদন্ত সঠিক না হলে মামলা প্রমাণিত না হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। তদন্ত কার্য সঠিকভাবে পরিচালিত না হওয়ার কারণে আমাদের দেশে যে হারে সাক্ষ্য প্রমাণের অপ্রতুলতায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা অব্যাহতি প্রাপ্ত হয় তা ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার জন্য ভীতিকর। এশিয়ার রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতির ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ মামলা রাষ্ট্রের বেতনভুগ পুলিশ কর্তৃক তদন্ত কার্য সমাধা পরবর্তী বিচারঅন্তে সাজা প্রদানের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। আমাদের দেশে সাজা প্রদানের যে অস্বাভাবিক নিম্ন হার তা বর্তমান বিচারব্যবস্থায় তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের সামর্থ্যকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করে।

প্রায়শই গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ হতে জানা যায় পুলিশ কর্তৃক নিরীহ পথচারী বা যানবাহন যাত্রীদের দেহ তল্লাশির নামে তাদের পকেটে বেআইনি মাদক ঢুকিয়ে দিয়ে অন্যায়ভাবে অর্থ আদায়সহ সাথে থাকা মোবাইল, ঘড়ি, চশমা ও অপরাপর মূল্যবান সামগ্রী জোরপূর্বক হস্তগত করা হয়। হস্তগত করার ক্ষেত্রে বাধা দেয়া হলে মামলা দিয়ে জেলে প্রেরণের ব্যবস্থা করা হয়। গৃহ বা দোকান বা নির্দিষ্ট স্থানের ক্ষেত্রেও এরূপ ঘটনা সংগঠনের তথ্য পাওয়া যায়। সীমিত ক্ষেত্রে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও পুলিশের একটি বড় অংশ কোনোরূপ জবাবদিহিতার সম্মুখীন না হওয়ায় এ ধরনের অপরাধ হ্রাসের ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক কিছু প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না।

আমাদের রাজধানী শহরের প্রতিটি এলাকাই এক বা একাধিক চতুর্মুখী সিসি টিভি ক্যামেরার আওতাভুক্ত। তদন্ত কার্য পরিচালনায় পুলিশ আন্তরিক হলে যে কোনো অপরাধ সংশ্লেষে সঠিক অপরাধী চিহ্নিত করে তাদের বিচারের আওতায় সোপর্দ করা কঠিন কিছু নয়। পুলিশের বিরুদ্ধে এমনো অভিযোগ পাওয়া যায় কোনো গৃহে বা নির্দিষ্ট স্থানে অভিযান পরিচালনার পূর্বে সিসি টিভি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে অভিযান কার্য সম্পন্ন করা হয়। আবার এমনো শুনা যায় পুলিশ কর্তৃক বিস্ফোরক বা অস্ত্র বহন করে ভবনের অভ্যন্তরে রেখে ভবন মালিককে মামলায় বিজড়িত করা হয়। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদের অধস্তনদের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অধিকতর যত্নশীল হলে এ ধরনের ঘটনা রোধ ও নিরীহ মানুষের হয়রানি লাঘব হবে এমনটিই প্রতিভাত।

সম্প্রতি দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মহাসমাবেশ উপলক্ষে রাজধানী শহরে আগত ব্যক্তিদের রাজধানীর বিভিন্ন প্রবেশমুখে তল্লাশির মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত করে তাদের মোবাইলের হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইউটিউব, ফেসবুক প্রভৃতি অবলোকন করে তাদের দৃষ্টিতে মহাসমাবেশ আহবানকৃত দলটির সাথে কোনোরূপ সংশ্লেষ আছে কি না তা যাচাই করে ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে। প্রণিধানযোগ্য যে, সভা, সমাবেশ ও শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ একজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। অনুরূপ যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। উভয় অধিকারের ব্যত্যয়ে পুলিশের মাঠ পর্যায়ের দায়িত্বরত ব্যক্তিসব কর্তৃক যে কাজ করা হয়েছে তা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যাশিত নয়। এরূপ কাজকে প্রশ্রয় দেয়া হলে দেশের নাগরিক অধিকারসহ গণতন্ত্র বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

সংবিধানের নির্দেশনার ব্যত্যয়ে পুলিশ বা অপর কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কোনো কাজ করা হলে তা সংবিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করে। এরূপ পরাহত করার ক্ষেত্রে সংবিধানে নবসন্নিবেশিত অনুচ্ছেদ ৭ক(১)(খ) আকৃষ্ট হয়। আর আকৃষ্ট হলে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ২৯ এর আওতায় দ্বিতীয় তফসিলের অষ্টম কলামে বর্ণিত ব্যবস্থায় মামলা দায়েরপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। ফৌজদারি অপরাধ সময় দ্বারা বারিত না হওয়ায় বর্তমানে মামলা দায়েরের অনুকূল পরিস্থিতি বিরাজ না করলেও ভবিষ্যতে যে একই ধারা অব্যাহত থাকবে এরূপ নিশ্চয়তা দেয়ার অবকাশ আছে কি?

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement