০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


তৃতীয় নয়ন

পণবন্দিত্ব থেকে মুক্ত বাংলাদেশী জাহাজ আর এক যুগ আগের সেই ঘটনা

পণবন্দিত্ব থেকে মুক্ত বাংলাদেশী জাহাজ আর এক যুগ আগের সেই ঘটনা - ছবি : সংগৃহীত

পণবন্দিত্ব থেকে মুক্ত বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ দস্যুদের আওতাধীন এলাকায় রয়েছে। জাহাজটি সোমালিয়ান দস্যুদের আওতাধীন এলাকা থেকে এডেন উপসাগরে পৌঁছাবে। সেখান থেকে ওমান হয়ে ২২ এপ্রিল দুবাই পৌঁছাবে।

জাহাজের সব নাবিক সুস্থ আছেন। জাহাজের সব যন্ত্রপাতি সচল রয়েছে। জাহাজটি পরিচালনা করতে কোনো প্রকার সমস্যা হচ্ছে না বলে প্রধান প্রকৌশলী সাইদুজ্জামান মঙ্গলবার এক ভিডিওবার্তায় জানিয়েছেন। মুক্তি পাওয়ায় সবার প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। গত ১৪ এপ্রিল মুক্তি পাওয়ার পর দুবাই অভিমুখী চালানোর পর আরো ১০০ নটিক্যাল মাইল অতিক্রম করলে দস্যুদের আওতাধীন এলাকা পার হওয়া যাবে। একই ভিডিওতে বলা হয়, ২২ এপ্রিল জাহাজটি দুবাইতে পৌঁছানোর কথা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জাহাজ মালিক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম। তিনি বলেন, জাহাজটি এখন সঠিক কার্যকারিতায় রয়েছে এবং ২২ এপ্রিল দুবাই পৌঁছাবে। ১৩ এপ্রিল রাত ৩টায় সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পায় আবদুল্লাহ ও এর ২৩ নাবিক। দস্যুদের ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণ হিসেবে দেয়া হয়েছে। তিনটি ওয়াটার প্রুফ লাগেজে উড়োজাহাজের মাধ্যমে পানিতে ফেলা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে জাহাজ ছেড়ে চলে যায় ৬৫ জলদস্যু।

১২ মার্চ বেলা দেড়টায় সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকে প্রায় ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে, ভারত মহাসাগর থেকে এমভি আবদুল্লাহ জলদস্যুদের কবলে পড়ে। জাহাজটি মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে দুবাই যাচ্ছিল। এর আগে একই মালিক গ্রুপের এমভি জাহান সনিকে ২০১০ সালে পণবন্দী করেছিল একই গ্রুপের জলদস্যুরা। সেবারও মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধার করা হয়।

২০১০ সালের ৮ মে আরব সাগরের গালফ অব এডেনে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়ে জার্মান অয়েল ট্যাংকার মারিডা মারগারিটা। জাহাজের ২২ ক্রর দু’জন ছিলেন বাংলাদেশী। তাদের একজন প্রধান কর্মকর্তা জাফর ইকবাল, আমার নিকটাত্মীয়। অন্যজন দ্বিতীয় প্রকৌশলী গিয়াসউদ্দিন আজম খান। প্রায় সাড়ে সাত মাস পণবন্দী থাকার পর তারা মুক্তি পান। প্রথম আলোর তদান্তীন ক্রোড়পত্র ছুটির দিনের ১৫ জানুয়ারি ২০১১ সাল সংখ্যায় ‘জিম্মি জীবন’ শিরোনামে দু’জন বাংলাদেশী কর্মকর্তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

প্রথম দর্শনে কেমন মনে হয়েছিল জলদস্যুদের? সে কথা বলতে গিয়ে চেহারাটা কেমন যেন হয়ে যায় জাফরের। তারপর শুরু করেন, ‘আমরা তো ধরে নিয়েছিলাম। ভয়ঙ্কর ওই মানুষগুলোর হাতে যেকোনো মুহূর্তে প্রাণ যাবে। আল্লাহর রহমত সেরকম কিছু হয়নি। ২০১০ সালের ৮ মে আরব সাগরের গালফ অব এডেনে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়ে জার্মান অয়েল ট্যাংকার মারিডা মারগারিটা। জাহাজের ২২ ক্রর দু’জন বাংলাদেশী। তাদের একজন প্রধান কর্মকর্তা জাফর ইকবাল। অন্যজন দ্বিতীয় প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন আজম সাত মাস পণবন্দী থাকার পর ২০১০ সালের ২৮ ডিসেম্বর তারা মুক্তি পান। সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ৩৮ কোটি টাকা) মুক্তিপণ নিয়ে মারিড়া মারগারিটা জাহাজটি মুক্ত করে দেয় জলদস্যুর দল।

ছিনতাই হওয়ার আড়াই দিন পর সোমলিয়া উপকূলে জলদস্যুদের আস্তানা ‘বাজহাকুন’ পৌঁছায় জাহাজটি নোঙর করার পরপরই আরো ৫০-৬০ সশস্ত্র লোক জাহাজে উঠে গেল। এর পরের কাহিনী শোনা যাক জাফর ইকবালের মুখেই- ‘বাজহাকুন থেকে আবার জাহাজ ছুটল গারাকার উদ্দেশে। জলদস্যুদের শেষ আস্তানায় পৌঁছানোর তিন দিন পর একজন এলেন, জানতে পারলাম তিনি মধ্যস্থতাকারী। লোকটি শিক্ষিত, ভালো ইংরেজি জানেন। নাম আলী জামান। তিনি সবার উদ্দেশে বললেন, জলদস্যুরা কারো কোনো ক্ষতি করবে না। চাহিদা অনুযায়ী অর্থ পেলে সবাইকে ছেড়ে দেবে। তাতে আমাদের উদ্বেগ একটু কমে।’

জাফর ইকবাল জানান, ছিনতাই হওয়া প্রতিটি জাহাজে এরকম একজন মধ্যস্থতাকারী থাকে, বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে তাকে আনা হয়। কারণ, জলদস্যুরা জাহাজ ছিনতাই করতে পারে, কিন্তু মুক্তিপণ আদায়ের মহাযজ্ঞ কিভাবে শেষ করতে হয় তা তারা জানে না। ৩০-৪০ জন জলদস্যু পালা করে নাবিকদের পাহারা দিত। জাহাজের ওপর থেকে নিচে যেতে অনুমতি নিতে হতো, সঙ্গে সশস্ত্র পাহারা থাকত। আর কোম্পানির সাথে যোগাযোগ ও সমঝোতার কাজটি করত মধ্যস্থতাকারী। এর পর কী হলো? প্রশ্নটির উত্তর দেন গিয়াস। তিনি বলেন, ১৫-১৬ দিন জলদস্যুরা চুপচাপ ছিল। একদিন আলী জামান আমাদের সামনে ইংরেজিতে একটি ড্রাফট করলেন, তাতে কোম্পানির উদ্দেশে লেখা হলো, তোমাদের জাহাজ আমাদের কবলে। ১৫ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দাও। সবাইকে ছেড়ে দেবো। জাহাজ থেকে ফ্যাক্স করে তা পাঠানো হলো কোম্পানির জার্মানির কার্যালয়ে। এবার শুরু হলো দুই পক্ষের দরকষাকষি। আমাদের জীবনটাও তখন দরকষাকষির ফাঁদে পড়ে গেল।


আরো সংবাদ



premium cement