২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভোট ডাকাতির নির্বাচন আর নয় সরকারের টিকে থাকাই কঠিন

লেখক : মইনুল হোসেন - ফাইল ছবি

সরকার যেখানে ক্ষমতায় ঝুলে থেকে ব্যর্থতার বোঝা নিয়ে দেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে; সেখানে অবাধ নির্বাচন নিয়ে বিদেশী কূটনীতিকদের বিবৃতি ও পীড়াপীড়ি অর্থহীন। নির্বাচনের জন্য আরো এক বছর অপেক্ষায় থাকার অর্থ হবে মানুষের দুর্ভোগ নিরসনের কোনো চেষ্টা না করা। গাইবান্ধার উপনির্বাচন দেখিয়ে দিলো সরকারি দলের ভোট ডাকাতদের কাছে নির্বাচন কমিশন এমনকি প্রশাসন কতটা অসহায়।

কোথাও কোথাও মানুষ এক বেলা খেয়ে বেঁচে আছেন। সংবাদমাধ্যমে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা যে কিছু বলা হচ্ছে না তা নয়। সরকারের পক্ষ থেকেও দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে, কিন্তু দেশকে একদল বেপরোয়া লুটেরার হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তারাই সরকারের শক্তির একটি বড় অংশ। মহাসঙ্কটের মধ্যেও মেগা প্রজেক্ট নেয়ার কথা বলা হচ্ছে দুর্নীতিপরায়ণদের হাতে রাখার জন্য। নাগরিকদের ভোটের ওপর নির্ভর করতে হয় না বলে জনসাধারণের সমস্যা সরকারের বড় কোনো দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। বিরোধী দলগুলোর ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের বিশ্বাস, তাদের সময়মতো কেনা যাবে।

মনে হচ্ছে, সরকার শুধু আওয়ামী লীগের জন্য। ক্ষুব্ধ জনজাগরণের কথা না হয় ভুলে গেলাম, সরকারি সব প্রতিষ্ঠান প্রায় অকেজো অবস্থায় আছে। তাই ক্ষমতা ছাড়তে যত বিলম্ব হবে সঙ্কট তত ঘনীভূত হবে এবং শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের পথ অধিকতর কঠিন হয়ে উঠবে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কট বেড়েই চলছে। সেখানে আমাদের সরকার এখনকার অব্যবস্থাই সামাল দিতে পারছে না। রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় হতাশাগ্রস্ত মানুষ তাদের আর্থিক দুরবস্থা সহসা শেষ হওয়ার কোনো ইঙ্গিত না পেয়ে বর্ধিত হারে রাস্তায় এসে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। সরকারের বিদায় চাইছেন।

বর্তমান সরকারকে দেখা হয় আওয়ামী লীগের সরকার হিসেবে। আওয়ামী লীগ সরকার আওয়ামী লীগারদের জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ভ‚মিকা দেখছি না। তারা কী ধরনের মুক্তি চেয়েছেন তা জানতে পারছি না।

পুলিশের নিষ্ঠুরতা উপেক্ষা করে যারা বড় বড় সভা-সামবেশ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তাদের দেখে সরকার নিশ্চয় দুশ্চিন্তায় আছে। দুশ্চিন্তায় থাকলেও দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়ার পথ তাদের জানা নেই। কিন্তু সরকার এতটা অগোছাল এবং অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই সঙ্গীন যে, দেশকে আসন্ন আর্থিক বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, জনগণকে উপেক্ষা করে ক্ষমতায় থাকা আর সুশাসনে যোগ্যতা দেখানো ভিন্ন বিষয়। সরকার পরিচালনায় এত বেশি অযোগ্যদের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে, যা ইতঃপূর্বে দেখা যায়নি। সরকার চালানোর দায়িত্ব পড়েছে এক ধরনের অদৃশ্য লোকদের কাছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনায় যে যেভাবে পারছেন সঙ্কট বাড়িয়ে তুলছেন। চাঁদাবাজদের তৎপরতাও আগের চেয়ে আরো বেড়েছে। তারা ঘরে ঘরে গিয়ে উৎপাত করছে। পুলিশ প্রশাসনেরও শৃঙ্খলার অভাব রয়েছে। চার দিকে শুধু হতাশা দেখছেন সবাই।

জনগণের দুঃখ-দুর্দশা যতই থাকুক না কেন; নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করতে সরকারের হাতে রয়েছে পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তারা, জনগণের ভোটের কোনো প্রয়োজন হবে না, তাদের ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা নেই। ক্ষমতান্ধ ক্ষমতাসীনরা দেখতে পাচ্ছেন না যে, দুর্নীতি ও অব্যবস্থার কারণে ভেতর থেকে সরকার অচল হয়ে পড়ছে।

জনগণ যে সময়ে চরম ক্ষিপ্ত ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে তখন প্রত্যেককে তার নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হয়। চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে যে বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো তাকে সরকার নিজের জন্য অশনিসঙ্কেত হিসেবে দেখতে পারলে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হতো। রক্তপাত পরিহার করাও সহজ হতো।

নির্বাচন কমিশন গাইবান্ধায় নির্বাচন সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলো আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ গুণ্ডামির কারণে, সেখানে প্রধান দলগুলো নির্বাচন থেকে দূরে ছিল। প্রশাসনের সহযোগিতাও নির্বাচন কমিশন পায়নি। এখন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বলা উচিত, অন্যান্য দেশের মতো আমাদের নির্বাচন হতে হবে। ক্ষমতায় থেকে ও সংসদ ভেঙে না দিয়ে নির্বাচন করা হলে ইসি থাকা অর্থহীন।

অতীতেও যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষ থেকে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা চেয়ে পীড়াপীড়ি করা হয়েছিল; কিন্তু সেই আন্তর্জাতিক চাপ কোনো কাজে আসেনি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির চাপ থাকা সত্ত্বেও ভোট ডাকাতি করা হয়। এর কারণ খুব সোজা, অনির্বাচিত সরকারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না।

১৯৭১ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পটভূমিতে সৃষ্ট বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এটা প্রমাণ করতে যে দেশটি সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং জনগণ তাদের পছন্দমতো সরকার গঠনের ক্ষমতা রাখে।

এটি এখনো একটি গোলক ধাঁধা হয়ে আছে যে, স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়া নেতার যখন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পুরোভাগে থাকার কথা তখন সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর না করে কী কারণে গ্রেফতার বরণের দুর্বলতা দেখালেন তার ব্যাখ্যা পেতে হবে। আর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় ভারত।

বাস্তবতা হলো, জনজীবনে দুর্ভোগ ও বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যেও যদি সরকারের পক্ষে নির্বাচন করা সম্ভব হয়; তবু আমাদের বিদেশী শুভাকাক্সক্ষীদের জন্য ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা একপ্রকার তামাশা হিসেবে বিবেচিত হবে। ভোট ডাকাতির সুযোগ ছাড়া বর্তমান সরকার কিছুতে অবাধ নির্বাচন দিতে রাজি হবে না। কারণ সেটা হবে সরকারের জন্য আত্মহত্যার শামিল। তাই আমাদের ভাগ্য এখন বিদেশী শক্তিধরদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। জনগণের ভোটের সরকার না হওয়ায় বর্তমান সরকারও বিদেশী বন্ধু বা বন্ধুদের ওপর নির্ভর করছে।

আমাদের রাজনীতি ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এমন পরিবর্তন আনা দরকার যে, রাজনীতি অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা হবে না। টাকা কামাই করার নীতি-কৌশল গোটা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও গণবিরোধী করে তুলেছে।

অবাধ নির্বাচন বলতে অবশ্যই বুঝতে হবে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে বিতাড়ন, যাতে যোগ্য ও নিস্বার্থবান রাজনীতিবিদরা সুশাসনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেন। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই সেসব ব্যক্তিকে চতুর লোকেরা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবে, এটিই স্বাভাবিক।

নিজেদের নেতৃত্ব না থাকায় বাংলাদেশ একটি জটিল রাষ্ট্রে রূপ নিয়েছে। তাই এক কথায় সমাধান মিলবে না। বাংলাদেশে একনায়কত্ব চলছে, এটি সত্য নয়। বরং বলা ভালো- এখানে একাধিক ইচ্ছাপতির শাসন চলছে। নিছক অবাধ নির্বাচনের অর্থ দাঁড়াবে ব্যাপক হিংসা-প্রতিহিংসার বিস্তার। সবাইকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের একক রাজত্ব প্রতিষ্ঠার কাজে বর্তমান সরকার সব কিছু করেছে। দেশের প্রতিটি স্তরে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে।

তাই শান্তিপূর্ণ অবাধ নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার প্রয়োজনে বর্তমান সরকারকে বিদায় নিতে হবে। সবাইকে বুঝানো হয়েছে সরকার অর্থ আওয়ামী লীগ। ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়ার বিপক্ষে কাজ করায় জনগণের বিরাট অংশ তাদের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বিরোধী মতের মানুষজনের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের ব্যাপারে তথ্য গ্রহণ ও ভয়ভীতি সৃষ্টি করার পুরনো অভ্যাস ছাড়তে পারছে না সরকার । তাই নানা কারণে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা জন্ম নিয়েছে। শুধু জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া নয়, এরপর রয়েছে দুর্নীতিপরায়ণদের অবৈধ অর্থ।

সব কিছু মিলে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সবার আন্তরিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করার কাজটি যত ঝুঁকিপূর্ণ হোক না কেন শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement