২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ব্যবসা ও হলুদ ‘সাংবাদিকতা’

ব্যবসা ও হলুদ ‘সাংবাদিকতা’ - নয়া দিগন্ত

বিশ্ব সত্যতা গড়ে ওঠার পেছনে পত্রিকা প্রকাশনা শিল্প অতিগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। ইতঃপূর্বে দেখা গেছে যে, দেশপ্রেমিক, সাহিত্যিক, কলমযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবীরাই পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনা করতেন। যেমন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া (ইত্তেফাক), আহমদুল কবির (সংবাদ), আবদুল সালাম (অভজারভার), মওলানা আকরম খাঁ প্রভৃতি জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিরা পত্রিকা প্রকাশনা করতেন, যাদের ছিল রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং জাতির প্রতি একনিষ্ঠ ভালোবাসা, তারা পত্রিকাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেননি, প্রশ্রয় দেননি হলুদ সাংবাদিকতাকে, বরং গণমানুষের অধিকার আদায়, দেশ ও জাতির মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য কলমযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। কলম ধরেছেন রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজের বিত্তশালীদের বিরুদ্ধে যারা জনগণ ও জনগণের প্রাপ্য সম্পদ চকলেটের মতো চুষে চুষে খায়। এখন বিত্তশালীরা যাদের মিডিয়া জগতে কলম ধরার অভিজ্ঞতা নেই, দু’কলম লেখার যোগ্যতা নেই তারাও স্বনামে বেনামে পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক প্রভৃতি হয়ে যাচ্ছে। অন্য দশটি বৈধ বা অবৈধ ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার জন্য, সমাজে ভাবমূর্তি সৃষ্টি করার জন্য, প্রশাসনকে ভয়-ভীতিতে রাখার জন্য পত্রিকা ছাপিয়ে সরকারের গুণগান গেয়ে, অন্য দিকে কেউ তাদের অপকর্মের দিকে আঙ্গুল তুলে তাকালে হলুদ সাংবাদিকদের ব্যবহার করে প্রতিবাদকারীদের মুখ বন্ধ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। কোথাও সফল হয়েছে, কোথাও হয়নি। স্মরণ রাখা দরকার যে, লাইসেন্স বা অস্ত্রের লাইসেন্স, পারমিশন, পারমিট, পত্রিকার ডিক্লারেশন, খাস জমির লিজ প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট নাগরিকের প্রতি সরকারের একটি প্রিভিলেজ মাত্র। পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে এগুলোর গরংঁংব বা অনঁংব আইনসম্মত নয় বরং আইনের চরম লঙ্ঘন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যদিও সরকার ঘরানার ব্যক্তিদের আইনের মুখামুখি হতে হয় না, আইন শুধু কার্যকর সরকারবিরোধী মতাদর্শীদের ওপরে।

পত্রিকার ব্যবসাটি অপেশাদার, ব্যবসায়ী শ্রেণীর হাতে চলে যাওয়ায় এখন হলুদ সাংবাদিক গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে। বাস্তবতা এই যে, রাজধানীতে এক শ্রেণীর নষ্ট নারী রয়েছে, যাদের রাত্রিকালীন অভিজাত হোটেল বা নাইট ক্লাবে পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে অনেকেই প্রতিপক্ষের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে নিরীহ মানুষকে তথাকথিত প্রেমের ফাঁদে ফেলে এক দিকে টাকা হাতিয়ে নেয়, অন্য দিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জীবনটা করে তোলে কলঙ্কময়। এ ধরনের একটি রেওয়াজ মিডিয়া জগতে শুরু হওয়ার অভিযোগ উঠেছে যারা হলুদ সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এমন ঘটনা রয়েছে যে, একটি মিথ্যা রিপোর্ট ড্রাফট করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অর্থাৎ যার বিরুদ্ধে ছাপা হবে তাকে দেখিয়ে বলা হয় যে, নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা না দিলে পত্রিকায় নিউজ ছাপিয়ে দেবো।’ এভাবে চলে টাকা আদায়ের কলাকৌশল। এই ব্যক্তিরা কোথাও ধরা পড়েছে, কোথাও ধরা পড়েনি। প্রতিপক্ষের টাকায় প্রভাবিত হয়ে ওরা যখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটি মিথ্যা নিউজ দেবে, তখন হয়তো সংবাদ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চাইবে এবং টাকা না পেলে আপনার মুখ দিয়ে একটি উল্টো কথা পত্রিকায় ছাপা অক্ষরে প্রকাশ পাবে, যা আপনি কাউকে বলেননি। অনেক পত্রিকায় প্রকাশক ও মালিক ভূমিদস্যুতা, মানিলন্ডারিং প্রভৃতি ব্যবসার সাথে জড়িত। তারা তাদের প্রতিপক্ষকে দমানোর জন্য পত্রিকাটিকে পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে যেমন খুশি তেমনিভাবে ব্যবহার করছে। অনেকে পেশাদার সম্পাদক নিয়োগ দিলেও সম্পাদক সাহেবদের হলুদ সাংবাদিকতা প্রতিরোধ করার হয়তো সুযোগ হয় না। যারা পত্রিকায় সুন্দর সুন্দর কথা বলেন তারাও হলুদ সাংবাদিকতার সংস্কৃতি বন্ধের প্রচেষ্টা চালান না বা দাবি জানান না। অথচ এ কারণে গোটা সাংবাদিক সমাজ দায়ী হয়ে যাচ্ছেন অন্যায়ভাবে।

ভুয়া চিকিৎসক, ভুয়া আইনজীবী, ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট, ভুয়া সেনা কর্মকর্তা, ভুয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক ধরা পড়েছে। কিন্তু সাংবাদিক নামধারীরা যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে তা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব অবশ্যই প্রকৃত সাংবাদিকদের। সাংবাদিকতা একটি সুমহান পেশা, শিক্ষিত সমাজের একটি পেশা, দায়িত্বশীল শ্রেণীর একটি পেশা। এ পেশার মানমর্যাদা সমুন্নত রাখার দায়িত্ব অবশ্যই প্রকৃত সাংবাদিকদের।

পুলিশের ভাষ্য মতে, তারা শুদ্ধি অভিযান চালু করেছেন। যেসব পুলিশ মাদক কারবারি ও মাদক সেবনে অভ্যস্ত তাদের শারীরিক চেক-আপের মাধ্যমে মাদক সেবনের প্রমাণ পাওয়া ৬৮ জন পুলিশ চাকরিচ্যুত হয়েছেন। হলুদ ‘সাংবাদিক’দের চিহ্নিত করার জন্য প্রকৃত সাংবাদিকদের অনুরূপ একটি উদ্যোগ নেয়া দরকার যা রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তা করবে। সংবাদপত্রকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ অর্থাৎ চতুর্থ শক্তি মনে করে, যারা জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করতে পারেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র প্রকাশনা একটি দায়িত্বশীল কাজ, কিন্তু অপসাংবাদিকতা সংবাদপত্র অঙ্গনে প্রবেশ করে প্রকৃত সাংবাদিকদের মানসম্মানকে ম্লান করে দিচ্ছে, কারণ এই কথিত সাংবাদিকতা করোনাভাইরাসের মতোই মিডিয়াতে প্রবেশ করেছে বিধায় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সাধারণ মানুষ অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বাস করতে চায় না। ফলে পাঠকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলোরও ঈরৎপঁষধঃরড়হ কমে যাচ্ছে। চিন্তাশীল ব্যক্তিরা নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে, জাতি ধীরে ধীরে পত্রিকাবিমুখ হয়ে গেছে। এর কারণ কি? তা জাতির স্বার্থে অবিলম্বে খতিয়ে দেখা দরকার।

অনেক ঘটনা রয়েছে যা কোনো স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে সাংবাদিকদের অনেকে দেখেও না দেখার হয়তো ভান করেন। জেলা পর্যায়ের প্রশাসক ও পুলিশ প্রশাসন দ্বারা অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ যেভাবে হয়রানি হচ্ছেন, সে সংবাদগুলো প্রায়ই সংবাদপত্রে আসে না, আবার যেখানে সৎ সাংবাদিক রয়েছেন তারা সঠিকভাবেই সংবাদ প্রেরণ করে থাকেন। মফঃস্বলে পেশাদার সাংবাদিকদের অনেকের ডিসি/এসপি/ওসি’দের সাথে ইতঃপূর্বে এত সখ্যতা দেখিনি। তারা অনেক জায়গায়ই ডিসি/এসপি কর্তৃক সমাদৃত হলে নিজেরা নিজেকে ধন্য মনে করেন এবং প্রশাসনের অনুকূলে নিউজ করে বিভিন্ন ফায়দা তুলতে চান। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, নারায়ণগঞ্জ জেলাধীন রূপগঞ্জ উপজেলার ‘ভূমিদস্যুরা’ জোরপূর্বক তিন ফসলি জমি, খাল-বিল, নদী-নালা সবই ভরাট করে ফেলছে, কিন্তু এ সম্পর্কে পত্রিকায় কার্যকর কোনো সংবাদ স্থানীয় সাংবাদিকতায় করেন না, এর পেছনের কারণ কী, এ জন্য কে দায়ী?

অবক্ষয় শুরু হয়েছে সর্বত্র। সরকারি মহল থেকে জোরগলায় বলা হচ্ছে ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে’। শুধু ইট, সিমেন্ট, রড, বালুর সমন্বয়কে যদি ‘দেশ এগিয়ে’ যাওয়া বলা হয় তবে হয়তো সরকার আশ্বস্ত থাকতে পারেন, কিন্তু নৈতিকতার যখন অবক্ষয় ঘটে তখন সমষ্টিগতভাবে জাতি পিছিয়ে পড়ে এবং তখন একটি শ্রেণী মাত্র মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, যা অগ্রসরমান জাতির জন্য অশনি সঙ্কেত। সরকার ভালো আছে, ভালো খাচ্ছে, সরকারকে যারা দেখভাল করছে তারাও ভালো আছেন; কিন্তু সাধারণ মানুষ কি সমঅধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না? এর কারণ হলো নৈতিকতাবিহীন সামাজিক অবক্ষয়। পেশাগতভাবে একটি শ্রেণী ‘নৈতিকতা’ বিসর্জন দিয়ে এগিয়ে দিয়েছে এবং এর প্রতিরোধ যদি নিজ গোষ্ঠী থেকে শুরু করা না হয় তবে অনৈতিকতার প্রসার রোধ করা যাবে না। অনেক প্রেস ক্লাবে এখন বিরোধী মতাদর্শের সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নেই কেন? সেখানে বিরোধীদের সদস্য পদ দেয়া হয় না বলে অনেকের অভিযোগ। অথচ প্রেস ক্লাব জাতীয় ঐক্যের একটি প্রতীক হতে পারে।

কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন- জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলা একাডেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানকে দলীয় বা সঙ্কীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করা অনুচিত, কিন্তু তার পরও অনেক সময়ে হচ্ছে। তবে এ মর্মে বুদ্ধিজীবীরা কোনো কথা বলেন না, কারণ তারা এখন রাজনীতির চেয়ে অতিরাজনীতিতে ব্যতিব্যস্ত।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩(২)(খ) ধারা মোতাবেক সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। অন্য দিকে আইন পাস করে স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। কিন্তু হলুদ সাংবাদিকতার ব্যাপারে একটি কার্যকর আইন প্রণয়ন হওয়া দরকার। প্রকাশকের ব্যাকগ্রাউন্ড জেনে নিয়ে বা প্রকাশক হওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠি নিরূপণ করেই ডিক্লারেশন দেয়া বাঞ্ছনীয়। কোনো ব্যক্তি যখন হলুদ সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়েন, তখন সাংবাদিক অঙ্গনে বিচরণ করার অধিকার থাকে কি না, তাও পর্যালোচনা করা সময়ের দাবি ‘সত্য’ বলাই একটি সংবাদপত্রের ধর্ম, হলুদ সাংবাদিকদের অবাধ বিচরণের কারণে এটি যেন বিনষ্ট না হয়ে যায়!

লেখক : রাজনীতিক ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হওয়া উচিত : শি জিনপিং ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক জুলহাস আলম পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে চুয়েট ১১ মে পর্যন্ত বন্ধ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত নরসিংদীতে হিট স্ট্রোকে শিশুর মৃত্যু হিলিতে ভটভটি-মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২ ‘গাজার ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করতে ১৪ বছর লাগতে পারে’ সখীপুরে ছাগল চুরির মামলায় মা-ছেলে কারাগারে ‘অন্যায়ের সাথে নয়া দিগন্তের সাংবাদিকরা কখনোই আপোষ করেন না’ রাজশাহীতে হলে ঢুকতে না দেয়ায় রাস্তায় বিসিএস পরীক্ষার্থীর কান্না সালমান-শাকিবের পর এবার জয়কে টার্গেট!

সকল