২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


প্যানিক-প্যান্ডেমিকে ঈদানন্দ

-

চীনের উহান প্রদেশে গত বছর এক মাছ ব্যবসায়ীর শরীরে প্রথম চিহ্নিত হয়েছিল করোনাভাইরাস। তারপর যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যে। এরপর ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ইউরোপে। এখন আবার এশিয়ায়। ভারতে এখন চোখের সামনে মানুষকে শ^াস-প্রশ^াস বন্ধ হয়ে মরতে দেখা যাচ্ছে। সেখানে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারেরও বেশি লোক মারা যাচ্ছে। লাশের পর লাশ। সৎকার বা দাহ করার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশী যে যার মতো পালিয়ে বাঁচতে চায়। লাশের আশপাশে থাকা মানে নিজের মৃত্যুকে ডেকে আনা; এই চিন্তা মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার প্রেসক্রিপশনে প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মানুষ থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে চাচ্ছে। ফলে কোভিড নাইন্টিনে আক্রান্ত অসুস্থ মানুষের সেবাযতœ করার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর পাশে যখন আপনজন প্রিয়জনকেও দেখা যাচ্ছে না তখন সুস্থ-অসুস্থ সবাই নিজের অসহায়ত্ব উপলব্ধি করতে পেরে মানসিকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। এ অভিজ্ঞতা শুধু ভারত নয়, পৃথিবীর সব অঞ্চলের মানুষ পেয়েছে। মানুষ কখন কে মারা যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মৃত্যুভয়ে মানুষ পালিয়ে বাঁচতে চাচ্ছে। বেঁচে থাকাটাই এখন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব ভুলে গিয়ে বাঁচার জন্য মানুষের মধ্যে এখন প্রাণপণ প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। মানুষের জন্য এ অস্থিরতা বড় কষ্টের। সবকিছুর বিনিময়ে মানুষ বাঁচতে চায়। অথচ চিরন্তন, অবধারিত, অলঙ্ঘনীয় মৃত্যু; তবুও মানুষ মৃত্যুকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। এমন ভয়, আতঙ্ক ও জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে আগমন ঘটেছে মুসলমানদের ঈদ, ঈদুল ফিতরের। গত বছরও মুসলমানরা মহামারীকেন্দ্রিক বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে দুটি ঈদ উদযাপন করেছে। এবারো ঈদকে মহামারীর ভেতরেই উদযাপিত হতে হচ্ছে।
মানুষ যাকে মহামারী বা প্যান্ডেমিক বলে, মুসলমানরা সেটাকে গজব বা আল্লাহ প্রদত্ত শাস্তি বলে। পৃথিবীর ইতিহাসে গজব বা মহামারী নতুন নয়। আগেও পৃথিবীর মানুষ মহামারী বা গজবে বিপন্ন হয়েছে। তবে প্রতিটি গজবের ধরন বা বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়েছে; একটির সাথে অন্যটির মিল দেখা যায়নি। পবিত্র কুরআনুল কারিমে বেশ কিছু মহামারীর কথা উল্লেøখ করা হয়েছে। সেই মহামারীগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছিল। মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য যখন ব্যাহত হয় তখনই আল্লাহ মানুষকে শায়েস্তা করার জন্য গজব দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষ যখন মানুষ কর্তৃক সবচেয়ে বেশি অপদস্থ হতে থাকে তখনই মহামারী দিয়ে দাম্ভিক মানুষের দম্ভকে চূর্ণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কুরআনুল কারিমে বর্ণিত ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মানুষ যখন মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছে তখনই গজব এসে মানুষকে নাস্তানাবুদ করে ফেলেছে। সেই দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলা যায়, পৃথিবীর মানুষ এখন গজব ভোগ করছে।
ঈদ মুসলমানদের উৎসব। কিন্তু গজব থেকে মুসলমানও মুক্ত নয়। আল্লাহর ওয়াদা রয়েছেÑ বিশ^াসী ও সৎকর্মশীল মানুষকে আল্লাহর গজব স্পর্শ করে না। প্রশ্ন থাকতে পারে, সৎকর্মশীল মানুষ যদি মহামারীতে মৃত্যুবরণ করে তাহলে কী হবে? হাদিসে বলা হয়েছেÑ এ রকম মানুষকে শহীদের মর্যাদা দেয়া হবে; অবিশ^াসী আর অন্যরা নিজেদের কৃতকর্মের প্রতিদান ভোগ করবে। কাজেই মুসলমানও মহামারী থেকে পরিত্রাণ পাবে না। তাছাড়া মুসলমানদেরও কেউ কেউ কি মানুষ হত্যা করে না? ওজনে কম দেয় না? খাদ্যে ভেজাল দেয় না? ফেতনা সৃষ্টি করে না? মদ, জুুয়া ও সুদের সাথে সংযুক্ত থাকে না? ধর্ষণ-ব্যভিচার করে না? আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করে না? বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে বাধ্য করে না? অন্যের জমি দখল করে না? মানুষের হক নষ্ট করে না? স্বল্প কথায় সবাই বলবে, করে। যদি মুসলমানও এসব করে থাকে এবং এসব করার কারণে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে, তবে তাদের ওপর আল্লাহর গজব না আসার কোনো কারণ নেই। এ জন্য মুসলিম দেশও মহামারীর বাইরে থাকতে পারেনি। আল্লাহর গজব পৃথিবীর কোনায় কোনায় পৌঁছে গেছে। মুসলিম-অমুসলিম, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই এই মহামারীর শিকার হয়েছে এবং অত্যন্ত অসহায়ভাবে মহামারীর প্রভাব ভোগ করছে। করোনাভাইরাস মুসলমানদেরও আত্মীয়স্বজন, বাব-মা, ভাইবোন, বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জনকে কেড়ে নিয়েছে। মানুষ প্রিয়জন হারিয়ে যেমন শোকাতুর হয়েছে তেমনি নিজের মৃত্যুর আশঙ্কায় হতাশ ও বিহ্বল হয়ে পড়েছে। ফলে মানসিক প্রশান্তি বলতে যা বোঝায়, তার অভাব প্রতি মুহূর্তে মানুষ অনুভব করছে। অন্যদিকে করোনার প্রভাবে কেউ কেউ কর্ম হারিয়েছে। কারো রোজগার কমেছে। ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে। তার মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খেটে খাওয়া হতদরিদ্র মানুষগুলো। এই মানুষগুলোর বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদের কাছে ঈদ তার মৌলিক রঙ হারাতে বাধ্য হবে নিশ্চয়।
কোভিড নাইন্টিন মহামারীতে যখন মানবজীবন বিপন্ন, মৃত্যুভয়ে মানুষ যখন সন্ত্রস্ত নিথর; তখনো এক শ্রেণীর মানুষ চিকিৎসাসেবা নিয়ে বাণিজ্যে মেতে উঠেছে। কিছু অসাধু মুনাফাখোর নিত্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি করে দিয়ে মানুষের কষ্টকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। প্যান্ডেমিক বা মৃত্যুভয় এদেরকে কাবু করতে পারেনি। এদের কারো পরিবারে যদি করোনা হানা না দেয়, তবে এবারের ঈদের দিন তাদের আনন্দের সীমা থাকবে না। প্রতিবার ঈদে এই শ্রেণীর মানুষ যারা ফটকাবাজ, কর্তৃত্ববাদী, দখলদার, দস্যু, টাউট, বাটপাড়, রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত, রূপপুর পারমাণবিকের বালিশবাহিনী, শঠ দেশপ্রেমিক, ঘুষখোর পুলিশ, আমলা, ব্যাংক ডাকাত, অরোজাদার নাস্তিক, বিনোদ-বিনোদিনীদের ঘরে আনন্দের বাঁধভাঙা বন্যা বইয়ে যায়।
অথচ ঈদের তাৎপর্যে তারা ধিক্কৃত ও নিকৃষ্ট। তারা ধর্মের অনুশাসন পালন করে না কিন্তু ধর্মের উৎসবে উৎকট দৌরাত্ম্য নিয়ে আনন্দ সাগরে অবগাহন করে অবিরত। সেই আনন্দ স্র্রোতে নিষ্ট ধর্মপ্রাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের আর্তনাদ সবার অলক্ষ্যে মিলিয়ে যায়। যাদের যোগ্যতা নেই ঈদের আনন্দ ভোগ করার তারাই আনন্দে মেতে ওঠে সর্বদা; এ কথা ভেবে বেদনাস্নাত ক্লান্ত মানুষগুলো গভীর আগ্রহে ঈদের দিনটির সূর্যাস্তের জন্য প্রহর গোনবেন। যত তাড়াতাড়ি দিনটি শেষ হবে তত তাড়াতাড়ি তারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচে উঠবেন। ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারের শিশুদের মুখচ্ছবি ঈদের দিনে আরো করুণ হয়ে ধরা পড়ে। বড়দের মুখের দিকে তারা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। চার পাশের কোলাহল এই শিশুদের কাছে টানে না। পরিবারের বড়দের হাসি-আনন্দের সাথে ছোটদেরও যে আনন্দ বাড়ে। সেই বড়দের চোখে-মুখে যখন বেদনা-বিষাদের রেখা ফোটে তখন এমনিতেই শিশুমনে সেই বিষাদের আঁচড় লাগে। শিশুমনের আনন্দও নিষ্প্রাণ মলিন হতে থাকে। প্যান্ডেমিকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শিশুরা ঈদকে আসল রূপে উপলব্ধি করতে পারবে না।
এবারের ঈদানন্দ আনন্দ বয়ে নিয়ে আসবে না ফকির, মিসকিন, গরিব, দুঃখী, ছিন্নমূল মানুষের ঘরে। যাদের ঘরে দুই বেলা দু’মুঠো খাবার জোটে না তারা নিরন্তর বঞ্চিত হতে থাকবেন ঈদের আনন্দ থেকে। ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মুখাপেক্ষী হতে হয় পরের দুয়ারে। সেই দুয়ারও প্যান্ডেমিকের কারণে বন্ধ থাকবে। সে জন্য নতুন জামাকাপড়, এক মুষ্টি ভালো খাবার জোগাড় করতে গিয়ে কর্তাব্যক্তিকে বারবার নিজ কপালে চপেটাঘাত করতে হবে। যত ক্ষোভ আর কষ্ট রয়েছে সব অদৃষ্টের ওপর চেপে দিয়ে নিজের জন্য সান্ত্বনা খুঁজবেন তারা। খাদ্য-বস্ত্রের সঙ্কুলান না হলে নীরবে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে যাবে। তখন ঈদের আনন্দের লেশমাত্র তারা অনুভব করতে পারবেন না। এসব মানুষের জীবনে ঈদ হয়ে ওঠবে দলা পাকানো কষ্টের আধার। ঈদের দিন সন্ধ্যা নামলে তাদের কিঞ্চিত মুক্তি মিলবে। ছেলেমেয়ে স্বামী-স্ত্রী একসাথে নিকষ অন্ধকারে বসে জীবনের হিসাব মিলাবে। এভাবে পরের বছর আবার হয়তো ঈদের অপেক্ষা করবে! সে চিন্তায় তাদের শরীর হিম হয়ে ওঠবে। হিম ধরা রক্তে ঈদের উষ্ণতা নিয়ে মুসলিম বিশ্ব কবে প্রকৃত ঈদ উদযাপন করবে তা কে জানে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement
ঢাকাসহ ৫ জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সোমবার বন্ধ বাংলাদেশে পৌঁছেছে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দল কুমিল্লায় তাপদাহে অজ্ঞান কলেজ শিক্ষক, হাসপাতালে ভর্তি কুবিতে শিক্ষক সমিতির অবস্থান কর্মসূচিতে হামলা, ভিসির পদত্যাগ দাবি পঞ্চগড়ে গ্রেফতার ১০ মুসলমানকে অবিলম্বে মুক্তি দিন : খতমে নবুওয়াত রামেক হাসপাতালের দুদকের অভিযান চট্টগ্রামে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার নোয়াখালীতে গরমে শ্রেণিকক্ষে অসুস্থ হয়ে পড়ল ১৮ শিক্ষার্থী থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আকস্মিক পদত্যাগ রাজশাহীর তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি, হিটস্ট্রোকে যুবকের মৃত্যু বরিশালে যাত্রীবেশে উঠে চালকের গলায় ছুরি, প্রতারক দম্পতি গ্রেফতার

সকল