০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ফুল-পাখিদের লুকোচুরি

-

তুথান মারমা মেয়ে। মায়ের কোল ছেড়ে একা একা বাড়ির চারপাশ ঘুরতে পারে সে। বড় পাহাড়ের দক্ষিণ পাশে একটি টিলার উপর তুথানদের ঘর। মারমারা তাদের ঘরকে মাচং বলে। তুথান মাচং ছেড়ে বাড়ির চারপাশ দেখার জন্য একা একা বের হয়। ছোট্ট তুথানকে তাদের মাচংয়ের পেছনের স্বচ্ছ নীল রঙের জলের জলাশয় খুব টানে। সে দেখে জলের ভেতর পাখি ওড়ে। আবার নীল জলের ভেতর দিয়ে সাদা সাদা তুলোর মতো মেঘ উড়ে হারিয়ে যায়। তুথান দেখে আর খিলখিলিয়ে হাসে।
কতক্ষণ পরপর মা মা করে ডাকা তুথানের স্বভাব। সে ডাক কখনো তার মায়ের কাছে পৌঁছায় আবার কখনো মুরগির ডাকের সাথে মিশে যায়। তাতে তুথানের কিছু আসে যায় না। সে আপন মনে জলাশয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কখনো কখনো তার সাথে সঙ্গী হয় তার মায়ের পালিত মুরগি। মারমা ভাষায় মুরগিকে ‘ক্রা’ বলে। তুথান মুরগি দেখলে ক্রা...ক্রা করে আর মুরগিগুলো তার পাশে পাশে খুট...খুট করে। মারমাদের নিজস্ব ভাষা আছে। তুথান বড়দের দেখলেই বলে- ‘শিকুবায়’। যার অর্থ হলো সালাম। তুথানকে নিজের ভাষা শিখতে বেশি সাহায্য করে তার দাদীমা। সে তার দাদীমায়ের সাথে সময় কাটাতে খুব ভালোবাসে। কিন্তু তার দাদীমা তার সাথে ঘর ছেড়ে বের হতে পারে না। গত বছর থেকে সে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে আছে ঘরে। তুথান এখন আর আগের মতো দাদীমার কাছে থাকে না। নীল জলের জলাশয় খুব টানে। তাই সে নীরবে ঘর ছাড়ে। জলাশয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বড় পাহাড়টি তাকে মুগ্ধ করে রাখে। তুথান রাতে শুয়েও ঘরের জানালা দিয়ে ওই পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের ঘরটিও বেশ চমৎকার। চারপাশ খোলা এমন জায়গায় বাঁশ, পাহাড়ি ছন ও ঘাসের তৈরি। ঘরের সামনে বাঁশ দিয়ে তৈরি উঁচু মাচাও আছে একটি। বাড়ির প্রত্যেকটি কক্ষই একাধারে শয়নকক্ষ ও গুদামঘর। তুথানরা বাস করে মাচাংয়ের উপরে আর নিচে বাস করে তাদের গৃহপালিত পশু-পাখি।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই তুথান জলাশয়ের কাছে চলে যায়। সে দেখে নীল জলের ভেতর ফুলেরা নড়াচড়া করছে। লাল লাল ফুল, সাদা সাদা ফুল, হলুদ রঙের ফুল! ফুলের মেলা হচ্ছে জলাশয়ের জলে। মনে হচ্ছে কেউ একজন তুথানকে ঘুুরিয়ে ঘুরিয়ে ফুল দেখাচ্ছে। তুথানের ফুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। তুথান বেশ কয়েক দিন ধরে ফুল ছিঁড়ার জন্য টিলার ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এসেছে। কিন্তু ফুল ছেঁড়া হয়নি তার। কোনো দিন পাখির ডাক শুনে উপরে উঠে আসছে আবার কোনো দিন তাকে নিচে নামতে দেখে তার মা ছুটে গিয়ে নিয়ে আসছে। যতবার তুথান ফুল ছিঁড়তে গেছে ততবারই সে ব্যর্থ হয়েছে। তাতে তুথানের মন খারাপও হয়েছে বেশ। মন খারাপ হলে তুথান ক্রা...ক্রা করে আর মুরগিগুলো তার কাছে চলে আসে। আর তখন তুথানের মন ভালো হয়ে যায়।
তুথানকে আজ তার মা নিয়ে এসেছে জলাশয়ের একেবারে কাছ থেকে। তুথান লাল ফুল ছিঁড়ে আনতে চেয়েছিল। সূর্য উপরে দিকে উঠতে শুরু করলে ফুলগুলো ধীরে ধীরে লুকিয়ে যায় জলাশয়ের ভেতর। একটি ফুলকেও আর খুঁজে পাওয়া যায় না আর। আবার সূর্য না উঠলেও ফুলগুলো আসে না। তুথানের তখন ফুলের উপর খুব রাগ হয়। সাদা ফুলগুলো সবার আগে লুকিয়ে পড়ে। তারপর হলুদ ফুল। সবার শেষে চলে যায় লাল ফুল। লাল ফুলেরা বেশি ভালো। তুথানের সাথে অনেক ক্ষণ থাকে। তুথানকে নিয়ে আসায় আজ আর লাল ফুলের লুকিয়ে পড়া দেখতে পারেনি সে। তাই মায়ের সাথে বেজায় অভিমান করেছে। একটি কথাও বলছে না।
বিকেলে তার মা যখন বাড়ির বাইরে গেলেন তখন তুথান চুপিচুপি দাদীমার পাশ থেকে উঠে এলো। তিনি টের পেলেন না। তুথান জলাশয়ের কাছে চলে এলো। চারপাশে ঝলমলে রোদ। বেশ হাওয়া বইছে। তাই রোদের গরম তেমন একটা গায় লাগছে না। জলাশয়ের পাশে বসে সে দেখছে- জলের নিচের গাছের পাতার নাচন। একটি-দু’টি পাখি ডাল থেকে ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। লাল বড় একটি ফুল পাতার ফাঁকে দুলছে। তুথান ওই লাল ফুলটি ছিঁড়ে আনতে চাচ্ছে। ফুলটিও যেন তাকে ডাকছে। কি সুন্দর ফুল! বাতাস যত জোরে বইছে ফুলের নাচনও তত বাড়ছে। ফুলটির চারপাশে লাল পাপড়ির ঘের। মাঝখান দিয়ে একটি লম্বা হলুদ বোতাম অলা দণ্ড নথের মতো ঝুলছে। দণ্ডের মাথায় আবার লাল টিপ পরেছে ফুলটি। আহ! কি চমৎকার ফুল। সে ধীরে ধীরে জলাশয়ের খুব কাছে নেমে এলো। ঠিক এই সময়ে লাল ঠোঁটের একটি পাখি উড়ে এলো উপরের দিকে। ওমনি ফুলটি বিলীন হয়ে গেল কাঁপুনি দিয়ে। লাল ঠোঁটের পাখিকে মারতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু পাখিটিও তো লুকিয়েছে। কোথায় গেল ফুল? কোথায় গেল পাখি? তুথান কী করবে বুঝতে পারছে না। একটু পরেই আবার জলের দিকে তাকিয়ে দেখছে ফুল আর পাখি দুলতে দুলতে আবার আসছে। তুথানের চোখ ঝলমলিয়ে উঠল। মনটা আনন্দে ভরে গেল। সুন্দর ফুলটি আবার ফিরে আসছে। পাশে ঝাঁকে ঝাঁকে রঙিন পাখার প্রজাপতি উড়ছে। তুথানের ইচ্ছে করছে ওদের সাথে মিশে যেতে।
তুথান পাহাড়ি লতা ধরে ঝুলে আছে। সে কী করবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। তাই সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওই সময় জলাশয়ের পাশ দিয়েই তার মা জুমক্ষেত থেকে ফিরছিল। সে কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে তাকিয়ে দেখল তুথান লতা ধরে ঝুলে আছে জলাশয়ের জলে। তার কোমর পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে। সে দৌড়ে গিয়ে তুথানকে তুলল।
তুথানকে জড়িয়ে ধরে তুথানের মা কাঁদছে। তুথান তার মায়ের কান্না দেখে নিজে কান্না বন্ধ করে অবাক চোখে চেয়ে আছে মায়ের মুখের দিকে।
চারদিকের আলো কমে আসছে। পাহাড়ি পাখিদের কিচিরমিচিরে মুখরিত চারপাশ। তুথানের বাবাও ফিরেছেন বাসায়। তুথানের মায়ের কাছ থেকে সব ঘটনা শুনলেন। তারপর ভাবলেন কী করা যায়। যদি সে লাতাগুচ্ছ ধরতে না পারত তাহলে তো জলে ডুবে যেত। তিনি তুথানকে জিজ্ঞেস করলেন, ওই জলাশয়ে কেন নেমেছিলে। তুথান জানায়, সে ফুল ছিঁড়তে নেমেছিল। ওই জলাশয়ে অনেক ফুল ও পাখি আসে আবার চলে যায়। তাই সে সুন্দর একটি লাল ফুল নিতে চেয়েছিল।
তুথানের বাবা-মায়ের বুঝতে আর বাকি থাকল না যে, কী করতে হবে। পরের দিন সকালে তারা তুথানকে নিয়ে জলাশয়ের পাশের পাহাড়টিতে গেল। তারা তুথানকে ফুল দেখালেন। সেই লাল ফুল। এ ছাড়াও আরো অনেক ফুলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। লাল রঙের পরশপিপুল ফুল, জংলি ঝুমকা, নাগবল্লী ফুল ও করক ফুল। গাছের ডালের পাখিদের দেখালেন। তারপর অপেক্ষা করলেন রোদ বাড়ার জন্য।
রোদে ঝলমলে হয়ে উঠল পাহাড়সহ চারপাশ। আর পাহাড়ের ছায়া পড়ল ওই জলাশয়ের জলে। তখন ফুল পাখিদের দেখা গেল জলাশয়ের জলের ভেতর। তারপর তারা তুথানকে বুঝিয়ে বললেন, ওখানে পখি আর ফুল নেই। তুমি যা দেখছ তা হলো ওই পাহাড়ের ছায়া। ছায়া কখনো ধরা যায় না। তুথান বাবা-মায়ের সাথে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যিই দারুণ সুন্দর ওই পাহাড়! তার চেয়ে আরো সুন্দর জলাশয়ের ভেতরে পাহাড়ের ছায়া।


আরো সংবাদ



premium cement